আলী আকবর খান: চন্দ্রাহত ওস্তাদের চন্দ্র নন্দন
Published: 18th, June 2025 GMT
১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রাম। জোছনা রাত। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সুর করছেন। সেদিন সরোদ না বাজিয়ে সানাইয়ে সুর করছিলেন। হঠাৎ পাশের ঘরে কান্নার শব্দ। নবজাতকের। রাবিয়া এসে খবর দিল, এক পুত্রসন্তানের জনক হয়েছেন ওস্তাদজি। সে থেকেই হয়তো চন্দ্রাহত ওস্তাদ আলী আকবর খান। সেতারবাদক বিলায়েত খাঁ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওস্তাদ আলী আকবর খানের এই জন্মমুহূর্ত; আর বলেছিলেন, আলী আকবর নিজেকে মনে করতেন চন্দ্রাহত।
বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। সংগীতজ্ঞ ও বিশাল হৃদয়ের মানুষ। ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ছাত্র রবিশঙ্করের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল কন্যা রওশন আরার। রবিশঙ্কর আবার ছিলেন আলী আকবরের বন্ধু। কিন্তু সেই বন্ধুর সঙ্গে তাঁর বোনের বিয়ে টেকেনি। শোনা যায়, জাতিদ্বন্দ্ব। ওস্তাদ আলী আকবর খানও এ রকম সাম্প্রদায়িকতা কম দেখেননি। ‘আকবর শিবরঞ্জনী’ রাগ সৃষ্টি করার পর তাঁকে শুনতে হয়েছিল, ‘মোগল রাজার নাম নিয়ে এত বন্দনা কেন।’
বিয়ের পর বোন রওশন আরার নাম হয়েছিল অন্নপূর্ণা দেবী—বিবাহবিচ্ছেদের পর আর বিয়েই করলেন না। স্টেজে উঠলেন না কত অনুরোধ করার পরও। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল ভাই ওস্তাদ আলী আকবর খানের। এ রকম আরও বেশ কিছু আক্ষেপ ছিল তাঁর। যেমন ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল জগতের প্রায় সবাই জানতেন, আনন্দবাজার পত্রিকায় ওস্তাদ আলী আকবর খান–সংক্রান্ত নিউজ বা লেখা কম ছাপা হতো। কলকাতায় থাকতেই তিনি প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন রাজস্থানের এক গায়িকা—রাজদুলারিকে। কলকাতায় পাম অ্যাভিনিউয়ে থাকতেন। সে সময় তাঁদের চার সন্তান হয়। বড় মেয়ে লাজবন্তি, তারপর দুই ছেলে রাজেশ ও দীনেশ, শেষের নাম অনিশা। কিন্তু সংসার টেকেনি। সেই রাজদুলারি বিবাহবিচ্ছেদের আগে বলেছিলেন, ‘আমাকে তুমি চার সন্তান ছাড়া কিছুই দাওনি। ভালোবেসেছিলে কি না, এ নিয়েও সন্দেহ জাগে মাঝেমধ্যে। আমি হয়তো প্রতিষ্ঠা পাব না তোমার মতো, তার কারণ তুমিই। তবে জেনো, তোমার প্রতিষ্ঠার একটি বাতি হয়ে আমি চিরকাল জ্বলব।’
আমেরিকায় গানের স্কুল করলেন—প্রথমে বার্কলেতে, পরে সেটি ক্যালিফোর্নিয়ার সান রাফায়েলে স্থানান্তর করেন। সে সময় সুইজারল্যান্ডেও আরেকটি শাখা-স্কুল করার জন্য তাঁর টাকা দরকার। কিন্তু ভারতের কোনো শিল্পপতি বা শিল্পানুরাগীই সাহায্য করলেন না।
অনেক দেরিতে পান ১৯৮৯ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ পুরস্কার। যদিও তারুণ্যেই ১৯৬৭ সালে পেয়েছিলেন ‘পদ্মভূষণ’। কিন্তু পদ্মবিভূষণের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০ বছরের বেশি। তখন তিনি সান রাফায়েলের বাসায় ডায়ালাইসিসের রোগী। বাসার লনে বিকেলে অল্প হাঁটেন আর সন্ধ্যা বা ভোরে তাঁর সৃষ্ট চন্দ্র নন্দন (মুনস্ট্রাক) বা গৌরীমঞ্জরী মনে করতে পারেন না। সেকি অসহায়ত্ব দৃষ্টিজুড়ে। অথচ এই তিনিই যখন বয়স ২০ প্রায় তখন যোধপুরের মহারাজার সভায় শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। সেখানে থাকাকালে তিনি ‘উস্তাদ’ খেতাব পান। যোধপুরের মহারাজ যাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন, সে জন্য নাকি তাঁকে সারা রাত বাজনা বাজিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ একটা বিমান দুর্ঘটনায় মহারাজের মৃত্যু হওয়ার পর তাঁকে যোধপুর ছাড়তে হয়। যোধপুর থেকে প্রথমে কিছুদিন লক্ষ্ণৌ রেডিয়োতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে থাকার পর তিনি চলে যান মুম্বাই (বোম্বে) এবং অবশেষে ১৯৫৫ সালে ইহুদি মেনুহিনের ডাকে পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়ার সান রাফায়েলের বাসায় বেড়াতে গেলেন বন্ধু রবিশঙ্কর। দুই বন্ধুতে আড্ডা হচ্ছিল। সেই আড্ডায় ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রকার তপন সিনহা। তপন সিনহা দেখলেন, আড্ডার মধ্যে হঠাৎ ওস্তাদ আলী আকবর খান কান্না করছেন। রবিশঙ্কর মাথা নুইয়ে বসে আছেন। জানতেও চাইছেন না বন্ধু কেন কাঁদছেন। তপন সিনহা কেন জানি সহ্য করতে পারলেন না, জানতে চাইলেন, ‘বাবা, (তাঁকে অনেকেই শ্রদ্ধাভরে বাবা ডাকতেন) কান্না করছেন কেন?’ এবার রবিশঙ্কর থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কান্না করলে জানতে চাইতে নেই কেন কান্না করছে।’ তপন সিনহা নিশ্চুপ। তাঁদের বন্ধুত্বকে খুব খাঁটি মনে হয়েছিল তাঁর। সেই অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পরও দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। দুজনে করেছেন যুগলবন্দী।
এই দুজন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য একসঙ্গে কাজও করেছেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান ও বব ডিলান। ১৯৭১-এর ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এ গানের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামের নতুন সুর। বাংলাদেশ ধুন যুগলবন্দী বাদনে রবিশঙ্করের সঙ্গে আলী আকবর খান সেদিন অসাধারণ পারঙ্গমতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের ধুনে মূলত জর্জ হ্যারিসন রবিশঙ্করের পরামর্শ গ্রহণ করে গানের শুরুটা করেছিলেন একটি ধীরগতির অবতরণিকা দিয়ে:
এলো একদিন বন্ধু আমার
চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার
বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা
দেশ তার আজ ধুঁকে ধুঁকে মরে.
কনসার্ট ফর বাংলাদেশের জন্যই পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিশেষভাবে ‘বাংলা ধুন’ নামের এই সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটা দিয়েই ওস্তাদ আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে তবলায় ওস্তাদ আল্লারাখা আর তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী।
পরে এ জন্য বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় কনসার্টে অংশ নেওয়া কিংবদন্তি সরোদশিল্পীকে। সেখানে উপস্থিত হয়ে বাবার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁর বড় ছেলে ও বিশিষ্ট শিল্পী ওস্তাদ আশীষ খান। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা, বাংলাদেশের গল্প করতেন। হয়তো শিকড় ছিল ওখানেই বলে।’
শরীরের প্রতি খুব একটা যত্ন নেননি। কারণ আছে। তাঁর তৃতীয় ও সর্বশেষ স্ত্রী মেরি ছিলেন আমেরিকান। মেরি তাঁকে মিউজিক স্কুল প্রতিষ্ঠায় অনেক সাহায্য করলেও পরে দূরত্ব বেড়েছিল। কারণ, তিনি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নিয়েই ঘোরগ্রস্ত থাকতেন। পশ্চিমাদের কাছে ভারতীয় সংগীত-সুরকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইতেন। মেরি চাইতেন পুব আর পশ্চিমের মিলন হোক অন্তত সুরে। কিন্তু সেটা খুব একটা বেশি আনুষ্ঠানিকভাবে হয়ে উঠছিল না। মেরি মাদকাসক্ত ছিলেন। আলাদা থাকতে শুরু করেন। আলী আকবরও তা–ই। তাঁর জীবন থেকে প্রথম স্ত্রী জুবাইদা, রাজদুলারি ও সবশেষে মেরি চলে যাওয়ায় প্রকৃত অর্থেই একা হয়ে যান। পরে সানফ্রান্সিসকোর বাসায় একাই কাটতে থাকে তাঁর জীবন। শচীন ভৌমিকের লেখা থেকে জানা যায়, সেই বাসায় একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন লতা মুঙ্গেশকর। এই সেই লতা, যখন খ্যাতির চরম শিখরে তখনো বিনা পারিশ্রমিকে ওস্তাদ আলী আকবার খানের একটি গান গেয়েছিলেন হিন্দি মুভি ‘আন্ধিয়া’র জন্য। ওস্তাদ আলী আকবর বার্নাদো বার্তোলুচির ‘লিটল বুদ্ধ’ বা সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ সিনেমার অসাধারণ সংগীত সৃষ্টি করেছেন। ‘আন্ধিয়া’র গান জনপ্রিয় হওয়ার পর লতা আমেরিকা যান। তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘দেশে (ভারতে) ফিরে চলুন, সেখানে কত আপনজন আপনার। এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে পড়ে থাকবেন কেন?’ উত্তরে নাকি আলী আকবর খান বলেছিলেন, ‘আপন কেউ না, আপনের মতো দেখায়, আপন থাকে সুরদৃশ্যে, চন্দ্র নন্দনে।’
ওস্তাদ আলী আকবর খান ‘চন্দ্র নন্দন’ নামে একটি রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। মালকোষ, চন্দ্রকোষ, নন্দকোষ ও কৌশি কানাড়া—চারটি রাগের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন রাগটি তিনি সৃষ্টি করেন।
২০০৯ সালে ১৮ জুন আমেরিকার নিজ বাসায় ক্লাস নিচ্ছিলেন। কিন্তু স্থির হয়ে ভালোভাবে বসতেও পারছিলেন না। সবাই ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। তিনি শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলছিলেন, ‘গান থামিয়ে দিয়ো না, গানই ধর্ম।’ ইয়েমেন থেকে আসা ইমন আর কল্যাণী থেকে আসা কল্যাণ মিলে হয়ে যায় ‘ইমনকল্যাণ’। এসব কথা বলার সময় কে বুঝবে যে তাঁর হাতে সময় কম। তিনি শেষ কথা বলেন, ‘গান গাওয়া বন্ধ কোরো না...।’ গান চলছে। এরই মধ্যে তিনি চিরতরে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আকবর খ ন কর ছ ল ন বল ছ ল ন কনস র ট হয় ছ ল আম র ক র জন য প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
আলী আকবর খান: চন্দ্রাহত ওস্তাদের চন্দ্র নন্দন
১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রাম। জোছনা রাত। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সুর করছেন। সেদিন সরোদ না বাজিয়ে সানাইয়ে সুর করছিলেন। হঠাৎ পাশের ঘরে কান্নার শব্দ। নবজাতকের। রাবিয়া এসে খবর দিল, এক পুত্রসন্তানের জনক হয়েছেন ওস্তাদজি। সে থেকেই হয়তো চন্দ্রাহত ওস্তাদ আলী আকবর খান। সেতারবাদক বিলায়েত খাঁ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওস্তাদ আলী আকবর খানের এই জন্মমুহূর্ত; আর বলেছিলেন, আলী আকবর নিজেকে মনে করতেন চন্দ্রাহত।
বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। সংগীতজ্ঞ ও বিশাল হৃদয়ের মানুষ। ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর ছাত্র রবিশঙ্করের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছিল কন্যা রওশন আরার। রবিশঙ্কর আবার ছিলেন আলী আকবরের বন্ধু। কিন্তু সেই বন্ধুর সঙ্গে তাঁর বোনের বিয়ে টেকেনি। শোনা যায়, জাতিদ্বন্দ্ব। ওস্তাদ আলী আকবর খানও এ রকম সাম্প্রদায়িকতা কম দেখেননি। ‘আকবর শিবরঞ্জনী’ রাগ সৃষ্টি করার পর তাঁকে শুনতে হয়েছিল, ‘মোগল রাজার নাম নিয়ে এত বন্দনা কেন।’
বিয়ের পর বোন রওশন আরার নাম হয়েছিল অন্নপূর্ণা দেবী—বিবাহবিচ্ছেদের পর আর বিয়েই করলেন না। স্টেজে উঠলেন না কত অনুরোধ করার পরও। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল ভাই ওস্তাদ আলী আকবর খানের। এ রকম আরও বেশ কিছু আক্ষেপ ছিল তাঁর। যেমন ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল জগতের প্রায় সবাই জানতেন, আনন্দবাজার পত্রিকায় ওস্তাদ আলী আকবর খান–সংক্রান্ত নিউজ বা লেখা কম ছাপা হতো। কলকাতায় থাকতেই তিনি প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন রাজস্থানের এক গায়িকা—রাজদুলারিকে। কলকাতায় পাম অ্যাভিনিউয়ে থাকতেন। সে সময় তাঁদের চার সন্তান হয়। বড় মেয়ে লাজবন্তি, তারপর দুই ছেলে রাজেশ ও দীনেশ, শেষের নাম অনিশা। কিন্তু সংসার টেকেনি। সেই রাজদুলারি বিবাহবিচ্ছেদের আগে বলেছিলেন, ‘আমাকে তুমি চার সন্তান ছাড়া কিছুই দাওনি। ভালোবেসেছিলে কি না, এ নিয়েও সন্দেহ জাগে মাঝেমধ্যে। আমি হয়তো প্রতিষ্ঠা পাব না তোমার মতো, তার কারণ তুমিই। তবে জেনো, তোমার প্রতিষ্ঠার একটি বাতি হয়ে আমি চিরকাল জ্বলব।’
আমেরিকায় গানের স্কুল করলেন—প্রথমে বার্কলেতে, পরে সেটি ক্যালিফোর্নিয়ার সান রাফায়েলে স্থানান্তর করেন। সে সময় সুইজারল্যান্ডেও আরেকটি শাখা-স্কুল করার জন্য তাঁর টাকা দরকার। কিন্তু ভারতের কোনো শিল্পপতি বা শিল্পানুরাগীই সাহায্য করলেন না।
অনেক দেরিতে পান ১৯৮৯ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ পুরস্কার। যদিও তারুণ্যেই ১৯৬৭ সালে পেয়েছিলেন ‘পদ্মভূষণ’। কিন্তু পদ্মবিভূষণের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ২০ বছরের বেশি। তখন তিনি সান রাফায়েলের বাসায় ডায়ালাইসিসের রোগী। বাসার লনে বিকেলে অল্প হাঁটেন আর সন্ধ্যা বা ভোরে তাঁর সৃষ্ট চন্দ্র নন্দন (মুনস্ট্রাক) বা গৌরীমঞ্জরী মনে করতে পারেন না। সেকি অসহায়ত্ব দৃষ্টিজুড়ে। অথচ এই তিনিই যখন বয়স ২০ প্রায় তখন যোধপুরের মহারাজার সভায় শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। সেখানে থাকাকালে তিনি ‘উস্তাদ’ খেতাব পান। যোধপুরের মহারাজ যাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন, সে জন্য নাকি তাঁকে সারা রাত বাজনা বাজিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ একটা বিমান দুর্ঘটনায় মহারাজের মৃত্যু হওয়ার পর তাঁকে যোধপুর ছাড়তে হয়। যোধপুর থেকে প্রথমে কিছুদিন লক্ষ্ণৌ রেডিয়োতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে থাকার পর তিনি চলে যান মুম্বাই (বোম্বে) এবং অবশেষে ১৯৫৫ সালে ইহুদি মেনুহিনের ডাকে পাড়ি দেন যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়ার সান রাফায়েলের বাসায় বেড়াতে গেলেন বন্ধু রবিশঙ্কর। দুই বন্ধুতে আড্ডা হচ্ছিল। সেই আড্ডায় ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রকার তপন সিনহা। তপন সিনহা দেখলেন, আড্ডার মধ্যে হঠাৎ ওস্তাদ আলী আকবর খান কান্না করছেন। রবিশঙ্কর মাথা নুইয়ে বসে আছেন। জানতেও চাইছেন না বন্ধু কেন কাঁদছেন। তপন সিনহা কেন জানি সহ্য করতে পারলেন না, জানতে চাইলেন, ‘বাবা, (তাঁকে অনেকেই শ্রদ্ধাভরে বাবা ডাকতেন) কান্না করছেন কেন?’ এবার রবিশঙ্কর থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কান্না করলে জানতে চাইতে নেই কেন কান্না করছে।’ তপন সিনহা নিশ্চুপ। তাঁদের বন্ধুত্বকে খুব খাঁটি মনে হয়েছিল তাঁর। সেই অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পরও দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। দুজনে করেছেন যুগলবন্দী।
এই দুজন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য একসঙ্গে কাজও করেছেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খান ও বব ডিলান। ১৯৭১-এর ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এ গানের জন্য তৈরি হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামের নতুন সুর। বাংলাদেশ ধুন যুগলবন্দী বাদনে রবিশঙ্করের সঙ্গে আলী আকবর খান সেদিন অসাধারণ পারঙ্গমতা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের ধুনে মূলত জর্জ হ্যারিসন রবিশঙ্করের পরামর্শ গ্রহণ করে গানের শুরুটা করেছিলেন একটি ধীরগতির অবতরণিকা দিয়ে:
এলো একদিন বন্ধু আমার
চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার
বলে গেল, চাই শুধু সহায়তা
দেশ তার আজ ধুঁকে ধুঁকে মরে...
কনসার্ট ফর বাংলাদেশের জন্যই পণ্ডিত রবিশঙ্কর বিশেষভাবে ‘বাংলা ধুন’ নামের এই সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটা দিয়েই ওস্তাদ আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে তবলায় ওস্তাদ আল্লারাখা আর তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী।
পরে এ জন্য বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় কনসার্টে অংশ নেওয়া কিংবদন্তি সরোদশিল্পীকে। সেখানে উপস্থিত হয়ে বাবার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তাঁর বড় ছেলে ও বিশিষ্ট শিল্পী ওস্তাদ আশীষ খান। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা, বাংলাদেশের গল্প করতেন। হয়তো শিকড় ছিল ওখানেই বলে।’
শরীরের প্রতি খুব একটা যত্ন নেননি। কারণ আছে। তাঁর তৃতীয় ও সর্বশেষ স্ত্রী মেরি ছিলেন আমেরিকান। মেরি তাঁকে মিউজিক স্কুল প্রতিষ্ঠায় অনেক সাহায্য করলেও পরে দূরত্ব বেড়েছিল। কারণ, তিনি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল নিয়েই ঘোরগ্রস্ত থাকতেন। পশ্চিমাদের কাছে ভারতীয় সংগীত-সুরকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইতেন। মেরি চাইতেন পুব আর পশ্চিমের মিলন হোক অন্তত সুরে। কিন্তু সেটা খুব একটা বেশি আনুষ্ঠানিকভাবে হয়ে উঠছিল না। মেরি মাদকাসক্ত ছিলেন। আলাদা থাকতে শুরু করেন। আলী আকবরও তা–ই। তাঁর জীবন থেকে প্রথম স্ত্রী জুবাইদা, রাজদুলারি ও সবশেষে মেরি চলে যাওয়ায় প্রকৃত অর্থেই একা হয়ে যান। পরে সানফ্রান্সিসকোর বাসায় একাই কাটতে থাকে তাঁর জীবন। শচীন ভৌমিকের লেখা থেকে জানা যায়, সেই বাসায় একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন লতা মুঙ্গেশকর। এই সেই লতা, যখন খ্যাতির চরম শিখরে তখনো বিনা পারিশ্রমিকে ওস্তাদ আলী আকবার খানের একটি গান গেয়েছিলেন হিন্দি মুভি ‘আন্ধিয়া’র জন্য। ওস্তাদ আলী আকবর বার্নাদো বার্তোলুচির ‘লিটল বুদ্ধ’ বা সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ সিনেমার অসাধারণ সংগীত সৃষ্টি করেছেন। ‘আন্ধিয়া’র গান জনপ্রিয় হওয়ার পর লতা আমেরিকা যান। তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘দেশে (ভারতে) ফিরে চলুন, সেখানে কত আপনজন আপনার। এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে পড়ে থাকবেন কেন?’ উত্তরে নাকি আলী আকবর খান বলেছিলেন, ‘আপন কেউ না, আপনের মতো দেখায়, আপন থাকে সুরদৃশ্যে, চন্দ্র নন্দনে।’
ওস্তাদ আলী আকবর খান ‘চন্দ্র নন্দন’ নামে একটি রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। মালকোষ, চন্দ্রকোষ, নন্দকোষ ও কৌশি কানাড়া—চারটি রাগের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন রাগটি তিনি সৃষ্টি করেন।
২০০৯ সালে ১৮ জুন আমেরিকার নিজ বাসায় ক্লাস নিচ্ছিলেন। কিন্তু স্থির হয়ে ভালোভাবে বসতেও পারছিলেন না। সবাই ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। তিনি শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলছিলেন, ‘গান থামিয়ে দিয়ো না, গানই ধর্ম।’ ইয়েমেন থেকে আসা ইমন আর কল্যাণী থেকে আসা কল্যাণ মিলে হয়ে যায় ‘ইমনকল্যাণ’। এসব কথা বলার সময় কে বুঝবে যে তাঁর হাতে সময় কম। তিনি শেষ কথা বলেন, ‘গান গাওয়া বন্ধ কোরো না...।’ গান চলছে। এরই মধ্যে তিনি চিরতরে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালেন।