বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ নয়। তাই স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির ভিত্তি দাঁড়িয়েছে স্বল্প মজুরির শ্রম ও রপ্তানিনির্ভর শিল্পের ওপর একটি মডেল– যা অদক্ষ বা অর্ধদক্ষ শ্রমনির্ভর এবং প্রযুক্তিগতভাবে স্থিতিশীল নয়। দক্ষ মানবসম্পদের অভাব ও গবেষণা উদ্ভাবনের প্রতি অবহেলার ফলে এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে অস্থির ও ক্ষণস্থায়ী। এমনকি প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বেও এই ঐতিহ্যগত কাঠামো অপরিবর্তিত থাকায় বাংলাদেশ আজ এক গভীর ও মৌলিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

বর্তমানে আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নামে এক যুগান্তকারী বাস্তবতায় প্রবেশ করছি, যা পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতগামী ও ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন, বিগ ডেটা, জিন প্রকৌশল ও রোবটিক্সের মতো প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত এই বাস্তবতায় বিশ্বজুড়ে শিল্প, কর্মসংস্থান ও জ্ঞান অর্জনের ধরন আমূলভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।
এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি, গবেষণাভিত্তিক সমাধান এবং আন্তঃবিষয়ক দক্ষতা। গবেষণা এখন আর শুধু উচ্চশিক্ষা বা পিএইচডি পর্যায়ের বিষয় নয় কিংবা শুধু গবেষণা কেন্দ্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি হওয়া উচিত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর শেখার একটি আবশ্যিক অংশ। এটি শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রশ্ন নয়; বরং এক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর– যা নেতৃত্ব, নীতিনির্ধারণ ও চিন্তাধারায় মৌলিক পরিবর্তনের আহ্বান জানায়। এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে– উদ্ভাবনের পথে হাঁটবে, নাকি পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি নেবে।

এই বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে শিক্ষানীতি, শিল্পনীতি ও গবেষণা কাঠামোয় সময়োপযোগী সংস্কার জরুরি। আমাদের প্রচলিত পাঠ্যক্রম এখনও মুখস্থনির্ভর– যেখানে সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা এবং আন্তঃবিষয়ক শিক্ষার বাস্তব চর্চা প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে শিল্প খাতের প্রয়োজন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মধ্যে এক গভীর ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এই ব্যবধান দূর করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণা ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে– যেখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ভিত নির্মাণ করা হবে।
যেসব দেশ আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা তাদের জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করছে। যেমন– দক্ষিণ কোরিয়া গবেষণায় ব্যয় করে জিডিপির ৪ শতাংশেরও বেশি, অথচ বাংলাদেশে এই হার ০.

৫ শতাংশের নিচে। এই পার্থক্য শুধু বাজেট নয়; এটি ভবিষ্যৎ ভাবনার, রাজনৈতিক সদিচ্ছার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির প্রতিফলন। গবেষণায় বিনিয়োগ না বাড়ালে বাংলাদেশ ভবিষ্যতের প্রযুক্তির কেবল ভোক্তা হয়েই থাকবে, স্রষ্টা হয়ে উঠতে পারবে না।

বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা এখনও পরীক্ষানির্ভর ও সনদকেন্দ্রিক। আউটকাম বেজড এডুকেশন (ওবিই) চালুর পরেও তা এখনও গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষায় পরিণত হয়নি। শিক্ষার্থীরা মুখস্থ নির্ভরতায় আবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, বিশ্লেষণী বা সমস্যাভিত্তিক চিন্তায় অভ্যস্ত হচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকে উৎসাহিত করার মতো পরিবেশ বা কাঠামো তৈরি করতে পারছে না। ফলে যে গবেষণাভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার কথা ছিল, তা থমকে আছে– যা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতায় অত্যন্ত জরুরি। এই সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, দলাদলি এবং দীর্ঘদিনের প্রাতিষ্ঠানিক অস্থিরতা। এ বাস্তবতা একুশ শতকের জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার পথে এক বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা, আন্তঃবিভাগীয় গবেষণা কেন্দ্র, বাস্তব সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা– সব মিলিয়ে একটি উদ্ভাবনবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকদের গবেষণার মেন্টর হিসেবে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে এবং পাঠ্যক্রমে সৃজনশীল চিন্তা, গবেষণা ও আন্তঃবিষয়ক সংযুক্তিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়ে উঠবে।
গবেষণাকে অবহেলা করলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে প্রযুক্তিনির্ভর কিন্তু উদ্ভাবনহীন একটি অর্থনীতি– যেখানে কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে, খাদ্য ও স্বাস্থ্য খাত অনিশ্চয়তায় পড়বে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ব। এখনই সময় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার, কারণ আগামী বাংলাদেশের ভিত আজকের সিদ্ধান্ত ও বিনিয়োগের ওপরই নির্ভর করছে। ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে তার মাশুল গুনতে হবে অনেক বেশি।

গবেষণাকে জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত করতে হবে। প্রয়োজন একটি সমন্বিত গবেষণা নীতিমালা– যেখানে থাকবে বিনিয়োগ কাঠামো, গবেষণার অগ্রাধিকার, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব ও টেকসই অর্থায়নের সুস্পষ্ট রূপরেখা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।
কাজেই আর দেরি নয়, বিশ্ব যখন উদ্ভাবনের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশকেও গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা, কার্যকর অংশীদারিত্ব ও সুপরিকল্পিত গবেষণা বিনিয়োগের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটতেই হবে। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত একটি উদ্ভাবনী জাতি গঠনের জন্য এ সিদ্ধান্ত আজই নিতে হবে।
 
এম এম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও
অধ্যাপক (অব.), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব স তবত য় ন র ভর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও

রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।

গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।

পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়। 

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো। 

ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।” 

তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।” 

আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”

রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”

গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।

গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।” 

উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।

ঢাকা/আমিরুল/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি ট্রাম্পের
  • মেসি বনাম ইয়ামাল: ফিনালিসিমার সময়-সূচি ঘোষণা
  • গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও