কোনো কাজেই গতি নেই নাগরিক সেবা লাটে
Published: 23rd, February 2025 GMT
স্থানীয় সরকার বিভাগে কোনো কাজেই গতি আসছে না। সরকার পতনের পর অনেক জনপ্রতিনিধি পালিয়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করায় স্থবির হয়ে পড়ে স্থানীয় সরকারগুলোর কার্যক্রম। সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডে আরেকটি বড় ধাক্কা লাগে মন্ত্রণালয়ে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের কাজ চলছে দুটি ভিন্ন স্থান থেকে। এ কারণে রুটিন কাজও সঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না। দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট সংস্কার, স্যানিটেশন, পানি সরবরাহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সনদ প্রদানসহ সেবামূলক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এতে বাড়ছে জনঅসন্তোষ।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে তিন মাস পরপর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হতো। গত ২৫ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডে সম্মেলন কক্ষটি পুড়ে যায়। এখন মন্ত্রণালয়ের বৈঠক করার মতো সভাকক্ষ নেই। গত ছয় মাসে একটিও আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়নি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সম্মেলন কক্ষে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠক হয় মাঝেমধ্যে। অগ্নিকাণ্ডের পর পুরো এক মাস কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বসার জায়গাই ছিল না। তড়িঘড়ি করে ডিএসসিসি নগর ভবনের ১৩ থেকে ১৫ তলার ৭৫টি কক্ষ খালি করা হয়। সেখানে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর কিছু কর্মকর্তা পুড়ে যাওয়া ভবনের দ্বিতীয় তলায় অফিস করছেন। দুটি স্থান থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করায় কাজের গতি কমে গেছে। এ ছাড়া আগুন লেগে অনেক ফাইল পুড়ে যাওয়ায় দ্রুত কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। মন্ত্রণালয় থেকে ৪০ বস্তা ফাইলপত্র নেওয়া হয়েছে নগর ভবনে। সেগুলোর মধ্যে মাত্র ছয়-সাতটি বস্তা এখন পর্যন্ত খোলা হয়েছে।
স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি না থাকায় জন্ম ও মৃত্যুসনদ, প্রত্যয়নপত্র পাওয়াসহ নানা ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। নগরীগুলোয় নামকাওয়াস্তে চলছে মশক নিয়ন্ত্রণসহ পরিচ্ছন্নতা কাজ। অতীতে মেয়রদের কার্যক্রম থাকত মাঠ পর্যায়ে। বর্তমানে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে প্রশাসক বসানো হলেও মাঠ পর্যায়ে তাদের কোনো তদারকি নেই। স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে পড়ায় দেশজুড়ে অনেক সড়ক বেহাল।
দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মধ্যে চট্টগ্রাম ছাড়া কোথাও মেয়র নেই। চট্টগ্রামের ডা.
অভিজ্ঞতায় ঘাটতি অনেক কর্মকর্তার
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুই জায়গায় বসায় প্রয়োজনের সময় যোগাযোগ করতেও অনেক সময় চলে যায়। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর বেশ কিছুদিন মন্ত্রণালয়ে সচিবের পদ শূন্য ছিল। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নজরুল ইসলামকে। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ডিএসসিসির প্রশাসক। দুই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁকে। পরে নজরুল ইসলামকে সরিয়ে দিলে প্রশাসকের পদ শূন্য হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের পদ পূরণ হলেও ডিএসসিসির প্রশাসকের পদ ছিল শূন্য। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান মিয়াকে দেওয়া হয় প্রশাসকের দায়িত্ব।
এদিকে, অনেক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোয় কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে হয়। সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে একের পর এক পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এই কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকার কারণেও মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে। একসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এসব দায়িত্ব পালন করাও কঠিন।
ওয়াসার কার্যক্রমে স্থবিরতা
দেশের চারটি ওয়াসার মধ্যে ঢাকা ওয়াসায় এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফজলুর রহমানকে। বাড়তি হিসেবে স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ শাখার অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে তাঁকে। তিনি সকাল থেকে আধাবেলা অফিস করে সচিবালয়ে চলে যান। অথচ ঢাকা ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সার্বক্ষণিক একজন এমডি থাকা প্রয়োজন। তিনি সর্বক্ষণ সময় দিতে না পারায় ওয়াসার কার্যক্রমও গতিহীন। এ ছাড়া একজন ডিএমডির পদ শূন্য। আরেকজনের বিরুদ্ধে মামলা থাকায় তিনি অনেকটা চুপচাপ অফিস করেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট ওয়াসার কার্যক্রমেও চলছে চরম স্থবিরতা।
ইউনিয়ন পরিষদের অনেকেই পলাতক
ইউনিয়ন পরিষদগুলোর জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা হয়নি। তবে তাদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের অনেকেই পলাতক। স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে দেশের ৪ হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে ১ হাজার ৪১৬টির চেয়ারম্যান পলাতক ছিলেন। অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছেন অনেকে। প্রকাশ্যে যারা আছেন, তাদের কর্মতৎপরতা নেই বললেই চলে।
সংশ্লিষ্টরা যা বলেন
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, আগে পৌরসভার কাউন্সিলররাও এলাকার রাস্তাঘাট-সড়কবাতির জন্য মন্ত্রণালয়ে তদবির করতে আসতেন। এখন কেউ আসেন না। আওয়ামী লীগের দু-একজন আত্মগোপনে থেকে ফোন দেন কাজ করে দেওয়ার জন্য। বিএনপি বা অন্য দলের যে দু-চারজন জনপ্রতিনিধি ছিলেন, তারা মাঝেমধ্যে আসেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের কারও এখন কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কাউন্সিলর ও মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁর পক্ষে এই অতিরিক্ত কাজ পরিচালনা করা কঠিন।
সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সরকারগুলো জনপ্রতিনিধিশূন্য থাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে পড়েছে। রাস্তা মেরামত, পরিচ্ছন্নতা, সড়কবাতি, মশক নিয়ন্ত্রণসহ নানা ধরনের কাজ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আগে সরাসরি তদারক করতেন। সিটি করপোরেশনগুলোতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দায়িত্ব আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের (আনিক) দেওয়া হয়েছে। এখন একজন কর্মকর্তাকে নিজস্ব দাপ্তরিক কাজ ছাড়াও ১০ থেকে ১৫টি ওয়ার্ডের কার্যক্রম তদারকি করতে হচ্ছে। এতে কোনো কাজই ঠিকমতো হচ্ছে না।
স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, আগে জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিতেন। সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সেগুলো বাস্তবায়ন হতো। গত ছয় মাসে একটিও নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। নতুন প্রকল্প না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই উন্নয়ন কার্যক্রম থেমে যায়। আগে মেয়র-কাউন্সিলররা তাদের স্বার্থেই এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বরাদ্দের জন্য সর্বক্ষণ তদবির-সুপারিশ করতেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর দপ্তরে সব সময় সারাদেশের জনপ্রতিনিধিরা আসতেন। এখন সেখানে দু-একজন সমন্বয়ক ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছাড়া তেমন কাউকে দেখা যায় না।
অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, আগে সপ্তাহে একজন হলেও বিদেশি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে সচিবালয়ে সাক্ষাৎ করতেন। তারা নানাভাবে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার আশ্বাস দিতেন। সেই কার্যক্রম এখন একেবারে নেই বললেই চলে। প্রতিদিন মন্ত্রণালয়ে একাধিক সভা হতো মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থার কার্যক্রমের অগ্রগতি বিষয়ে। প্রতি তিন মাস অন্তর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হতো। সভাকক্ষটি পুড়ে যাওয়ায় কার্যত মন্ত্রণালয়ের বৈঠক করার কোনো স্থান নেই।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ সমকালকে বলেন, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে দেশে সব সেবা কার্যক্রম প্রান্তসীমা পর্যন্ত যায়। সব ধরনের নাগরিক সুবিধা তাদের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। হাজার হাজার জনপ্রতিনিধির শূন্যতার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ এ সুবিধা পাচ্ছেন না। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জন্মনিবন্ধন, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ব্যাপক মাত্রায় ব্যাহত হচ্ছে। সেই ঘাটতি পূরণের জন্য প্রশাসক বসানো হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রশাসক কখনোই জনপ্রতিনিধির মতো কাজ করতে পারবেন না– এটাই বাস্তবতা। সুতরাং স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন যেভাবেই চিন্তা করি না কেন, তা খুবই জরুরি। এতে কিছুটা হলে অবস্থার উন্নতি হবে।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করা উচিত। কালক্ষেপণ না করে আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করা প্রয়োজন এবং দেরি না করে নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা উচিত।
‘অগ্নিকাণ্ডের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে’
মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব নিজাম উদ্দিন সমকালকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণে কিছু সমস্যা তো হচ্ছে, এটি অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। জনপ্রতিনিধির যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেটি অতিক্রম করার জন্য কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা এখন দুই-তিন গুণ কাজ করে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছেন। দুই স্থান থেকে মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও তেমন সমস্যা হচ্ছে না। এখন তো ইন্টারনেট-মোবাইল ফোনেই সব কথা বলা যায়। পুড়ে যাওয়া ফাইলপত্র নিয়েও তেমন সমস্যা হচ্ছে না। বাইরে আগুন লাগলেও দেখা যাচ্ছে, অনেক ফাইলের কাভার পুড়েছে; ভেতরে ঠিক আছে। আবার অনেকগুলো পোড়েনি, শুধু ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে।
সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের বিষয়ে তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নতুন দেওয়া হয়েছে। তারা কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। এখন কাজে গতি আসবে। নাগরিক সেবাও বাড়বে। উপদেষ্টার অভিজ্ঞতার ঘাটতি প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘হি ইজ ডুইং ভেরি ওয়েল। আমরা আলোচনা করে কাজগুলো করছি। আর উনার দপ্তরেও কোনো ফাইল আটকে থাকছে না। সব মিলিয়ে কোনো সমস্যা নেই।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন গর ক স ব ক ন দ র স থ ন য় সরক র ব ভ গ র র পদ শ ন য প রকল প ড এসস স পর য য় র অন ক র জন য ন পর য ক জ কর প রসভ সমস য ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
এক মৃত্যুপথযাত্রী পিতার থেকে ২০টি শিক্ষা
জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলো প্রায়ই আমাদের গভীরতম শিক্ষা দেয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ, জীবন এবং ফসলের ক্ষতি দিয়ে। যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও—যারা বিপদে পড়ে বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)
আমার পিতার মৃত্যুপথের যাত্রা আমাকে ধৈর্য, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা আমি আমার পরিবার এবং আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। এই শিক্ষাগুলো যে কাউকে তাদের মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের যত্ন নিতে সাহায্য করবে।
১. এটাই জান্নাতের পথ
এক বছর আগে, আমার পিতা দারুস সালামের একটি মসজিদের সিঁড়িতে পড়ে যান। এ দুর্ঘটনা তাঁকে হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ করে এবং তাঁর চিকিৎসার জন্য আমরা দুবাইয়ে চলে আসি। একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’
এই কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। যত্ন নেওয়ার কষ্টকে আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ হিসেবে দেখতে শুরু করি। এটি আমাকে কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।
আরও পড়ুনবাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা করছ, এটাই জান্নাত। তোমার পিতার কাছে থাকো।’২. আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি
বাবা যেদিন পড়ে যান, সেদিন থেকে আমি অনুভব করি, তাঁর সময় ঘনিয়ে আসছে। আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ের মুসলিম চ্যাপলেইন শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদের সঙ্গে কথা বলি।
তিনি বলেন: ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর সঙ্গে যা বলতে চাও, বলে নাও। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও। তাঁর সম্পত্তি, দাফন এবং সাদাকার ইচ্ছা জেনে রাখো। শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলো। এই সময় ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন।’
এই পরামর্শ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করেছে এবং আমার দায়িত্ব স্পষ্ট করেছে।
৩. দিনগুলো দীর্ঘ, বছরগুলো ছোট
মৃত্যুপথযাত্রী একজন পিতার যত্ন নেওয়া শিশুপালনের মতো। দিনগুলো ক্লান্তিকর—খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, বহন করা। আমার মা এই দায়িত্বের বেশির ভাগ পালন করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন। কখনো মনে হতো, এই কষ্ট কি শেষ হবে? আবার পরক্ষণেই ভয় হতো, শেষটা কি খুব কাছে?
এই দ্বন্দ্ব আমাকে বর্তমানে থাকতে এবং প্রতিটি মুহূর্তের জন্য শুকরিয়া আদায় করতে শিখিয়েছে।
৪. ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে চলা
পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। চিকিৎসা, অর্থ বা মানসিক চ্যালেঞ্জ—ঢেউ থামানো যায় না, কিন্তু তাদের সঙ্গে ভেসে চলা যায়। আমি এটাকে ‘সার্ফ-মোড’ বলি। এই মানসিকতা আমাকে চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই না করে তাদের গ্রহণ করতে শিখিয়েছে।
৫. কষ্টের মধ্যে স্বস্তি
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গে স্বস্তি আছে’ (সুরা শারহ: ৫)। পিতার অসুস্থতার মধ্যেও আমরা আল্লাহর রহমত দেখেছি—সঠিক চিকিৎসা দল, সময়মতো সঠিক মানুষের আগমন এবং ছোট ছোট অলৌকিক ঘটনা। এই ‘খায়ের’ আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে।
আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো, কারণ তুমি তোমার পিতার শেষ দিনগুলোতে তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছ। কান্না করতে পারো, কিন্তু হতাশ হয়ো না। তাঁর জীবনের পরামর্শ শোনো এবং সেগুলো তোমার সন্তানদের কাছে পৌঁছে দাও।শায়খ খলিল আব্দুর-রশিদ, মুসলিম চ্যাপলেইন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়৬. পিতার সেবা একটি ‘জিহাদ’
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমার পিতা–মাতার সেবাই তোমার জিহাদ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৯৭২)। পিতার যত্ন নেওয়া সহজ ছিল না। তাঁর বিরক্তি, দুশ্চিন্তা এবং ক্রমাগত চাহিদা আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছে। কখনো হতাশা বা রাগ অনুভব করেছি, কিন্তু কোরআনের আয়াত—‘তাদের সঙ্গে “উফ” বলো না’ (সুরা ইসরা: ২৩)—আমাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই জিহাদ আমার নফসের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল।
আরও পড়ুনএক বৃদ্ধ নবী যেভাবে বাবা হলেন০৪ জুন ২০২৫৭. পালিয়ে যাওয়া
ডাক্তারের জন্য, চেকআপের জন্য বা পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। কিন্তু এটি আমার নফসের দুর্বলতা ছিল। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি। এটি আমাকে পিতার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং বর্তমানে থাকতে শিখিয়েছে।
৮. সহনশীলতার খেলা
পিতার যত্ন নেওয়া একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়। সাইক্লিং ও দৌড় থেকে শিখেছি, সহনশীলতার জন্য বিশ্রাম, খাওয়া এবং ব্যায়াম প্রয়োজন। যখন আমি দৌড়াতে যেতাম বা ঘুমাতাম, তখন অপরাধবোধ অনুভব করতাম। কিন্তু নিজের যত্ন না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে যত্ন দেওয়া সম্ভব নয়। এটি আমাকে ভারসাম্যের গুরুত্ব শিখিয়েছে।
৯. অস্বস্তিকর আলাপ
মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি, ঋণ বা দাফনের ইচ্ছা নিয়ে কথা বলা কঠিন। আমরা পিতার সম্পত্তি নিয়ে কথা বলেছি, কিন্তু তাঁর অছিয়ত (উইল) নিয়ে পুরোপুরি আলোচনা করতে পারিনি। এটি আমাকে শিখিয়েছে, আমাদের সবাইকে মৃত্যুর আগে অছিয়ত স্পষ্ট করে রাখতে হবে। একবার এই আলাপ হয়ে গেলেই হয়ে গেল। অন্য সময় নাহয় স্মৃতি বা পরামর্শ শেয়ার করার জন্য তোলা থাক।
১০. অনিশ্চিত সময়ে পরিকল্পনা
পিতার অবস্থা কখনো উন্নত, কখনো সংকটাপন্ন ছিল। এই অনিশ্চয়তায় জীবন পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি ‘বাগানের মালির মানসিকতা’ গ্রহণ করি—গাছের যত্ন নিয়ে ফুল-ফসল আল্লাহর হাতে ভাবেন তাঁরা। তেমনি আমি ইস্তিখারা পড়ে প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিই। এটি আমাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ত্যাগ করে ভাগ্যের ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
পিতার খাওয়া-ঘুমের জন্য যে সময়টা অপেক্ষা করতে হতো, সেই ফাঁকে প্রায়ই ফোনে ইউটিউব দেখতে পালাতে চাইতাম। পরে বুঝতে পেরে আমি ইউটিউব মুছে ফেলি এবং কোরআন পড়া বা জিকির করার অভ্যাস গড়ি।১১. নিয়ত অনুযায়ী আল্লাহর ব্যবস্থা
গত রমজানে আমি দোয়া করেছিলাম, ‘হে আল্লাহ, আমাকে আমার পিতা–মাতার সেবা করার সুযোগ দাও।’ তখন আমি আমেরিকায় স্থায়ী ছিলাম, কিন্তু আল্লাহ অপ্রত্যাশিতভাবে দুবাইয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন—১০ বছরের ভিসা, কাজ এবং স্থানীয় সুবিধা। এই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সুবিধা আমাকে আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।
১২. নিয়তের পবিত্রতা
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার রব তোমার অন্তরের কথা জানেন। যদি তুমি সৎ হও, তিনি তওবাকারীদের ক্ষমা করেন।’ (সুরা ইসরা: ২৫)
যখন লোকে আমার প্রশংসা করত, আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, আমি কি আল্লাহর জন্য এটি করছি, নাকি মানুষের প্রশংসার জন্য? হতাশার মুহূর্তে আমি নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। এটি আমাকে আন্তরিকতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।
১৩. জিকিরের মাধ্যমে কষ্ট সহ্য করা
পিতা সারা বছর তাঁর ব্যথার মধ্যেও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, দরুদ শরিফ এবং তিলাওয়াত অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জিকির আমাকে একটি গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে একজন শায়খ বলেছিলেন, ‘রোগী যদি একটি তাসবিহও বলতে পারেন, তবে তাঁর জীবন রক্ষার চেষ্টা করো।’ পিতার প্রতিটি জিকির তাঁর মর্যাদা বাড়িয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
আরও পড়ুনপিতা-মাতাই সন্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু১১ আগস্ট ২০১৬১৪. আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন
একবার একজন নিরাপত্তারক্ষী পিতাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, তাই তিনি আপনাকে পরীক্ষা করছেন।’ এই কথা আমাকে ইমাম মালিকের হাদিসের কথা মনে করিয়ে দেয়: ‘একজন মুসলিমের ওপর যেকোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা আসে, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিঁধে, তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে আল্লাহ তা দিয়ে তার পাপ ক্ষমা করে দেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস: ১৮২৮)
এটি আমাকে কষ্টের পেছনের হিকমত বুঝতে সাহায্য করেছে।
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম১৫. দুশ্চিন্তা মোকাবিলা
চিকিৎসা ব্যয় এবং বাবার অবস্থা নিয়ে আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। একজন বন্ধু আমাকে ইমাম শাফিঈর কবিতা পাঠান: ‘যা ছিল, তাতে আল্লাহ তোমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন; যা হবে, তাতেও তিনি যথেষ্ট দেবেন।’
এ কথা আমাকে দুশ্চিন্তা কমাতে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করতে শিখিয়েছে।’
১৬. মায়ের শক্তি
আমার মা ছিলেন আমাদের পরিবারের মেরুদণ্ড। তিনি বাবার পরিচ্ছন্নতা, খাওয়া এবং আরামের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁর ধৈর্য ও ভালোবাসা আমাকে একজন স্ত্রী ও মায়ের অপরিসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। আমি দোয়া করি, আমরা তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তাঁর মতোই যত্ন নিতে পারি।
১৭. চিকিৎসা বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত
আতুল গাওয়ান্দের বই ‘বিয়িং মর্টাল’ আমাকে শিখিয়েছে, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা কষ্ট বাড়াতে পারে। আমরা একটি ‘প্রাকৃতিক মৃত্যুর অনুমতি’ ফর্ম স্বাক্ষর করি, যা পিতার জন্য শান্তিপূর্ণ মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এটি আমাকে মৃত্যুকে সম্মান করতে শিখিয়েছে।
১৮. মৃত্যুর মুহূর্ত
মৃত্যু চারটি পর্যায়ে হয়—সামাজিক, মানসিক, জৈবিক ও শারীরিক। আমি পিতার প্রথম তিনটি পর্যায় দেখেছি। শেষ মুহূর্তে, তিনি তিনটি শ্বাস নেন এবং ইন্তেকাল করেন। আমরা তাঁর পাশে পবিত্র কোরআন পড়ছিলাম, জিকির করছিলাম এবং বললাম, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’ এই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত আমাকে আল্লাহর মহিমার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
১৯. ব্যক্তিগত ও উম্মাহর কষ্ট
পিতার মৃত্যু আমাদের ব্যক্তিগত কষ্ট ছিল, কিন্তু গাজার ভাই-বোনদের দুঃখ আমাকে আরও বেশি ব্যথিত করেছে। তাদের অনেকে প্রিয়জনের যত্ন নেওয়ার বা দাফনের সুযোগ পায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে উম্মাহর জন্য কাজ করার প্রেরণা দিয়েছে।
২০. কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ব
এই যাত্রা আমাকে আল্লাহর রহমত, আমার মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে শিখিয়েছে। মহানবী (সা.)-এর উম্মাহ হিসেবে আমরা মৃত্যুকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, তা শিখেছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ আমার পিতাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুন্দর পরিণতি দিন।
সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম। অনুবাদ: মনযূরুল হক
আরও পড়ুনমারা গেলে নয়, সব সময় বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করা২০ মার্চ ২০২৪