জাতীয় সম্মেলনে হট্টগোল, হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে আহত করার অভিযোগ ও পাল্টাপাল্টি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। দু’পক্ষ এবার পাল্টাপাল্টি দোষারোপে নেমেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে ভাঙন ধরিয়ে সংগঠনটি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগও উঠেছে।
এদিকে উদীচীতে ভাঙনের এমন শঙ্কা তৈরির পেছনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কোনো কোনো প্রভাবশালী নেতাকেও দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও ক্ষুদ্র স্বার্থে সিপিবি নেতারা উদীচীতে ভাঙন ধরাতে চাইছেন। সিপিবির সর্বশেষ কংগ্রেসে নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। যার প্রভাব এখন দলের অন্যান্য গণসংগঠনেও পড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
উদীচীর তিন দিনব্যাপী ২৩তম জাতীয় সম্মেলনের শেষ দিন গত শনিবার বিকেলে ঢাকার শিশু একাডেমি মিলনায়তনে কাউন্সিল অধিবেশনে হট্টগোলের ঘটনাটি ঘটে। পরে কাউন্সিল অধিবেশনের সভাপতি হাবিবুল আলম সংগঠনের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক বদিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জামশেদ আনোয়ার তপনের নাম ঘোষণা করেন। সম্মেলন মঞ্চে এ কমিটির শপথবাক্য পাঠ করান হাবিবুল। এ নিয়ে আরেক পক্ষ তুমুল প্রতিবাদ জানালে উত্তেজনা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। সাত কর্মীর আহত হওয়ার খবরও চাউর হয়। পরে অন্য পক্ষ বদিউর রহমানকে সভাপতি পদে রেখে অমিত রঞ্জন দে’কে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন। এই পক্ষও পরে শপথ নেয়।
এর পর জাতীয় সম্মেলন ‘সফল’ হওয়ার দাবি করে শনিবার রাতেই তপনের নেতৃত্বাধীন অংশটি মিছিল বের করে। সংগঠনের সভাপতি বদিউর রহমানকেও মিছিলে যুক্ত করা নিয়ে নানা সমালোচনা তৈরি হয়। এতে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠনে ভাঙনের শঙ্কা দেখা দেয়।
এ অবস্থায় উদীচীর সভাপতি বদিউর রহমান গতকাল রোববার বিবৃতি দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। উদীচীর প্যাডে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, উদীচীর সম্মেলন ঘিরে আগে থেকেই ষড়যন্ত্র ছিল। কাউন্সিলে হট্টগোল থামাতে দেওয়া হয়নি তাঁকে।
বিবৃতিতে প্রবীণ এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, সম্মেলন-পরবর্তী মিছিলেও স্বেচ্ছায় যাননি তিনি। হাবিবুল আলম ও জামশেদ আনোয়ার তপনের নেতৃত্বাধীন পক্ষটি ভুল বুঝিয়ে ও জোর করে মিছিলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। তাঁর (বদিউর) অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে তাঁকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া ও পরে উদীচী অফিসে নেওয়ার কথা বলে জোর করে রিকশায় ওঠানো হয়। এর পর মিছিল শুরু করে একজন কর্মীসহ তাঁকে বহনকারী রিকশাকে ওই মিছিলের সামনে চলতে বাধ্য করা হয়। এক পর্যায়ে রাতেই তাঁকে উদীচী অফিসে নিয়ে ‘নতুন কমিটির প্রথম সভা’ করানোর চেষ্টাও করা হয়।
হাবিবুল-তপনের নেতৃত্বাধীন এ পক্ষটি গতকাল বিকেলে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘সংগঠন ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের’ পাল্টা অভিযোগ এনেছেন। এতে তপন বলেন, উদীচীর কাউন্সিলে প্রতিনিধিদের মতামতের বিপরীতে গিয়ে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করা দুঃখজনক ও স্পষ্টত ষড়যন্ত্র।
এ কমিটির সহসভাপতি হাবিবুল আলম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সর্বব্যাপী নতুন চিন্তার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ঐতিহাসিক দায় বর্তেছে উদীচীর ওপর। যারা বিভক্তি ডেকে আনছে, তারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্য শুভশক্তি নয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এ অংশের কমিটির সহসভাপতি ইকরামুল কবীর ইল্টু, জহিরুল ইসলাম স্বপন, সহসাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আরিফ নূর, বিজন রায়, সদস্য রুমি দে, শিল্পী আক্তার, তাহমিনা আক্তার নীলা প্রমুখ। রাতে অন্য অংশের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে সমকালকে বলেন, হাবিবুল-তপনের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। বরং তারাই অগঠনতান্ত্রিকভাবে উদীচী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।
অন্যদিকে উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব ঘিরে ফেসবুকেও পাল্টাপাল্টি পোস্ট এবং ছবি-ভিডিও শেয়ার অব্যাহত রয়েছে। সিপিবির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একাই গত দু’দিনে আটটি পোস্ট ও ভিডিও শেয়ার দিয়ে তপনের কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সিপিবি ও উদীচীর অন্য নেতারাও কেউ তপন আবার কেউ অমিতকে বৈধ সাধারণ সম্পাদক দাবি করে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। তবে কমেন্টে অনেকেই উদীচী ভেঙে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
জানতে চাইলে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সমকালকে বলেন, ‘আমি কারও পক্ষে কোনো পোস্ট দিইনি। কেবল আমার কাছে আসা পোস্ট ও ভিডিও শেয়ার করেছি। আর উদীচীতে সৃষ্ট সংকটের জন্য সিপিবির কাউকে দায়ী করার বিষয়টি অপপ্রচার। বরং গণসংগঠন হিসেবে উদীচী এই সংকট কাটিয়ে উঠবে এবং সিপিবি সবসময়ই পাশে থাকবে।’
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, উদীচী গঠনতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে চালিত হবে– এটাই প্রত্যাশা। তবে উদীচীর বিষয়ে সিপিবির কেউ যদি অনৈতিক ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেন, সে ক্ষেত্রে আমরা নিয়মানুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ন দ র য় কম ট ষড়যন ত র তপন র ন কম ট র স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচন বাতিলের সব ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার আহ্বান সিপিবির
আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ‘নির্বাচন বাতিল বা বিলম্বের ষড়যন্ত্র’ রুখে দিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। দলটি বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে হলে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মিরপুরের ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন সেনপাড়ায় সিপিবি ঢাকা মহানগর উত্তরের উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় এ আহ্বান জানানো হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মহানগর উত্তরের সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান এবং সভা পরিচালনা করেন সংগঠনের এই শাখার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ফেরদৌস আহমেদ।
সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিপিবির সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির। আরও বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন, কেন্দ্রীয় সদস্য ও মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি আহাম্মদ সাজেদুল হক, মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক লূনা নূর, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মোতালেব হোসেন ও মহানগর কমিটির সদস্য রিয়াজ উদ্দিন।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে কাজী সাজ্জাদ জহির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত চার মূলনীতি সমুন্নত রাখতে হবে। শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করতে শ্রমিক, কৃষক, যুব ও নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে হবে। বামপন্থীদের সরকার গঠন করতে সব দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাঁদের নেতৃত্বেই আগামী দিনের ক্ষমতায় লড়াইকে অগ্রসর করতে হবে।
সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান ছিল, আজ তারাই রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, ব্যবস্থার পরিবর্তনই সময়ের দাবি। কমিউনিস্টরা সেই ব্যবস্থার পরিবর্তনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আহ্বান জানাই, গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হলো নিরপেক্ষ ও সময়োপযোগী নির্বাচন। আগামীকাল থেকেই আমরা জাতীয় নির্বাচনের কাউন্টডাউন (ক্ষণগণনা) দেখতে চাই।’
নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু না হলে জনগণের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়বে বলে উল্লেখ করেন রুহিন হোসেন। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হলো নিরপেক্ষ ও সময়োপযোগী নির্বাচন। সরকারকে দ্রুত নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি, লুটপাট ও শোষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বদলের সংগ্রামকে জনগণের আন্দোলনে রূপ দেবে।’
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দেশীয় দোসরদের হাতে দেশের সম্পদ লুট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সিপিবির ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি আহাম্মদ সাজেদুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ এখনো অনিশ্চিত যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না। কারণ, বর্তমান সরকার এখনো সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেনি। জনগণ আজ অর্থনৈতিক সংকট, বৈষম্য ও দুর্নীতির শিকার। একদিকে জনগণের ঘামঝরানো টাকায় দেশ চলছে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসররা দেশের সম্পদ লুট করছে। সমুদ্রবন্দর, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগসহ জাতীয় সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। এটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত।