দেশে সংঘটিত বেশির ভাগ গুমের পেছনে পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) জড়িত ছিল। এমন তথ্য উঠে এসেছে গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছেন।

এ ছাড়া পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন ইউনিটের বিরুদ্ধে গুমে প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের বিরুদ্ধেও গুমে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ডিজিএফআই ও এনএসআই মূলত গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। আইনগতভাবে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করার এখতিয়ার তাদের নেই। অথচ এ সংস্থাগুলোর সদস্যরা যেভাবে আটক, অপহরণ ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, তা সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘনের শামিল। এটি দেশের আইনব্যবস্থায় সমান্তরাল অবৈধ শক্তি গড়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয়।

তদন্ত কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নিজ কার্যপরিধি বা দায়িত্বের সীমা এবং নিয়মনীতি (এসওপি) অমান্য করে অভিযান চালিয়েছে। এটিকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনটি গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিটি বাহিনীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করে তুলে ধরা হয়েছে।

পুলিশের ভূমিকা

বাংলাদেশ পুলিশের কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হয়। সংস্থাটি দেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও তদন্ত এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের মূল দায়িত্ব।

বাহিনীর বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিটের মধ্যে রয়েছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে পুলিশ বাহিনী বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে।

তবে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে (বিশেষত ২০০৯ সালের পর) পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, হেফাজতে নির্যাতন, মতপ্রকাশের অধিকার দমন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ বাড়তে থাকে।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে পুলিশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করে নিরপেক্ষ জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বদলে সরকারপন্থী ‘এনফোর্সার’ হিসেবে কাজ করে। সে সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা–কর্মীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়।

পুলিশের ‘ক্রসফায়ার’ নামে পরিচিত বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের আগে কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতো না। হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়টিও ছিল ব্যাপক। অনেক ভুক্তভোগী মারধর, বৈদ্যুতিক শক, পানিতে চুবিয়ে রাখা এবং অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতা জানান। যদিও ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধ আইন পাস করে তৎকালীন সরকার, কিন্তু বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এটির প্রয়োগ হয়েছে। অল্পসংখ্যক কর্মকর্তাকে এই আইনের আওতায় বিচার করা হয়েছে।

ছাত্র আন্দোলন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও দমন-পীড়ন চালায় পুলিশ। বিশেষত জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে পুলিশের ভূমিকা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।

বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্নমত দমনে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কিংবা প্রচার চালানোর মতো অস্পষ্ট অভিযোগে বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কমিশনের মতে, বহু রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সরকারের সমালোচকদের গুম করেছে পুলিশ। তাঁদের অনেককেই নির্যাতনের পর বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এসব ঘটনা ধারাবাহিকতা পুলিশের ভেতরে জবাবদিহির অভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যা সংবিধান অনুযায়ী নাগরিক সুরক্ষা ও আইনের শাসনের বিপরীত।

র‌্যাব: আইন রক্ষা বাহিনী থেকে দমনযন্ত্রে রূপান্তর

২০০৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি আধাসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে গঠিত হয় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সন্ত্রাসবাদ, মাদক চোরাচালান ও সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনের লক্ষ্যে এ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বর্তমানে র‌্যাবের অধীনে দেশব্যাপী মোট ১৫টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে। প্রতিটি ব্যাটালিয়নের অধীনে তিন থেকে চারটি ‘ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি’ (সিপিসি) কাজ করে। বাহিনীটি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১০টি কার্যকর শাখার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে অপারেশন, গোয়েন্দা, আইন ও গণমাধ্যম এবং বিমান শাখা অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (অপারেশন) অধীন এবং প্রশাসন ও অর্থ, যোগাযোগ ও এমআইএস, তদন্ত ও ফরেনসিক, প্রশিক্ষণ ও অভিযোজন এবং গবেষণা ও উন্নয়ন শাখাগুলো অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) অধীন কাজ করে।

র‌্যাবের প্রধান কার্যালয় ঢাকার কুর্মিটোলায় অবস্থিত। প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে র‌্যাব অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হতে থাকে।

তদন্ত কমিশন শত শত অভিযোগ পেয়েছে, যেখানে র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, র‌্যাবের হাতে আটক হওয়া অনেক ব্যক্তিকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে বা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। এতে বাহিনীটির আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়টি নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি হয়।

র‌্যাব গঠনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বাহিনীটিকে সন্ত্রাসবাদ দমন বাহিনী হিসেবে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু পরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনকারী ডেথ স্কোয়াডে পরিণত হয় র‌্যাব। বাহিনীটি শুরু থেকেই ব্যাপক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেছে। তবে তাদের কার্যক্রমে পর্যাপ্ত তদারকির অভাব থাকায় নির্যাতনের সুযোগ তৈরি করে দেয়।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে যুক্তরাজ্য প্রায় এক দশক আগে র‌্যাবকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগে র‌্যাব এবং বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সঙ্গে সমন্বয় করে গোপন অভিযান চালাত। এসব অভিযানে সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান দমনের নামে বহু অপহরণ ও গোপন স্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে আটকে রাখা হতো।

এ ধরনের অভিযানের জন্য সবচেয়ে সমালোচিত ছিল ‘টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন’ বা টিএফআই সেল, যা ঢাকার কুর্মিটোলায় র‌্যাব-১ সদর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত।

যদিও প্রকাশ্যে এটিকে একাধিক সংস্থার যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করা হতো, বাস্তবে এটি পরিচালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হতো র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সরাসরি তত্ত্বাবধানে।

টিএফআই সেলে হাজার হাজার মানুষকে দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস অন্ধকার কক্ষে চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় আটকে রাখা হতো। ৩৮টি সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, এ কেন্দ্রে বন্দীদের পিটিয়ে, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে, উল্টো করে ঝুলিয়ে, মাথা ঘুরিয়ে বা এমনকি শরীরের অঙ্গ ছিঁড়ে নির্যাতন করা হতো। শিশু ও মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরাও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি।

যদিও সেলটি পরিচালনায় সেনাসদস্যরাই মূলত নিয়োজিত ছিলেন, তবে পুলিশের সদস্যরাও এসব অভিযানে অংশ নিতেন।

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে র‌্যাব গোয়েন্দা বা স্থানীয় ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে সরাসরি অপহৃত বা ডিজিএফআইয়ের হেফাজত থেকে আনা ব্যক্তিদের এ সেলে রাখা হতো। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হতো, যাতে খোঁজ ও শনাক্তকরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

কমিশন এখনো প্রায় প্রতিদিনই নির্যাতনকেন্দ্রটি সম্পর্কে নতুন নতুন অভিযোগ পাচ্ছে, যা নির্যাতনের ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতার প্রমাণ দেয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর র‌্যাব বাহিনী সেলের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করতে সক্রিয় হয়। নির্যাতনের প্রমাণ মুছে ফেলতে সেলগুলোর গঠন বদলে বড় করা হয়, নির্যাতন কক্ষ ভেঙে ফেলা হয়, নজরদারি ক্যামেরা খুলে ফেলা হয় এবং ফরেনসিক প্রমাণ নষ্ট করতে মেঝের টাইলস পর্যন্ত খুঁড়ে ফেলা হয়। এটি ছিল প্রমাণ নষ্ট করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার অংশ।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ শুধু অপরাধ দমনের বাইরে যাওয়ার নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হওয়ারও। বিরোধী দল, মানবাধিকারকর্মী ও ভিন্নমতের মানুষদের ওপর দমন-পীড়নে র‌্যাবকে ব্যবহার করা হয়। অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, র‌্যাবের সদস্যরা জানতেন যে তাঁদের বিচার হবে না। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি তাঁদের বেপরোয়া করে তোলে বলে অভিযোগ তাঁদের।

এর ফলে জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ভয় জন্মায়, মানুষ বিচার পাওয়ার আশা হারায় এবং গোটা ব্যবস্থায় জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

সরকার পরিবর্তনের পরও র‌্যাব নামের বাহিনীটি এখনো টিকে আছে। তবে র‌্যাবের অতীত কার্যক্রম এভং জনমনে তৈরি করা ভয় ও অনাস্থা এখনো গণতান্ত্রিক সংস্কারের পথে বড় বাধা হয়ে আছে।

কমিশন মনে করে, সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে হলে র‌্যাব বাহিনীটি পুরোপুরি বিলুপ্ত করা দরকার। এটি না হলে দায়মুক্তির চক্র বন্ধ হবে না, জন–আস্থা ফিরবে না এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়া সম্ভব হবে না।

এনএসআইয়ের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) একটি আধুনিক, জবাবদিহিমূলক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করে, তা নিশ্চিত করার জন্য এর যথেষ্ট আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন।

গুমসংক্রন্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনএসআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশের প্রধান বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে কাজ করে। দেশি–বিদেশি উভয় ধরনের গোয়েন্দা তথ্য এই সংস্থার আওতায় থাকবে।

এই সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং রাজনৈতিক ও নাশকতামূলক কার্যকলাপের ওপর নজরদারি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করে।

এটি সীমান্ত গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি পর্যবেক্ষণ করে। এনএসআই অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করে, যেমন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। এর ফলে অধিক্ষেত্রের মধ্যে ওভারল্যাপিং, অতিরিক্ত ব্যবহার এবং আন্তসংস্থাগত সংঘাত দেখা দেয়। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিকীকরণের কারণে এর কার্যকারিতা গুরুতর তদন্তের আওতায় এসেছে।

অভিযোগ থেকে জানা যায়, সংস্থাটি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির ওপর কঠোরভাবে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষণ এবং দমন করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

এনএসআই তার ক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা এবং তদারকিব্যবস্থা সংজ্ঞায়িত করে এমন একটি বিস্তৃত সংবিধানসম্মত আইন ছাড়াই কাজ করে। এতে স্বাধীন সংসদীয় বা বিচার বিভাগীয় তদারকির অভাব রয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণহীন কর্তৃত্ব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

কমিশন এনএসআইকে জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পেয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এটিকে নির্যাতন এবং অন্যান্য দুর্ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ করে, যেখানে এর কার্যক্রমের অস্বচ্ছতার কারণে ভুক্তভোগীদের আইনি আশ্রয় সীমিত।

যদিও এনএসআই জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সন্ত্রাসবাদ দমন এবং গোয়েন্দা প্রচেষ্টায় অবদান রেখেছে, তবুও এটি গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনীতিকরণ, স্বচ্ছতার অভাব, অপর্যাপ্ত তদারকি এবং গুরুতর মানবাধিকার উদ্বেগ।

সন্ত্রাসবাদ ও আন্তদেশীয় অপরাধ দমন (সিটিটিসি)

২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও আন্তদেশীয় অপরাধ (সিটিটিসি) ইউনিটকে সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ ও আন্তদেশীয় অপরাধমূলক কার্যকলাপ মোকাবিলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

এতে সাতটি বিশেষায়িত বিভাগ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ (সোয়াত), বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট, অবৈধ অস্ত্রবিরোধী ইউনিট, ক্যানাইন ইউনিট ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট।

সিটিটিসি উদীয়মান নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার দাবি করলেও এটি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মতো অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে যে অপব্যবহার ও দায়মুক্তি দিয়ে আসছে, তার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েছে।

এমনকি যখন তারা অন্যান্য সংস্থার তুলনায় অল্প সময়ের জন্য বেআইনিভাবে বন্দীদের আটক করে, তখনো সিটিটিসি কর্মীরা আইনি ব্যবস্থার কৌশলগত অপব্যবহারের মাধ্যমে গুরুতর ক্ষতি করে বলে জানা গেছে।

এই ইউনিট অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করার জন্য পরিচিত। যার ফলে ‘নির্দিষ্ট’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘আইনশৃঙ্খলা’ পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সন্ত্রাস দমনের নামে বিদেশি সরকার কর্তৃক সমর্থিত র‌্যাবের মতোই, সিটিটিসি আন্তর্জাতিক সমর্থন থেকে উপকৃত হয়েছে।

তবু র‌্যাবের মতো এই বিদেশি সমর্থন, তাদের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে ঝুঁকে পড়া রোধ করতে পারেনি।

সিটিটিসি জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও নির্বিচার আটকের মতো গুরুতর অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।

বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে মানবাধিকারকর্মীরা তথাকথিত সন্ত্রাসী বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এগুলো আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ন করেছে এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের অবিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

কমিশন এমন অসংখ্য ঘটনা নথিভুক্ত করেছে, যেখানে ব্যক্তিদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাঁদের যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের আড়ালে তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পরে ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছিল।

আটক ব্যক্তিরা তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বা জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের উদ্দেশ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন।

চাপের মুখে দেওয়া এ ধরনের স্বীকারোক্তি তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে।

কমিশনের সাক্ষাৎকার নেওয়া ভুক্তভোগীরা সিটিটিসির হেফাজতে থাকাকালীন মানসিক যন্ত্রণা ও শারীরিক নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছেন।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক তদারকির অভাবে যার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নির্যাতন চলতে থাকে।

সিটিটিসি যথাযথ প্রমাণ বা আইনি ভিত্তি ছাড়াই নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে। বিশেষ করে যাঁরা সরকারের বিরোধী বলে বিবেচিত রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ ছিল, তাঁদেরই গ্রেপ্তার করা হয়।

এই পদক্ষেপগুলো প্রকৃত নিরাপত্তা উদ্বেগের ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে মনে হচ্ছে। নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভুক্তভোগীরা তাঁদের বিনা অপরাধে আটক করার কথা জানিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা অবিচারের ইঙ্গিতই বহন করে।

সিটিটিসি অস্বচ্ছতার আড়ালে কাজ করেছে। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জনসাধারণকে কিছুই জানতে দেওয়া হয় না। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও অর্থপূর্ণ জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা অনুপস্থিত ছিল।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অপর ধ দমন ড জ এফআই র জন ত ক র জন য ব অন য ন য রক ষ ক র ব যবহ র ব যবস থ ব যবহ ত ক জ কর প রক শ পর চ ল ন র পর কর ছ ন গ র তর য ক তর ন র জন র পর ব আইন র সমর থ র আইন দমন র ধরন র সরক র ঘটন য় ইউন ট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

৯০ বছর বয়সী এই নারীর বিধবা ভাতার টাকা খোয়া গেল কীভাবে

মুঠাফোনে বিধবা ভাতার টাকা পেয়েছিলেন ৯০ বছর বয়সী আমেনা বেগম। আশা ছিল ঈদে নিজের জন্য নতুন কাপড় কিনবেন, নাতি-নাতনিদেরও কিছু দেবেন। ভালো কিছু খাবেন। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার দোকানে গিয়ে টাকা তুলতে গিয়ে জানলেন, যে মুঠোফোন নম্বরে টাকা এসেছে, সেখানে টাকা নেই, অন্য নম্বরে পাঠানো হয়ে গেছে।

দোকানির কাছে এ কথা শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন আমেনা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, তাঁর ঈদটাই শেষ হয়ে গেল।

আমেনা বেগম ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার তালসার গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ওই গ্রামের প্রয়াত আবদুল জলিলের স্ত্রী।

বয়স্ক এই নারী বলেন, ছোটবেলায় তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর চার ছেলে ও চার মেয়ে। স্বামী অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করতেন। ছেলেরাও এখন অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেন। মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। ছেলেমেয়েরা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তিনি ছেলেদের কাছে থাকেন। কিন্তু তাঁরাও হতদরিদ্র, নিজেরাই সংসার চালাতে হিমশিম খায়।

আমেনা বেগম বলেন, তিনি প্রথমবারের মতো বিধবা ভাতার টাকা পেয়েছেন। ২৯ মে তাঁর ছেলের মুঠোফোন নম্বরে ভাতার এক বছরের ৬ হাজার ৬০০ টাকা একসঙ্গে আসে। কিন্তু দোকানে গিয়ে শোনেন টাকা অন্য নম্বরে পাঠানো হয়ে গেছে।

দোকানির ভাষ্য, ওই বৃদ্ধার মুঠোফোন থেকে একটি মুঠোফোন নম্বরে ৩৯ টাকা রিচার্জ করা হয়। পরে ওই নম্বরে ৬ হাজার ৬০০ টাকা ‘সেন্ড মানি’ করা হয়।

মুঠোফোনটি ব্যবহার করেন ওই বৃদ্ধার ছেলে আবদুস সাত্তার। তিনি বুঝতে পারছেন না কীভাবে তাঁর ফোন থেকে ‘সেন্ড মানি’ হয়েছে। তিনি বলেন, তাঁরা গরিব মানুষ। মা ভাতার টাকা পেলে নিজের প্রয়োজনমতো খরচ করতেন। এবারও টাকা পেয়ে অনেক আশা করেছিলেন। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। কীভাবে টাকাটা খোয়া গেছে, এর সুষ্ঠু তদন্ত চান তিনি।

যে নম্বরে ওই বৃদ্ধার টাকা গেছে, সেই নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুশনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহারুজ্জামান সবুজ বলেন, ওই নারীকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে, এ ব্যাপারে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

কোটচাঁদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ