আল কুদস দিবস ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা
Published: 27th, March 2025 GMT
‘আল কুদস’ ফিলিস্তিনের রাজধানী। এটা মুসলিমদের প্রিয় ভূখণ্ড। এখানে মসজিদে আকসা অবস্থিত, যা মুসলিমদের প্রথম কিবলা ও তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। কোরআন মাজিদে এটিকে পবিত্র ও বরকতপূর্ণ ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী-রাসুলদের মধ্যে ইব্রাহিম, মুসা, ঈসা (আ.)-সহ অনেকে এখানে প্রেরিত হন। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের রজনীতে মসজিদে আকসায় ভ্রমণ করেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন: ‘পবিত্র মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করালেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশপাশে আমি বরকত দান করেছি। যেন আমি তাঁকে আমার নিদর্শনাবলি দেখাতে পারি।’ সূরা ইসরা: ১
ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘আল কুদস’ বা ফিলিস্তিনের পবিত্র নগরী এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর গৌরবময় সভ্যতা, সোনালি ইতিহাস এবং ধর্মীয় লীলাভূমির কারণে এটি মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি– সবার কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে পরিগণিত। মুসলমানদের কাছে এটি মসজিদে আকসাকে কেন্দ্র করে ঐক্যের প্রতীক ও ইমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ; খ্রিষ্টানদের কাছে যিশু খ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধকরণ গির্জা এবং ইহুদিদের কাছে প্রাচীন জেরুজালেমের জন্য বিশেষ মর্যাদার স্থান।
দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাবের (রা.
সেই থেকে মুসলিমরা জেরুজালেমের ধর্মীয় মর্যাদা ও পবিত্রতা অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের জন্যও উন্মুক্ত রেখেছে। পক্ষান্তরে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের পৌরাণিক বানোয়াট কল্পকাহিনি ও অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসে জেরুজালেমকে নিজেদের একচেটিয়া অধিকারে রাখার প্রবণতা পেয়ে বসে। এ উদ্দেশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা করেছে নির্মম নির্মূল অভিযান ও রোমহর্ষক গণহত্যা।
১০৯৯ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখল করে। তারা বায়তুল মুকাদ্দাসকে গির্জায় পরিণত করে এবং মসজিদে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেদিন মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদসের ভেতর ও বাহির। এর ফলে ছেদ পড়ে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে ফিলিস্তিনের মুসলিমরা ১১৮৭ সালে সুলতান গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবির হাতে পুনরায় জেরুজালেমকে হস্তগত করে।
১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯২০ সালে তারা সেখানে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এর কিছুদিনের মধ্যে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। তার পর থেকে হামলা-পাল্টা হামলা চলতেই থাকে।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর ৩৭টি বড় ধরনের গণহত্যা চালিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে আজকের ২০২৫ সালের রমজানের শেষ শুক্রবার পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলিদের গণহত্যা, জাতিগত নিধন, জোরপূর্বক বাস্তচ্যুতি, বোমাবর্ষণ, টার্গেট কিলিং, যুদ্ধকৌশল হিসেবে দুর্ভিক্ষ, নির্যাতন, ধর্ষণ অতীতের সব পরিসংখ্যান অতিক্রম করেছে। এতে অন্তত প্রত্যক্ষ মৃত্যু ৬১ হাজার ৭০০-এর বেশি, যার মধ্যে ১৭ হাজারই শিশু। পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা সম্ভবত কয়েক গুণ। ৮০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত।
ফিলিস্তিন সমস্যা শুধু তাদের নিজস্ব বিষয় নয়। এটি বিশ্বব্যাপী একটি মানবতাবাদী ইস্যু। দানব ইসরায়েল ফিলিস্তিন ইস্যুকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনি এটিকে বিশ্বমানবতার সমস্যা উল্লেখ করে মসজিদুল আকসাসহ সমগ্র ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ‘বিশ্ব কুদস দিবস’ ঘোষণা করেন। মুসলিম বিশ্ব এই দিবসকে প্রতিবছর কুদস দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এই দিন বিশ্বজুড়ে জনগণের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত রাখা এবং ইসরায়েলের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে সফলতা লাভে সক্ষম হবে।
মুহাম্মদ ফয়েজুল্লাহ: অধ্যক্ষ,
বসুরহাট ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা, কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।
শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’
এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’
এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।
অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।
ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবিইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।
গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:
‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’
এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।
গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্যইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।
আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তিইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।
জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।
ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।
*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব