মিরপুর, উত্তরা, বসুন্ধরা, বনানী এত বড় জনপদেও একটি থিয়েটার হল নেই, নেই বইয়ের দোকান, সিনেমা হল। অথচ ধানমণ্ডিতে ১ হাজার ৩৫০টি রেস্টুরেন্ট। অর্থাৎ আমাদের সমাজে ‘খাওয়া’ হয়ে উঠেছে প্রধান বিনোদন—এমন এক মানসিকতা যেখানে জাতির মনন তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে গেছে। কথাগুলো নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদের।

সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শিল্পীরা গণতন্ত্রের লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনৈতিক শক্তিগুলো পাশাপাশি ছিল। ফলে পাড়ায় পাড়ায় নাটকের দল গড়ে ওঠে। কিন্তু কথিত গণতন্ত্রের কালে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের কালে সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যেন ভাষা হারিয়ে ফেলে। শিল্পকলার সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মাঠঘাট থেকে নাটকের ও গানের দলগুলো হারিয়ে যায়। পাঠাগারগুলো শ্মশানপুরীতে পরিণত হয়। শহরগুলো থেকে সিনেমা হল উধাও হয়ে যায়। গত ১৬ বছর জনপরিসরগুলো ছিল আয়-রোজগারের উপায়। কিন্তু জনপরিসর হলো প্রতিরোধের ঠিকানা।

দুই.

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি। তার সামনে লক্ষ্মী সিনেমা হল। টিকিটের একটি অংশ লাইব্রেরির জন্য ব্যয় হতো। এখন সেই সিনেমা হলও নেই, ১৮৫৪ সালের লাইব্রেরিটিও মৃতপ্রায়।

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, গানটি জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া সিনেমায় আন্দোলনকারীরা গায়। ধারণা করা হয়, জাতীয় সংগীত হওয়ার পেছনে সিনেমায় গানটি ব্যবহারের একটি ভূমিকা আছে। আমাদের জাতীয় জাগরণের পেছনে ভূমিকা আছে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যাত্রাপালার। সিনেমা হল, যাত্রাপালা, থিয়েটারগুলো ছিল জাতীয় জাগরণের কেন্দ্র। কারণ, এখানে যৌথভাবে আনন্দ উপভোগের ব্যাপারটি থাকে।

স্বৈরাচার এরশাদ উপজেলাগুলোতে যে টাউন হল নির্মাণ করেন, সেখানেই অভিনীত হতো এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নাটকগুলো। সাক্ষরতা ছিল ৩০ শতাংশের নিচে, বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হাতে গোনা ৪টি। তবুও রাজনৈতিক ননফিকশন বইগুলো বিক্রি হতো কমপক্ষে হাজার দুয়েক কপি। শিক্ষিত তরুণ মাত্র কবিতা মুখস্থ থাকত।

গ্রামে ধান কাটার পরে কুশান পালাসহ নানান ধরনের পালা হতো। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মধ্যেও মধ্যবিত্তের মধ্যে গান শেখার রেওয়াজ ছিল।

তিন.

কুড়িগ্রাম কলেজ মোড়। এখানে দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় নেই পাশেই দুটি হলরুম আছে। পক্ষকালব্যাপী নাটক হলেও কেউ টের পায় না। কারণ, দুটি টাউন হল মার্কেট দিয়ে আড়াল করা।

এখানে একটি সাধারণ পাঠাগার আছে, তার সামনেও কয়েকটি দোকানঘর। সাধারণ পাঠাগারটি কেউ খুঁজেও পায় না। এখানেই বিজয়স্তম্ভের পেছনে কয়েকটি বড় গাছ ছিল, তার নিচে ছিল ৮–১০টি চায়ের টংদোকান। পুরো শহরের সংস্কৃতি কর্মী ও লেখকেরা সারা দিন এখানে আড্ডা দিতেন। কত লিটলম্যাগ, কত নাটক, কত আন্দোলনের পরিকল্পনা এখানে জন্ম নিয়েছে। জায়গাটির নাম কারা যেন দিয়েছিলেন পণ্ডিত চত্বর। আওয়ামী লীগ নেতারা জায়গাটি দখল করে মার্কেট বানিয়েছিল। ৫ আগস্ট এই মার্কেটের রূপসী বাংলা হোটেলটি ছাত্র-জনতা ভেঙে ফেলে।

কুড়িগ্রামের প্রধান ডাকঘর ও অফিসার্স ক্লাবের পেছনে বিশাল একটি পুকুর। সেটির বড় অংশ এখন পৌর মার্কেটের দখলে। এমনভাবে আড়াল করা, তার খবর সাংবাদিকেরাও জানে না। সাবেক মিতালি সিনেমা হলের পাশেই ছিল বিশাল একটি পুকুর। সিনেমা হলটিও নেই, পুকুরটিও ৪ ভাগের ১ ভাগে নেমে এসেছে। পুকুর দুটিও ভ্রাম্যমাণ নাগরিক স্নান, বৈকালিক ভ্রমণ, জলাবদ্ধতা নিরসন ও অগ্নিদুর্ঘটনার মুশকিল আসান হয়ে উঠতে পারত।

গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে নাটক-সিনেমা ও যাত্রাপালায় ঢেউ আসার কথা। উপজেলায় উপজেলায় নতুন নতুন নাটকের দল, নতুন নতুন সিনেমা হল, বুকশপ, বটতলা ও পুকুরপাড়ে সিমেন্টের চেয়ার-বেঞ্চ দিয়ে মঞ্চ গড়ে ওঠার কথা। বিপ্লবের পর পুরোনো সংস্কৃতির জায়গায় নতুন সংস্কৃতি আসে। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানকে স্থায়ী করতে দরকার হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সেই সাংস্কৃতিক বিনিয়োগ কই?

সংস্কৃতির বিনিয়োগকারী কারা? যাদের সংস্কৃতি তারাই বিনিয়োগকারী। স্থানীয় বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানালে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য ঘর ও জনপরিসরগুলোতে মঞ্চ এমনিই গড়ে উঠত। রাষ্ট্রের শুধু তাঁদের দাতা হিসেবে পাথরফলকে নামটি লিখলেই তারা খুশি। এটিই গণ–অভ্যুত্থানের সংস্কৃতি।

প্রতিটি পৌরসভার একাধিক মার্কেট আছে। একটি মার্কেটে বুকশপ ও সিনেপ্লেক্সের জন্য জায়গা বরাদ্দ বাধ্যতামূলক করা যায়। একটা গাইডলাইন দিয়ে আহ্বান জানানো যায় বিনিয়োগের।

‘আমলাতন্ত্রের প্যাঁক-কাদা আমাদের কেবলই দলিল তৈরি, ফরমান (ডিক্রি) সম্পর্কে অন্তহীন আলোচনা, ফরমান রচনার দিকে টানে এবং সেই কাগজের সমুদ্রে প্রকৃত এবং সজীব কাজ ডুবে যায়। চতুর নাশকতাকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের এই কাগজের জলাভূমিতে টানে এবং বেশির ভাগ জন-কমিশনার এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা অচেতনভাবে এই ফাঁদে পা দেয়।’ ‘প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও আমলাতন্ত্রের প্রতিহতকরণ’ নিয়ে ১৯২২ সালের জানুয়ারিতে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী সিরুপার কাছে এই কথাগুলো ভ. ই. লেনিন লিখেছিলেন।

গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারে এমন ব্যক্তি কই, যিনি শুধু সচিবালয়ে নন, ছুটে যাবেন জেলাগুলোতে দেশ গড়ার ডাক নিয়ে। জনগণের ভাষায় জনগণের পোশাকে জনগণ ও তাদের শিল্পীদের উজ্জীবিত করে দলিল-নথি ছাড়াই কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন। আর জনগণের পাহারায় তা সফল হয়ে উঠবে। এটিই হবে গণ–অভ্যুত্থানের বাংলাদেশ।

নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বচ্ছতার জন্য ডিএনসিসির প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে:

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।  

সোমবার (২৮ এপ্রিল) ডিএনসিসির ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত পশ্চিম শেওড়াপাড়া, পশ্চিম কাজীপাড়া ও সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় ৪ কিলোমিটার রাস্তা, ৫ কিলোমিটার নর্দমা ও দেড় কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণকাজের উদ্বোধন ও গণশুনানি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা জানান।

ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, ডিএনসিসির সব প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। প্রকল্পটি কবে শুরু হবে, কবে শেষ হবে, কতা টাকা বরাদ্দ আছে—এসব তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এছাড়া, রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ হলে নির্মাণ সামগ্রী কী, সেটা জনগণের জানা দরকার। যখন জনগণ জানবে, তখন তারা জবাবদিহি করতে পারবে।

তিনি বলেন, “আমি গত সপ্তাহে কাউকে না জানিয়ে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে চলমান কাজ পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, রাস্তাকে ধরে রাখার জন্য যে ওয়াল (বিশেষ দেয়াল) দেওয়া হয়েছে, সেটার পিলার বানানোর কথা ছিল স্টোন দিয়ে; কিন্তু বানিয়ে রেখেছে ব্রিক দিয়ে। এটা বড় দুর্নীতি। স্থানীয় মানুষ যদি না জানে, কী নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হবে, তাহলে দুর্নীতি করাটা সহজ। তথ্যের যত বেশি আদান-প্রদান হবে, তথ্য যত বেশি পাবলিক করা হবে, জনগণ তত বেশি জবাবদিহি করতে পারবে। আমি ঠিকাদারকে জানিয়ে দিয়েছি, সঠিক নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার না করলে বিল দেব না। তারা বলেছে, এটা ঠিক করে দেবে।” 

মোহাম্মদ এজাজ বলেন, যার যার এলাকার কাজ তারা বুঝে নেবেন। বুঝে নেওয়ার জন্য যত তথ্য ও সহযোগিতা লাগবে, সেটা আমরা দেব। ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে প্রকল্পের সব তথ্য ও ঠিকাদারের ফোন নম্বরসহ দেওয়া থাকবে। স্থানীয় জনগণ স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কাজ বুঝে নেবেন। আমরা চাই, সকলের অংশগ্রহণে উন্নয়নকাজ সম্পন্ন হবে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় সোসাইটি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহযোগিতা পাচ্ছি। সবার অংশগ্রহণ বাড়াতে আমি বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নিয়ে গণশুনানি করছি। প্রতি মাসে ফেসবুক লাইভে দেশে-বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সাথে যুক্ত হচ্ছি। ডিএনসিসির সবার ঢাকা অ্যাপ আছে, সেটির পাসওয়ার্ড পর্যন্ত আমাদের দিচ্ছে না। আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা ৪ কোটি টাকা খরচ করে এই অ্যাপ বানিয়েছে। পাসওয়ার্ড না দিলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।”

ডিএনসিসির প্রশাসক বলেন, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় হকারদের জন্য হাটা যায় না। মানুষের অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। ঢাকা শহরে মানুষের চলাচলের অধিকার সবার আগে, সেই অধিকার আমরা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। মিরপুর-১০ এর প্রধান সড়কের যত হকার ও অটোরিকশা আছে, সেগুলো আমরা বন্ধ করে দেব। যারা এ ধরনের ইনফরমাল পেশায় যুক্ত আছেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্যও আমরা প্ল্যাটফর্ম করব। তাদের জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা আমরা তৈরি করব। এই শহরটা সবার, সবাই একসাথে বসবাস করব; কিন্তু অন্যদের কষ্ট না দিয়ে, অন্যের অধিকার নষ্ট না করে। 

বক্তৃতা শেষে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহাবুব আলম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা।

ঢাকা/এএএম/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সাথে পুলিশের মতবিনিময়
  • ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সিপিবি নেতার সৌজন্য সাক্ষাৎ
  • রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত স্থগিতের দাবি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের
  • ট্রাম্প কানাডাকে ‘ভেঙে ফেলতে’ চেয়েছিলেন
  • পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা
  • মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুলিশের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান
  • হামদর্দের গাজার জনগণের প্রতি মানবিক সহায়তা
  • প্রশাসক নিয়োগের বিরুদ্ধে রিট, ইউনিয়ন পরিষদটিতে চার মাস ধরে সব সেবা বন্ধ
  • সংসদে সংরক্ষিত আসন, না তৃণমূল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ?
  • স্বচ্ছতার জন্য ডিএনসিসির প্রকল্পের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে: