রাস্তায় সারি করে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। নদীর ঘাটে ভেড়ানো ট্রলার থেকে এসব ট্রাক কাভার্ড ভ্যানে তরমুজ তুলছেন শ্রমিকেরা। তরমুজ নিয়ে ব্যস্ত শ্রমিক, কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি এ দৃশ্য দেখা গেছে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার আমখোলা ইউনিয়নের রামনাবাদ নদীর তীরের আমখোলা মোকামে। এখান থেকে প্রতিদিন দুই শ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে তরমুজ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমের এ সময় প্রতিদিন এই মোকামে প্রায় ছয় কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলায় এবার তরমুজের ফলন খুব ভালো হয়েছে। এবার ফলনের পাশাপাশি কৃষক তরমুজের দামও ভালো পাচ্ছেন। এক কানি (আড়াই একর) জমিতে তরমুজ চাষ করে সব খরচ বাদ দিয়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা লাভ হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকেরা তরমুজ নিয়ে আমখোলা মোকামে বিক্রি করতে আসছেন। জেলার একাধিক মোকাম থেকে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন শ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে করে তরমুজ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে।

সরেজমিনে আমখোলা মোকামে দেখা যায়, নদীপথে তরমুজ নিয়ে রামনাবাদ নদীর তীরে ভিড়ছে ট্রলার। ট্রলার থেকে ও কাভার্ড ভ্যানে তরমুজ তুলছেন শ্রমিকেরা।

ঢাকার গাজীপুর থেকে আমখোলা মোকামে তরমুজ কিনতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী মো.

জামান চৌধুরী বলেন, তিনি পটুয়াখালী থেকে ২০ বছর ধরে তরমুজ কিনে গাজীপুরে তাঁর আড়তে বিক্রি করছেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৭০ লাখ টাকার তরমুজ কিনেছেন। ঈদ পর্যন্ত তিনি এখান থেকে তরমুজ কিনবেন। তাঁর মতো আরও দেড় থেকে দুই শ ব্যবসায়ী আমখোলা মোকাম থেকে তরমুজ কিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে বিক্রি করছেন। প্রতিটি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে তিন থেকে চার লাখ টাকার তরমুজ পরিবহন করা হয়।

এবার পটুয়াখালী জেলায় ২৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। গত বছর জেলায় ২৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছিল।

আমখোলা মোকামের শ্রমিক সরদার মো. ইমরান বলেন, এখানে দিন–রাত প্রায় পাঁচ শ শ্রমিক তরমুজ ট্রাকে ভরার কাজ করছেন। প্রতিটি তরমুজ ট্রাকে তুলতে তাঁরা দেড় টাকা মজুরি পাচ্ছেন। ঈদ পর্যন্ত এই মোকামে ট্রলার থেকে ট্রাকে তরমুজ তুলে দেওয়ার কাজ করবেন তাঁরা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ায় এবার পটুয়াখালীতে তরমুজ উৎপাদন বেড়েছে। এ কারণে কৃষকেরা এবার বেশি লাভ করছেন। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হয়নি, তেমনি ভাইরাসের সংক্রমণও হয়নি। তাই এবার ভালো ফলন হয়েছে।

পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার পটুয়াখালী জেলায় ২৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। গত বছর জেলায় ২৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছিল।

গত বছ‌রে এক কা‌নি জ‌মি‌র তরমুজ বিক্রি করে  সা‌ড়ে ছয় লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এবার তরমুজ আবাদের সময় আবহাওয়া অনুকূ‌লে থাকায় এক কা‌নি জ‌মি‌র তরমুজ বিক্রি করে আট লাখ টাকা পাওয়া গেছে। শিপলু হাওলাদার , কৃষক , ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়ন , রাঙ্গাবালী উপজেলা

রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের কাউখালী গ্রামের কৃষক মো. মওদুদ খলিফা বলেন, এ বছর তিনি তিন কানি জমিতে তরমুজের আবাদ করেছেন। এতে প্রতি কানি জমিতে তাঁর তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। প্রতি কানির তরমুজ বিক্রি করে তিনি ১০ লাখ টাকা পেয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি ১৬ লাখ টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন।

রাঙ্গাবালী উপ‌জেলার ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়ন ইউ‌নিয়‌নের  কৃষক শিপলু হাওলাদার ব‌লেন, গত বছ‌রে এক কা‌নি জ‌মি‌র তরমুজ বিক্রি করে  সা‌ড়ে ছয় লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এবার তরমুজ আবাদের সময় আবহাওয়া অনুকূ‌লে থাকায় এক কা‌নি জ‌মি‌র তরমুজ বিক্রি করে আট লাখ টাকা পাওয়া গেছে।

তরমুজ তোলার শেষ সময় পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৮ মেট্রিক টন তরমুজ খেত থেকে তোলা সম্ভব, যার পাইকারি বাজার মূল্য তিন হাজার কোটি টাকা।নজরুল ইসলাম, উপপরিচালক, পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

সোনার বাংলা ট্রাক–কাভার্ড ভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মালিক মো. মহসিন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, আমখোলা এলাকায় ৫০টি ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি রয়েছে। এখান থেকে প্রতি দিন ২০০ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় তরমুজ সরবরাহ করা হচ্ছে ।

পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এবার জেলায় ২৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছে। গত বছর ২৩ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ করা হয়েছিল। তরমুজ তোলার শেষ সময় পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮৪৮ মেট্রিক টন তরমুজ খেত থেকে তোলা সম্ভব, যার পাইকারি বাজার মূল্য তিন হাজার কোটি টাকা।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র তরম জ ব ক র ট ক র তরম জ তরম জ ক ন তরম জ ত ল ব যবস য় করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে

সাংবাদিক ফারজানা রুপা চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই দাঁড়িয়েছিলেন। বিচারক তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি হত্যা মামলা নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করছিলেন। ইতিমধ্যে অন্য মামলায় কারাগারে থাকা এই সাংবাদিক শান্তভাবে জামিনের আবেদন জানান। ফারজানা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। আর তাঁর স্বামী চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা।

এক বছর আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বিক্ষোভ চলাকালে দুজন সাংবাদিক নিহত হন। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের অধীন সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সরকার তখন থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কিন্তু প্রায় এক বছর পর এখনো সাংবাদিক ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু কারাগারে আছেন। হত্যায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে পৃথক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিগত সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বারবার ব্যবহারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সেন্সরশিপ বলেই মনে হচ্ছে।

এ ধরনের আইনি অভিযোগ ছাড়াও সিপিজে সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে হুমকি এবং নির্বাসনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই বলেন, ‘চারজন সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’

আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সিপিজের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই এতে যুক্ত করা হয়। মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী সিপিজেকে বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, পরিবার তার হিসাব রাখতে পারেনি। তাঁরা অন্তত ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, তারা পাঁচটি মামলার এফআইআর পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে হলো তাঁদের কেউই জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তাঁরা সাড়া দেননি বলে সিপিজের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ