কী হতে পারে ইরানে ইসরায়েলি হামলার পরিণাম
Published: 13th, June 2025 GMT
গোয়েন্দাদের মূল্যায়নে যখন সতর্ক করা হয়, ইরান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে না হলেও কয়েক মাসের মধ্যে পারামাণবিক অস্ত্র উৎপাদন করতে পারবে, ঠিক তখনই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ইসরায়েল ব্যাপক মাত্রার বিমান হামলা চালায়। ইসরায়েলের বিমান হামলায় আক্রান্ত হয় নাতাঞ্জে; ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র। ইসরায়েলের হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি, সামরিক বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাগেরি এবং দু’জন খ্যাতিমান পরমাণু বিজ্ঞানী।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ‘ব্যাপক শাস্তি’র অঙ্গীকার করেছেন। পারস্য উপসাগর ঘিরে ইসরায়েলের পরমাণু কেন্দ্র ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোকে ইরান নিশানা করতে পারে। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের হামলার কয়েক ঘণ্টার পরই ইরান ১০০ ড্রোন হামলা করেছে। ইসরায়েলের হামলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য আবারও এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্মুখীন, যার প্রভাব আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে পড়তে বাধ্য।
পারমাণবিক আলোচনায় অচলাবস্থা
পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার কয়েক দফা অনিষ্পন্ন পারমাণবিক আলোচনার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি হামলা দেখা গেল। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুরোধে মধ্য এপ্রিলে এই আলোচনার শুরু হয়েছিল এবং কয়েক মাসের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছার প্রত্যাশা ছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেই আলোচনার বিরোধিতা করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে সামরিক অভিযানকেই প্রধান উপায় হিসেবে গ্রহণের কথা বলেন।
কয়েক সপ্তাহের পারামাণবিক আলোচনায় অচলাবস্থা তৈরি হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবির কারণে। তিনি দাবি করেন ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধে রাজি হতে হবে। এতে দেশটিকে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ মাত্রায় ৪০০ কেজি ইউরেনিয়ামের মজুত ধ্বংস করতে হবে। কারণ এই ইউরেনিয়ামের মাধ্যমে ইরান তার অস্ত্রের মান পরবর্তী ধাপে উন্নীত করতে পারে। তেহরান ট্রাম্পের এই দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, এটি ‘আপসের যোগ্য নয়’।
ইরানীয় ‘অক্টোপাস’ ধ্বংসে নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের অঙ্গীকার ছিল। অক্টোপাস মানে হলো, ইরানের আঞ্চলিক বড় নেটওয়ার্ক যেখানে যুক্ত– গাজার হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার সাবেক নেতা বাশার আল আসাদের শাসন এবং ইয়েমেনের হুতিরা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল হামলার পর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ইরানের এই নেটওয়ার্কের ক্ষমতা একের পর এক হ্রাস করছে। এখন নেতানিয়াহু সেই অক্টোপাসের মাথা কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন।
দূরত্ব বজায় রাখছেন ট্রাম্প
ইরানে সামরিক হামলায় অংশ নিতে নেতানিয়াহু ইতোপূর্বে ওয়াশিংটনকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা এতে সায় দেননি, বরং তারা মনে করেছেন, এতে যুক্ত হওয়ার মানে হলো মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ লাগানো। বিশেষত ইরাক যুদ্ধের ধাক্কা এবং আফগানিস্তানে ব্যর্থতার উপলব্ধি ছিল। ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক আধিপত্য
বজায় রাখার ক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখছেন।
প্রথমত, ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়কালে নেতানিয়াহুর জো বাইডেনকে উষ্ণ অভিনন্দন জানানোর বিষয়টি ট্রাম্প ভোলেননি। দ্বিতীয়ত, নেতানিয়াহুর সঙ্গে তিনি এ মুহূর্তে খুব ঘনিষ্ঠ হতে অনাগ্রহী এ জন্য, এতে তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন হবে। ট্রাম্প সম্প্রতি ইসরায়েলকে উপেক্ষা করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাত সফর করেন।
এই সপ্তাহে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই সতর্ক করেছেন, নেতানিয়াহু যেন এমন কিছু না করেন, যা ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচির আলোচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তিনি চুক্তিকে এমন পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, যেখানে নিজেকে শান্তির বার্তাবাহক হিসেবে প্রমাণ করতে পারেন, যদিও তিনি এ ক্ষেত্রে তা সেভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি। পারমাণবিক আলোচনা যেহেতু এক কানাগলিতে প্রবেশ করেছে, সে জন্য নেতানিয়াহু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এটাই আক্রমণের মোক্ষম সময়। ট্রাম্প প্রশাসন আক্রমণ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছে এবং বলেছে, এর সঙ্গে তারা যুক্ত নয়। এখন দেখতে হবে ইরান যদি
প্রতিশোধ নেয়, তবে ইসরায়েলকে বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসে কিনা।
বৃহত্তর যুদ্ধের মানে কী
ইসরায়েল দেখিয়েছে, ইরানের পরামাণু কর্মসূচি ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করতে তারা সক্ষম। যদিও ইরানের নেতৃত্ব অভ্যন্তরীণভাবেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা সংকট মোকাবিলা করছেন; ইরান তার আধুনিক মিসাইল ও ড্রোনের মাধ্যমে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনায় হামলা চালাতে সক্ষম। ইরান চাইলে হরমুজ প্রণালিও বন্ধ করে দিতে পারে, যে পথ দিয়ে বৈশ্বিক তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ২০-২৫ শতাংশ পরিবহন করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাশিয়া ও চীন উভয়ের সঙ্গেই ইরানের কৌশলগত সম্পর্ক আছে।
ইরান জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখালে ইসরায়েলের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সংঘাত সহজেই অনিয়ন্ত্রিত আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, যদিও কারও তাতে জয়ের সম্ভাবনা নেই। কারণ বড় যুদ্ধ কেবল সংকটে থাকা মধ্যপ্রাচ্যকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে না; একই সঙ্গে এটি ভঙ্গুর বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি যুদ্ধের ভার বহন করতে সক্ষম নয়। পারমাণবিক আলোচনার সময় সে জন্যই নেতানিয়াহু সরকারকে সংযত রাখার ব্যাপারে ট্রাম্প সচেষ্ট ছিলেন। তিনি কোনো চুক্তি হয় কিনা, তার অপেক্ষায় ছিলেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই চুক্তির ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট। পরবর্তী ধাপের আলোচনা সোমবার ওমানে হওয়ার কথা ছিল। ইরান বলেছে, তারা তাতে অংশ নেবে না এবং পরবর্তী নোটিশ পর্যন্ত সব আলোচনা বন্ধ থাকবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল, যার নাম ছিল দ্য জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্লাব অব অ্যাকশন। নেতানিয়াহু সেই চুক্তিকে ‘শতাব্দীর সবচেয়ে বাজে চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ট্রাম্প ২০১৮ সালে নেতানিয়াহুর প্ররোচনায় একতরফ চুক্তিটি বাতিল করেন।
এখন সেই নেতানিয়াহু ইরানে পরমাণু কর্মসূচি থামাতে সামরিক পথ বেছে নিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও বাকি বিশ্বকে অপেক্ষা করতে হবে এটা দেখার জন্য, দেরি হওয়ার আগেই আরেকটি যুদ্ধ বন্ধ করা যায় কীভাবে।
আমিন সাইকাল: ইমেরিটাস অধ্যাপক, মিডল ইস্টার্ন অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান স্টাডিজ, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিট এবং অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরের স্ট্র্যাটেজিক ফেলো; দ্য কনভার্সেশন থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ও য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র কর ছ ন পরম ণ
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন এম এন লারমা
মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাই দেশে প্রথম আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি প্রথম দেশে কাঠামোগতভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেন। একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এন লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
‘বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬ম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।
আলোচনা সভায় লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ১৯৫৫-৬৫ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘বাইনারি বিভাজন’ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশে সরকার। ‘বাইনারি’ মনস্তত্ত্বকে এখনো এই দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা ‘বাঙালি হেজিমনি’র বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের বয়ান বাঁচিয়ে রাখতে তৎকালে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।
জেএসএসের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছাত্র এম এন লারমার প্রতিবাদী জীবন শুরু হয়। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালেই এসব বিষয় নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন।
দীপায়ন খীসা বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে সংলাপ করেনি। আমরাও এই দেশের অংশ। তাহলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কেন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হলো না?’ তিনি বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদেরও অংশীদারত্ব আছে। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাদেরই ভুলে গেল এই সরকার।
সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি হয়ে যাও’ কথাটার পেছনে বাঙালি মুসলিমদের জাত্যভিমানের ব্যাপারটি রয়েছে। এম এন লারমা বাংলাদেশের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমীলা, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এম এন লারমাকে সম্মান জানিয়ে কবিতা পাঠের মাধ্যমে। কবিতা পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেই চাকমা ও লাল নিকিম বম। কবিতা আবৃত্তির পর এম এন লারমার জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, জেএসএসের কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা।