নড়াইলে চুন-সুরকির গোয়ালবাথান মসজিদ গরমে দেয় ঠান্ডার প্রশান্তি
Published: 20th, March 2025 GMT
শ্যামল প্রকৃতির মধ্যে একটুকরা ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মসজিদ। প্রায় সাড়ে চার শ বছরের পুরোনো মসজিদটির অবস্থান নড়াইল সদর উপজেলার গোয়ালবাথান গ্রামে। চুন–সুরকির গাঁথুনিতে তৈরি গোয়ালবাথান মসজিদটিতে মোগল স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিক ছোঁয়া স্পষ্ট। সুনিপুণ একটি গম্বুজ, সুগঠিত ছোট চারটি মিনার আর দেয়ালের অসাধারণ কারুকাজ।
ছোটবেলা থেকে এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করা সত্তরোর্ধ্ব মো.
মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট ও প্রস্থ ৩৫ ফুট। নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় হয়। মূল মসজিদের ভেতরে একসঙ্গে তিন কাতারে নামাজ আদায় করা সম্ভব। তবে সময়ের পরিক্রমায় মুসল্লির সংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকায় মসজিদের সঙ্গে নতুন করে একটি অংশ সংযোজন করা হয়েছে, যাতে আরও বেশি মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ইবাদত করতে পারেন। মসজিদের পাশেই আছে শানবাঁধানো পুকুরঘাট, এখানে বসেই অজু সম্পন্ন করেন মুসল্লিরা।
মোগল আমলে মুন্সী হয়বৎউল্লাহ নামের একজন মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। তাঁর বংশধরেরা এখনো মসজিদটি দেখভাল করেন।প্রতিনিয়ত দূরদূরান্ত থেকে নামাজ আদায় করতে এবং মসজিদটি একনজর দেখতে ভিড় করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। তাঁদের একজন নড়াইল শহরের ভওয়াখালী এলাকার বাসিন্দা মো. তরিকুল ইসলাম। গোয়ালবাথান গ্রামে তাঁর একটি ইটভাটা আছে। মাঝেমধ্যে এখানে আসা হয় তাঁর। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, এই মসজিদের বয়স ৪৫০ বছর। এই এলাকায় এলেই আমি ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদে নামাজ পড়ি। এখানে নামাজ পড়ে খুবই শান্তি লাগে।’
মোগল আমলে মুন্সী হয়বৎউল্লাহ নামের একজন মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে। তাঁর বংশধরেরা এখনো মসজিদটি দেখভাল করেন। তাঁরা বলেন, টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মসজিদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। দর্শনার্থীদের জন্য বসার বেঞ্চ বা বিশ্রামাগার নির্মাণ করা জরুরি। এ ছাড়া মসজিদের ইমামের থাকার জন্য একটি ঘর প্রয়োজন। মসজিদে আসার ১০০ ফুট কাঁচা রাস্তা বৃষ্টির সময় কাদা হয়ে যায় বলে পাকা করা দরকার।
আমি ছোটবেলা থেকে এই মসজিদে নামাজ পড়ি। চুন-সুরকি দিয়ে বানানো হওয়ায় মসজিদের ভেতরে গরমের সময় ঠান্ডা ও ঠান্ডার সময় গরম অনুভূত হয়। মো. সুলতান কাজী, মুসল্লিমসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এইচ এম তৈয়বুর রহমান বলেন, এটি যশোর-খুলনা অঞ্চলের প্রাচীন একটি মসজিদ। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি এখনো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসেনি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তাদের আওতায় নিয়ে মসজিদটি দেখভাল করবে, এমনটাই আশা তাঁদের।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: মসজ দ র ন মসজ দ র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ