ঢাকার ১৩ ওয়ার্ড, বাইরের চার এলাকা ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকিতে
Published: 19th, June 2025 GMT
ঢাকার বাইরে চার পৌর এলাকায় এডিস মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সম্প্রতি পাঁচটি পৌরসভা এলাকায় জরিপ করে চারটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পেয়েছে। এই চার পৌরসভা হলো– ঝিনাইদহ, মাগুরা, পিরোজপুর ও পটুয়াখালী। এসব এলাকাকে ডেঙ্গুর উচ্চঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল বুধবার আইইডিসিআর আয়োজিত ‘ডেঙ্গু রোগের বাহকের কীটতাত্ত্বিক জরিপ ২০২৪-২০২৫ অবহিতকরণ সভায়’ এ তথ্য জানানো হয়েছে। সভায় জানানো হয়, এডিস মশার উপস্থিতি জানতে গত মার্চে ঢাকার বাইরে তিন সিটি করপোরেশন ও পাঁচটি পৌরসভায় এ জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জরিপ করতে প্রতিটি এলাকায় ৯ ওয়ার্ডে ২১৪টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় জরিপ করা হয়। সভায় জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা.
জরিপে দেখা গেছে, ঝিনাইদহ পৌর এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ৬০ শতাংশ। এর পর মাগুরায় ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পিরোজপুরে ২০ শতাংশ ও পটুয়াখালীতে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ, কুষ্টিয়ায় ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তিন সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে চট্টগ্রামে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও বরিশালে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
পাঁচ পৌরসভার মধ্যে হাউস ইনডেক্স সবচেয়ে বেশি মাগুরায়। এই পৌর এলাকায় গড় হাউস ইনডেক্স ৩৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর পর ঝিনাইদহে ৩২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। পটুয়াখালীতে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। পিরোজপুরে ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও কুষ্টিয়ায় ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ।
তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার দুই সিটির ৩ হাজার ১৪৭টি বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ৪৬৩ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এ হিসেবে রাজধানীর ১৪ দশমিক ৭১ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার অস্তিত্ব রয়েছে। এবার বহুতল ভবনে ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ভবনে ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ, আধা পাকা ভবনে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ, পরিত্যক্ত ভবনে ২ দশমিক ৮ শতাংশ এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, ঢাকার দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর মধ্যে উত্তরের ওয়ার্ডগুলো হলো– ১২, ২, ৮, ৩৪, ১৩ ও ২২। আর দক্ষিণের ওয়ার্ডগুলো হলো– ৩১, ৪১, ৩, ৪৬, ৪৭, ৪ ও ২৩।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মঈনুল আহসান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা উপজেলায় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদ বলেন, জরিপের তথ্য আজই আমরা হাতে পেয়েছি। এ অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নেব। তিনি আরও বলেন, অর্থের অভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীদের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) করতে পারছি না। গেল বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ১২৪ রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হলেও মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করা যায়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, জনস্বাস্থ্যে জরুরি পরিস্থিতি যত দ্রুত সম্ভব মানুষকে জানাতে হবে। এতে মানুষ প্রাথমিকভাবে একটু ধাক্কা খেলেও প্রস্তুতি নিতে পারে। তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়– এই বিপদটা আসছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী আগামীতে ডেঙ্গু বাড়বে।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগাম প্রস্তুতি বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, চার জেলায় এডিসের লার্ভা বেশি পেয়েছে। এসব এলাকায় মশা নিধন কর্মসূচি নিতে পারে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগ। কীটতত্ত্ববিদ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ওষুধে পরিবর্তন আনতে পারেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনবে। তবে সচেতনতার জায়গায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। আগের মতো সবাইকে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইনড ক স এল ক য় র এল ক পর চ ল প রসভ দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
‘ফান্ড একদম জিরোতে’, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনায় টাকার অভাবের কথা বললেন স্বাস্থ্যের পরিচালক
অর্থের অভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীদের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গেল বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ১২৪ রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হলেও অর্থের অভাবে এসব মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করতে পারেনি সংস্থাটি। আজ বুধবার রাজধানীর মহাখালীতে আইইডিসিআর অডিটরিয়ামে আয়োজিত এক সভায় এ কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং দেশের আরও ৮টি জেলায় ডেঙ্গু রোগের বাহকের কীটতাত্ত্বিক জরিপের ফলাফল তুলে ধরতে সভাটির আয়োজন করে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। সভায় গেল বছরের নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত পরিচালিত জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইইডিসিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, ‘আমি আসার পর ডেথ রিভিউ শুরু করেছিলাম। গত বছর যাঁরা মারা গেছেন, তার মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ১২৪টা রোগীর ফাইল নিয়ে একটা কমিটি করেছিলাম। কমিটি করে আমরা অনেকগুলো মিটিং করে মোটামুটি একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েছিলাম যে কী কী কারণে মৃত্যু হচ্ছে, তো আর আমি আগাইতে পারি নাই। কারণ বুঝতে পারছেন, আমাকে যদি ৮-১০ জন লোকের একটা মিটিং করতে হয়, সেটা নিজের পকেট থেকে দিয়ে খুব বেশি কন্টিনিউ করা যায় না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আরও বলেন, প্রতিটি হাসপাতালের নিজস্ব কমিটি ডেথ রিভিউ করে। তিন বছর ধরে ডেথ রিভিউ হচ্ছে না। তবে মৃত রোগীদের মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী হাসপাতালগুলোতে ডেথ রিভিউ হচ্ছে বলে জানান তিনি। পাশাপাশি সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এর জন্য আলাদা কমিটি করা দরকার বলেও জানান তিনি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং দেশের আরও ৮টি জেলায় ডেঙ্গু রোগের বাহকের কীটতাত্ত্বিক জরিপ সম্পন্ন করে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও জরিপের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন এবং কুষ্টিয়া, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ ও মাগুরা পৌরসভা এলাকায়।
মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। যদি এর পরিমাণ ২০ বা এর বেশি হয়, তবে সেখানে ঘনত্ব আশঙ্কাজনক বলে বিবেচনা করা হয়।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ছয়টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা ২০–এর বেশি ছিল। এর মধ্যে ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ; ২, ৮ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ১৩ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ২০ শতাংশ।
পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ৩১ ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ; ৩, ৪৬ ও ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ৪ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ২০ শতাংশ এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম; মার্চে বরিশাল এবং বাকি এলাকাগুলোতে জরিপ পরিচালিত হয়েছে মে মাসে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পরিচালিত জরিপে সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে ফুলের টব ও ট্রেতে জমে থাকা পানিতে। জরিপে পাওয়া মোট লার্ভার ২৭ শতাংশই বসবাস করে এসব পানিতে। এ ছাড়া ২২ শতাংশ সিমেন্ট নির্মিত পানির ট্যাংকে, ২০ শতাংশ ফ্লোরে জমে থাকা পানিতে, ১৩ শতাংশ প্লাস্টিকের ড্রামে, ১১ শতাংশ লোহার পাইপে, ১০ শতাংশ প্লাস্টিকের পাত্রে এডিসের লার্ভা পেয়েছেন গবেষকেরা।
জেলা পর্যায়ে পাওয়া ফলাফলে সবচেয়ে বেশি মশার লার্ভা পাওয়া গেছে ঝিনাইদহ পৌরসভা এলাকায়। ২৭০টি বাসাবাড়ির ১৬২টিতেই লার্ভার উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকেরা। এরপর মাগুরায় ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পিরোজপুরে ২০ শতাংশ এবং পটুয়াখালীতে ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ এলাকায় মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। বাকি এলাকাগুলোতে মশার লার্ভা পাওয়া গেলেও তা তুলনামূলক কম।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে বহুতল ভবনে এবং বাকি এলাকাগুলোর একক বাসভবনের সব কটিতেই ৬০ শতাংশের বেশি মশার লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণার জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত এলাকাগুলোর ৩ হাজার ১৪৭টি বাসা বা বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কীটতাত্ত্বিক দল। এর মধ্যে মোট ৪৬৩টি বাসা বা বাড়িতে ডেঙ্গুর লার্ভা পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে ডেঙ্গু পজিটিভ ৪৬৩টি বাসা বা বাড়ির মধ্যে ৫৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ বহুতল (১২৬টি), নির্মাণাধীন ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ (৪২টি), একক স্থান ৯ দশমিক ৮ শতাংশ (২১টি), সেমি পাকা ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ (১৯টি) এবং খালি প্লট ২ দশমিক ৮ শতাংশ (৬টি) বলে উঠে এসেছে জরিপের ফলাফলে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস অ্যাজিপ্টাই মশা এবং ঢাকার বাইরে এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামক মশা এটি বেশি বহন করে।
সভায় জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন। সংকট সমাধানে জরিপের সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বহুতল ও নির্মাণাধীন বাড়ির সমস্যা সমাধানের জন্য, রিহ্যাব ও ফ্ল্যাটমালিকদের সমিতির মাধ্যমে কাজ করা দরকার। উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে বছরব্যাপী মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, যুবগোষ্ঠী ও অন্য অংশীদারদের নিয়ে দেশব্যাপী পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করার মতো কাজগুলো আমাদের করতে হবে।’
সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর বলেন, ‘এ সমস্যার সমাধান করা একটি সমন্বিত কাজ। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। গণসচেতনতা অনেক বেশি দরকার। বরগুনায় হঠাৎ রোগীর সংখ্যা বেড়েছে—এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার আমাদের দেশে।’