কথা রেখেছেন মাহেরীন চৌধুরী। জেট ফুয়েলের উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে নিজের শরীর পুরোপুরি ‘অঙ্গার’ হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত বুকে আগলেছেন একটি একটি করে ২০ শিশুকে। কদিন আগেই অভিভাবকদের কথা দিয়েছিলেন, কোনো একটি শিশুর কিছু হবার আগে সেটা তাঁর বুকের ওপর দিয়ে যাবে।
মাঝে মাঝে ভাবতে চেষ্টা করি, ওই জ্বলন্ত আগুনের শিখা যখন সহস্র নাগিনীর বিষবাষ্প হয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলেছিল, তখনো অকস্মাৎ বিভীষিকায় বিপর্যস্ত স্থবির শিশুদের একজন একজন করে নিরাপদে সরিয়ে নিতে গিয়ে একবারও কি তাঁর মনে হয়নি—আর নয় এখন নিজেকেই সরিয়ে নিই। তাঁর কি একবারও মনে হয়নি—তাঁর বাড়িতেও তো রয়েছে উদ্বিগ্ন পরিজন, যাঁরা হয়তো ছুটে এসেছেন স্কুল ক্যাম্পাসের সামনে। একে একে বেরিয়ে আসা দগ্ধ বীভৎস শিশু-কিশোরদের সারিতে হয়তো তাঁকে দেখার তীব্র প্রতীক্ষা নিয়ে।
মাহেরীন চৌধুরী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কিংবা তারেক রহমানের আত্মীয় কি না, সে পরিচয় এখানে অর্থহীন। তিনি নিজেও সেটা জনসমক্ষে আনেননি কখনোই, মানবতার জন্য সর্বস্ব বিসর্জনের সাহসিকতা তখন আত্মীয়তার পরিচয় ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে, দেশের জন্য সবকিছু বিসর্জনের আত্মিক সম্পর্ক আত্মার আত্মীয় হয়ে রক্ত সম্পর্ককে এমনিভাবেই ম্লান করে ফেলে বারবার। পুরো বিষয়টি জানার পরও চিকিৎসকের কাছে তারেক রহমানের শান্ত প্রত্যাশা ছিল—ওনার অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনায় যা করণীয় সেটুকু করবেস। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, জার্মানি পাঠাবার দাবি জানাননি তিনি। এমনকি মৃত্যুর খবরের পরও চিকিৎসকদের ধন্যবাদ দিয়েছেন যথাসাধ্য করার জন্য, এমন রাজনীতিই চায় জনগণ।
মাহেরীন ম্যামের হাত ধরে, কোলে উঠে সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া শিশুরা হয়তো সারা জীবন তাদের শৈশবের সেই বীভৎস স্মৃতির ভয়াবহতা বয়ে বেড়াবে সত্যি, কিন্তু নিশ্চিতভাবে দূর আকাশ থেকে ভেসে আসা ছয়টি শব্দে বারবার প্রদীপ্ত হবে, হবে প্রত্যয়ী। চারদিকে আগুনের তীব্র হলকা আর গাঢ় ধোঁয়ায় মাঝে দিশাহারা শিশুদের পাশে মাহেরীন ম্যামের চিৎকার—‘দৌড়াও, ভয় পেয়ো না, আমি আছি।’
জীবনের প্রতিটি থেমে যাওয়ার মুহূর্তে মাহেরীন ম্যাম সব শিশুকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়ে যাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
মাহেরীন-মাসুকাদের মতো মানুষদের আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। যখনই বাংলাদেশ ক্লান্ত হবে, আপনাদের মতো মানুষেরা যেন বলতেই থাকেন—‘দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি।'চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধ নীরবতায় শতভাগ দগ্ধ আপাদমস্তক ব্যান্ডেজে মোড়া বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে হাত নামের দুটি অতীত প্রত্যঙ্গ দিয়ে স্বামীর হাত জোড়া ধরে বলেছিলেন, ‘আর দেখা হবে না।’ হতভম্ব নির্বাক স্বামীর জিজ্ঞাসা—কেন বেরিয়ে এলে না? আমাদেরও তো দুটো সন্তান রয়েছে। মাহেরীনের কাঁপা-কাঁপা উত্তর—কী করব, ওরাও যে আমার সন্তান, আমি যে অভিভাবকদের কথা দিয়েছি, ওদের কিছু হলে আমার বুকের ওপর দিয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাবার আগে কথোপকথন আর শব্দে থাকে না, নির্বাক চোখের ভাষায় রূপান্তরিত হয়।
শ্রেণিকক্ষে আর কোনো শিশু রয়ে গেলে কি না, সেটা নিশ্চিত না হয়ে মাহেরীন কী করে বের হবেন! আগুনের তেজ কমে এলে শ্রেণিকক্ষের ধ্বংসস্তূপ থেকে যদি কোনো শিশুর জীবিত-মৃত অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়, তাহলে কী জবাব দেবেন অভিভাবকদের?
মাহেরীন, পৃথিবীর এই বাক্যগুলো আপনার কাছে পৌঁছাবে কি না জানি না, আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি বিচ্যুত হননি। সম্পূর্ণ দগ্ধ ওই শ্রেণিকক্ষের সবাইকে আপনি নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন। মাহেরীন, আর দেখা হবে না বলে আপনার আক্ষেপ একদম সত্যি নয়, এই পৃথিবীতে শিক্ষার নামের সব প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বারে আপনি থাকবেন নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে, শ্বেতশুভ্র বসনে স্মিত হাসিতে শাশ্বত উজ্জ্বলতায়।
পুলিশ আর সেনাবাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ধ্বংসস্তূপ থেকে নিথর নিষ্প্রাণ বন্ধুকে পাঁজাকোলা করে বেরিয়ে আসা কিশোর সভ্যতাকে হতবাক করে দেয়। ‘বলেছিলাম তো কেউ বেঁচে নেই’, হতাশ দর্শকদের এমন জাগতিক মন্তব্যে কিশোরের দৃঢ় স্বর্গীয় উচ্চারণ ‘না’! আমি পৌঁছানো পর্যন্ত ও বেঁচে ছিল। আমাকে বলেছে, ‘জানতাম দোস্ত, তুই আসবি।’ কিশোরের ওই ঋজু উচ্চারণে পৃথিবী কেঁপে ওঠে, প্রত্যয়ের বজ্রপাতে বাতাস স্তব্ধ হয়, আমাদের সামনে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় ‘আমরা মানুষ তো!’
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের মাঠে বাবাকে খুঁজে ফেরা শতভাগ দগ্ধ শিশু, লাল সাদা ছোট ছোট চেক শার্টের স্কুল ইউনিফর্মের টুকরা যার গায়ে লেপ্টে আছে, যার নিতম্ব থেকে ঝুলে থাকা দগ্ধ চামড়া তাকে বিবস্ত্র যতটা করেছে, তার চাইতে অনেক বেশি মর্যাদাময় করেছে এক তেজস্বী সৈনিক হিসেবে, পিঠের চামড়ায় লেপটে থাকা আগুনের উত্তাপে পুড়ে দলা হয়ে যাওয়া স্কুলব্যাগ আর পানির বোতলে সে তখন বিশ্বজয়ী, বীরশ্রেষ্ঠ। ঠিক যেমন সম্পূর্ণ দগ্ধ নিরাভরণ মাহেরীন বা মাসুকা ম্যামেরা পৃথিবীর সবচেয়ে শুচিময় শুভ্রতা আর পবিত্রতার প্রতীক হয়ে—প্রশান্তির হাসিতে।
তার বিপরীতে কেতাদুরস্ত ইউনিফর্ম আর অজস্র মেডেলে বুক ঢেকে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা আর সশস্ত্র বাহিনীর দুর্বৃত্ত সেই কতিপয় নপুংসকদের কথা বলি, এত জমকালো ইউনিফর্ম আর মেডেলের অলংকারও যাদের নগ্নতা আড়াল করতে পারছে না এতটুকুও।
শ্রাবণের এই বর্ষায় নীলফামারীর জলঢাকার চৌধুরী বাড়ির কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়—‘মাহেরীন আর মাসুকা (মাসুকা বেগম) ম্যামের কবর’ দেশের মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত হচ্ছে। আপনাদের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আলোকিত চাকচিক্য নিতান্ত তুচ্ছ। একটি মেডেল আর কাগজের একটা পাতার চেয়ে অনেক বড় মর্যাদার ইতিহাস আপনারা সৃষ্টি করেছেন।
মাহেরীন-মাসুকাদের মতো মানুষদের আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। যখনই বাংলাদেশ ক্লান্ত হবে, আপনাদের মতো মানুষেরা যেন বলতেই থাকেন—‘দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি।'
এ দেশের কৈশোর আর তারুণ্য কথা দাও—তোমরাও থামবে না।
অধ্যাপক মওদুদ আলমগীর, আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আগ ন র র জন য দ র মত আম দ র আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
গুলিতে নিহত ছেলের জামা-জুতা আগলে দিন কাটে নাছিমার
ছেলে সাদ আল আফনানের কথা উঠলেই নাছিমা আক্তারের চোখ পানিতে টলমল হয়ে উঠে। একমাত্র ছেলেটি নেই, তা যেন ভাবতে পারেন না তিনি। ঘরে থাকা ছেলের বই-খাতা, জামাকাপড়, জুতা সবকিছুই যত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। এসব নিয়েই দিন কাটে তাঁর।
গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাদ আল আফনান (১৯)। ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে পুরো লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে নিহত হন ৪ শিক্ষার্থীসহ ১২ জন, আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। টানা ছয় ঘণ্টা ধরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেন তৎকালীন সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সালাহ উদ্দিনসহ তাঁর বাহিনী।
নিহত আফনান লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি লক্ষ্মীপুর শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। আফনান নিহত হওয়ার মাত্র দুই মাস আগেই অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় নাছিমার স্বামী সালেহ আহমেদের। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে ঘিরেই ছিল নাছিমার জগৎ। তবে স্বামীর মৃত্যুশোক না কাটতেই হারাতে হয় ছেলেকেও।
ওর রুমটা আমি ঠিক আগের মতোই রাখি। ওর বইগুলো, ওর জামাটা, এমনকি ওর শেষ পরা স্যান্ডেলটাও। জানি, আমার ছেলেটা আর আসবে না, তবু মন মানে না, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে।নাছিমা আক্তার, সাদ আল আফনানের মাসম্প্রতি বাড়িতে গিয়ে কথা হয় নাছিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, একাকী ঘরে ছেলের জামাকাপড়, বই খাতা নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটে তাঁর। ছেলের ব্যবহৃত জিনিসগুলো যত্নের সঙ্গে ঘরে সাজিয়ে রেখেছেন। ছেলে নেই, তা ভাবতে পারেন না তিনি। কাঁদতে কাঁদতে নাছিমা বলেন, ‘রাত হলে বুক ফেটে কান্না আসে। চোখে ঘুম আসে না। প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হয়। ছেলের ছবিটা বুকে নিয়ে রাত কাটে’।
নাছিমা আরও বলেন, ‘ওর রুমটা আমি ঠিক আগের মতোই রাখি। ওর বইগুলো, ওর জামাটা, এমনকি ওর শেষ পরা স্যান্ডেলটাও। জানি, আমার ছেলেটা আর আসবে না, তবু মন মানে না, বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে।’
গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুরে গুলিতে নিহত অন্য তিন শিক্ষার্থী হলেন মো. ওসমান পাটোয়ারী, কাইছার হোসেন ও সাব্বির হোসেন। হত্যাকারীদের বিচার হবে সেই আশায় রয়েছেন তাঁদের স্বজনেরা।
নিহত মো. ওসমান পাটোয়ারীর ভাই ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে হারিয়ে আম্মু এখনো ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। আমাদের প্রত্যাশা হত্যাকারীদের বিচার হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি’।
নিহত সাব্বির হোসেনের বাবা আমির হোসেন বলেন, সন্তানকে এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভুলতে পারেননি। সন্তানের হত্যাকারীরাই কেবল নয়, এর নির্দেশদাতাসহ জড়িত সবার বিচার দাবি করেন তিনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত বছরের ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শহরের তেহমনী এলাকা থেকে তোলা