গবেষণা হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে পথচলার ভিত্তি
Published: 31st, May 2025 GMT
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ নয়। তাই স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির ভিত্তি দাঁড়িয়েছে স্বল্প মজুরির শ্রম ও রপ্তানিনির্ভর শিল্পের ওপর একটি মডেল– যা অদক্ষ বা অর্ধদক্ষ শ্রমনির্ভর এবং প্রযুক্তিগতভাবে স্থিতিশীল নয়। দক্ষ মানবসম্পদের অভাব ও গবেষণা উদ্ভাবনের প্রতি অবহেলার ফলে এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে অস্থির ও ক্ষণস্থায়ী। এমনকি প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বেও এই ঐতিহ্যগত কাঠামো অপরিবর্তিত থাকায় বাংলাদেশ আজ এক গভীর ও মৌলিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
বর্তমানে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নামে এক যুগান্তকারী বাস্তবতায় প্রবেশ করছি, যা পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতগামী ও ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন, বিগ ডেটা, জিন প্রকৌশল ও রোবটিক্সের মতো প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত এই বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে শিল্প, কর্মসংস্থান ও জ্ঞান অর্জনের ধরন আমূলভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি, গবেষণাভিত্তিক সমাধান এবং আন্তঃবিষয়ক দক্ষতা। গবেষণা এখন আর শুধু উচ্চশিক্ষা বা পিএইচডি পর্যায়ের বিষয় নয় কিংবা শুধু গবেষণা কেন্দ্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি হওয়া উচিত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর শেখার একটি আবশ্যিক অংশ। এটি শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রশ্ন নয়; বরং এক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর– যা নেতৃত্ব, নীতিনির্ধারণ ও চিন্তাধারায় মৌলিক পরিবর্তনের আহ্বান জানায়। এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে– উদ্ভাবনের পথে হাঁটবে, নাকি পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি নেবে।
এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে শিক্ষানীতি, শিল্পনীতি ও গবেষণা কাঠামোয় সময়োপযোগী সংস্কার জরুরি। আমাদের প্রচলিত পাঠ্যক্রম এখনও মুখস্থনির্ভর– যেখানে সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা এবং আন্তঃবিষয়ক শিক্ষার বাস্তব চর্চা প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে শিল্প খাতের প্রয়োজন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মধ্যে এক গভীর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই ব্যবধান দূর করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে– যেখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ভিত নির্মাণ করা হবে।
যেসব দেশ আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা তাদের জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করছে। যেমন– দক্ষিণ কোরিয়া গবেষণায় ব্যয় করে জিডিপির ৪ শতাংশেরও বেশি, অথচ বাংলাদেশে এই হার ০.
বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা এখনও পরীক্ষানির্ভর ও সনদকেন্দ্রিক। আউটকাম বেজড এডুকেশন (ওবিই) চালুর পরেও তা এখনও গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষায় পরিণত হয়নি। শিক্ষার্থীরা মুখস্থ নির্ভরতায় আবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, বিশ্লেষণী বা সমস্যাভিত্তিক চিন্তায় অভ্যস্ত হচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকে উৎসাহিত করার মতো পরিবেশ বা কাঠামো তৈরি করতে পারছে না। ফলে যে গবেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা থমকে আছে– যা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতায় অত্যন্ত জরুরি। এই সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, দলাদলি এবং দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক অস্থিরতা। এ বাস্তবতা একুশ শতকের জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার পথে এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা, আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা কেন্দ্র, বাস্তব সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা– সব মিলিয়ে একটি উদ্ভাবনবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকদের গবেষণার মেন্টর হিসেবে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে এবং পাঠ্যক্রমে সৃজনশীল চিন্তা, গবেষণা ও আন্তঃবিষয়ক সংযুক্তিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়ে উঠবে।
গবেষণাকে অবহেলা করলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে প্রযুক্তিনির্ভর কিন্তু উদ্ভাবনহীন একটি অর্থনীতি– যেখানে কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে, খাদ্য ও স্বাস্থ্য খাত অনিশ্চয়তায় পড়বে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ব। এখনই সময় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার, কারণ আগামী বাংলাদেশের ভিত আজকের সিদ্ধান্ত ও বিনিয়োগের ওপরই নির্ভর করছে। ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে তার মাশুল গুনতে হবে অনেক বেশি।
গবেষণাকে জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত করতে হবে। প্রয়োজন একটি সমন্বিত গবেষণা নীতিমালা– যেখানে থাকবে বিনিয়োগ কাঠামো, গবেষণার অগ্রাধিকার, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব ও টেকসই অর্থায়নের সুস্পষ্ট রূপরেখা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।
কাজেই আর দেরি নয়, বিশ্ব যখন উদ্ভাবনের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশকেও গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা, কার্যকর অংশীদারিত্ব ও সুপরিকল্পিত গবেষণা বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটতেই হবে। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত একটি উদ্ভাবনী জাতি গঠনের জন্য এ সিদ্ধান্ত আজই নিতে হবে।
এম এম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও
অধ্যাপক (অব.), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব স তবত য় ন র ভর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ