ফল চাষ কৃষির সম্ভাবনাময় খাত। দেশজুড়ে আম, পেয়ারা, লিচু, কলা, কাঁঠালসহ নানা মৌসুমি ও বারোমাসি ফলের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। তবে এর বিপণন, সংরক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি খাতে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এ খাতের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদুর রহমান

সমকাল: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ফল উৎপাদনের চিত্র কেমন?

সচিব: এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। দেশে ফল উৎপাদনের ধারা এক দশকে বেশ ইতিবাচক, বৃদ্ধির হার প্রায় ৪৪ শতাংশ। জাতিসংঘের  খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে বিশ্বে ফলের উৎপাদন বাড়ার সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ টন। মৌসুমি ফলের পাশাপাশি বারোমাসি ফল চাষকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। 

সমকাল: এই সফলতার পেছনের কারণ কী?

সচিব: কৃষক, নার্সারি মালিক, কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণকর্মী এবং সরকারের সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত চেষ্টার ফলে এসেছে এই অর্জন। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ৬২ প্রজাতির ফলের ১০৪টি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টার ২৫ প্রজাতির ফলের ৮৪টি উচ্চ ফলনশীল জাতসহ এসব ফলের দ্রুত প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি এবং প্রায় ১২ হাজার নার্সারি মালিকের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ফল উৎপাদন বাড়ার পেছনে অবদান রেখেছে। বেশ কিছু বিদেশি ফল বাংলাদেশে সফলভাবে চাষ করার প্রযুক্তিও উদ্ভাবিত হয়েছে।

সমকাল: সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হচ্ছে কোন কোন ফল।

সচিব: কলা, কাঁঠাল, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস–এসব ফল সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়। আম নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেশি হয়, লিচু দিনাজপুরে, পেয়ারা পিরোজপুর-ঝালকাঠি অঞ্চলে।  কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে অষ্টম ও পেঁয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন, তরমুজ ইত্যাদি। 

সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফল চাষে কি কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে?

সচিব: অসময়ে বেশি তাপমাত্রা, অসম বৃষ্টি, ঋতুর সময় পরিবর্তন– ফলের গুণগত মানে প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবনে গবেষণা জোরদার করছে সরকার। এখানে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কিছু অপ্রচলিত বিদেশি ফল যেমন– আঙ্গুর, খেজুর, ড্রাগন ফল, রাম্বুটান ইত্যাদি চাষের সম্ভাবনা বেড়েছে। 
 
সমকাল: ফলচাষিকে সবচেয়ে বেশি কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে?

সচিব: বাজারজাত আর ন্যায্য দাম পাওয়া– এ দুটিই প্রধান সমস্যা। অধিকাংশ ফলের বাজার মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় একসময় প্রচুর ফল বাজারে আসে, তখন দাম পড়ে যায়। হিমাগার বা রেফ্রিজারেটেড পরিবহন সুবিধা না থাকায় সংরক্ষণ ও বাজারজাতের সংকটের কারণে ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় বাড়ে। এ সমস্যা সমাধানে হিমাগার এবং রেফ্রিজারেটেড পরিবহন সুবিধা বাড়নোর চেষ্টা হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষকের পণ্য সরাসরি কৃষকের বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে ফল সংরক্ষণে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সংরক্ষণাগার তথা হিমাগারের যন্ত্রপাতি আমদানিতে বাজেটে দেওয়া হয়েছে শুল্ক সুবিধা। যেখানে ফল বেশি উৎপাদন হয়, সেখানে হিমাগার স্থাপনে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। 

সমকাল: ফল সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি কমাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

সচিব: ফলের ২৫-৩০% নষ্ট হয়, সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে বিশেষত পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্যাকেজিংয়ের অভাবে। তাই কৃষককে ফল সংগ্রহ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্যাকহাউস, সর্টিং-গ্রেডিং সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।

সমকাল: কী কী ফল রপ্তানি হচ্ছে এখন?

সচিব: আমরা এখন কাঁঠাল, আম, লেবু, ড্রাগন ফল, পেয়ারা, নারিকেলসহ প্রায় ৩০ ধরনের ফল রপ্তানি করছি। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ– জাপান, কানাডা, হংকং, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এসব ফল যাচ্ছে। রপ্তানি আয়ও ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাংলাদেশের আম বিশ্বের প্রায় ৩৬ দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এবার মৌসুমের শুরুতেই ২৫ দেশে ৬০০ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে। 

সমকাল: রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় বাধা কী?

সচিব: মাননিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রক্রিয়াজাত করা– এই দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। কৃষকরা চাষ জানেন, তবে রপ্তানিযোগ্য মানে 

পৌঁছাতে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণে উৎপাদন, সংগ্রহ, পরিবহন, প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, বিমান ভাড়া কমানো, রপ্তানি প্রক্রিয়ার ট্রিটমেন্ট ফ্যাসিলিটি তৈরি করা এবং সার্টিফিকেশন ব্যবস্থাপনার দিকগুলোতে আরও দক্ষতা দরকার। এখন ক্লাস্টারভিত্তিক রপ্তানি এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে। রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, রপ্তানি পণ্যের বিমান ভাড়া বেশি। উড়োজাহাজ ভাড়া কমাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ চলছে। এ ছাড়া ফল রপ্তানির সব বাধা দূর করার চেষ্টা হচ্ছে। 

সমকাল: কৃষকের জন্য ফলভিত্তিক কোনো আলাদা সহায়তা আছে কি? 

সচিব: হ্যাঁ, ফলচাষির প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ, মাঠ সহায়তা ও কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে, ফলের বাগান তৈরি এবং নতুন নতুন ফল চাষে কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া  হচ্ছে। ফলের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাতকরণে উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। এ জন্য কৃষি ঋণের ব্যবস্থা থাকবে। রাজধানীর গাবতলীতে আম ও অন্যান্য সতেজ কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে বাষ্প তাপ প্রয়োগ প্ল্যান্ট করা হচ্ছে। এতে হিট ও ওয়াটার প্লান্টও থাকছে। এখান থেকে সরাসরি ফল বিমানবন্দরে চলে যাবে। উত্তরায় বিএডিসির কোল্ড স্টোরেজের ছয়টি রুম আছে। সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স থাকার বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি হলে যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (জিএপি) অনুসরণ করে ফল চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। যেখানে ফল যাবে, সেসব দেশের নীতিমালা অনুযায়ী ফল চাষ করা হচ্ছে। এ জন্য পার্টনার প্রকল্প থেকে কৃষককে সব সহায়তা দেওয়া হবে। ২৫ বছরমেয়াদি মহাপরিকল্পনায়ও এ বিষয়গুলো থাকবে। 

এ ছাড়া বিজ্ঞানীদের ফলের স্থায়িত্বকাল বাড়ানোর বিষয়ে গবেষণা করার অনুরোধ করা হয়েছে। ফলের আদি দেশীয় স্বাদ বজায় রেখে অধিক উৎপাদনশীল ফলের জাত উদ্ভাবনেও বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। 

সমকাল: উদ্যোক্তাদের জন্য কী সুযোগ আছে?

সচিব: যারা ফল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং বা রপ্তানি চেইনে কাজ করতে চান, তাদের জন্য উত্তম কৃষিচর্চা অনুশীলনের প্রশিক্ষণ ও তা বাস্তবায়নে প্রণোদনা সহায়তাসহ এসএমই ঋণ সুবিধা, কৃষিঋণ ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ নীতিমালার আওতায় সহায়তার সুযোগ রয়েছে। জেলা পর্যায়ে ‘এগ্রোফুড হাব’ গড়ে তোলার কাজ চলমান। উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণে উদ্যোক্তাদের বিশেষ ইনকিউবেশন সুবিধা দেওয়া শুরু হয়েছে।  

সমকাল: ফল খাত নিয়ে আলাদা কোনো নীতিমালা আছে কী?

সচিব: জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফল উৎপাদন বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়ানোর রোডম্যাপের আওতায় ফল খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ২০ জেলায় রপ্তানিযোগ্য ফল চাষে বিশেষায়িত অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। 

সমকাল: সামনের পাঁচ বছরে ফল খাতকে কোথায় দেখতে চান?

সচিব: আমরা চাই, বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, রপ্তানিতে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। এ ছাড়া জনগণের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ফল বিশেষ ভূমিকা রাখবে, যা পর্যাপ্ত ফল উৎপাদন ও এর সুষম বণ্টনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি কৃষক যাতে ফল চাষ করে টেকসই জীবনযাপন করতে পারেন, সেটিই এই সরকারের মূল লক্ষ্য।

সমকাল: কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার বার্তা কী?

সচিব: ফল চাষ শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, এটি পুষ্টি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বড় খাত। জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে কৃষকদের ফল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি, মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজারমুখী চিন্তায় প্রস্তুত হতে হবে। সরকার সবসময় তাদের পাশে আছে। বছরজুড়ে মানসম্মত ফলের পর্যাপ্ত সরবরাহের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে ভোক্তার কাছে সহজলভ্য হবে। ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানো সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। আশা করা যায়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ফল প রক র য় জ ত ব যবস থ পর বহন র জন য পর য য় লক ষ য ফল চ ষ র ফল র স গ রহ সমক ল সবচ য় সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চিকুনগুনিয়ার ছোবল: সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে

ছোট্ট একটি পতঙ্গ মশা, কিন্তু মাঝেমধ্যে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীগুলোর মধ্যে মশা প্রথম অবস্থানে আছে। মশা একমাত্র প্রাণী, যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। বিবিসি নিউজের তথ্যমতে, প্রতিবছর পৃথিবীতে ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মশা। মশাবাহিত রোগের মধ্যে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা, ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্টনাইল ফিভার অন্যতম। তবে এ মুহূর্তে মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে এ বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছে। তারা হুঁশিয়ার করেছে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বছর পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল।

চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ের চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে গড়ে ৭০ থেকে ৭১ শতাংশ রোগীর দেহে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে, যা এই রোগের ভয়াবহতা ও বিস্তারের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।

নগরীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এপিক হেলথ কেয়ারে ১৮৫ জন রোগীর মধ্যে ১৫৩ জন (প্রায় ৮২%) চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে ১৩২ জনের মধ্যে ৬৫ (প্রায় ৪৯%) ও পার্কভিউ হাসপাতালে ৫৩ জন রোগীর মধ্যে ৪২ জনের (প্রায় ৭৯%) পরীক্ষায় ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।

এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, চট্টগ্রামে জ্বর নিয়ে আসা প্রত্যেক রোগীই এখন কার্যত চিকুনগুনিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবু সরকারি পর্যায়ে এখনো রোগ শনাক্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাব–সুবিধা না থাকায় প্রকৃত সংক্রমণের মাত্রা ও বিস্তৃতি বুঝতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। সময়মতো পরীক্ষা ও রোগনির্ণয় না হলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ বর্তমানে ভয়াবহ পর্যায়ে চলছে, যেখানে দ্রুত সরকারি পর্যায়ে রোগনির্ণয় ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, সাশ্রয়ী পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং তাৎক্ষণিক মশা দমন ও সচেতনতা কার্যক্রম প্রয়োজন। উপসর্গ যথাযথভাবে নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জনগণের সহায়তা ও প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা জোরদার করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে।

বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়ার প্রথম প্রাদুর্ভাব ধরা পড়ে ২০০৮ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলায়, যেখানে ৩২ জন আক্রান্ত হন। এরপর ২০০৯ সালে পাবনার আটঘরিয়া (সাঁথিয়া) এবং ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে রোগটি আবার দেখা যায়।

তবে ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে এই রোগের সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব ঘটে, বিশেষ করে ঢাকা শহর এবং আশপাশের এলাকায়। এই সময় লক্ষাধিক মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলেও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান অনুপস্থিত। তবে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন শত শত রোগী জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা ও দুর্বলতা নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ দ্রুত বাড়লেও সরকারি হাসপাতালগুলোয় এখনো রোগনির্ণয়ের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়নি। এ কারণে রোগ শনাক্তকরণ পুরোপুরি নির্ভর করছে বেসরকারি ল্যাব ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ওপর। এসব কেন্দ্রে রোগনির্ণয়ে খরচ গড়ে ৪ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ। অনেকেই আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে পরীক্ষা না করিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন শুধু উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে, যা রোগ শনাক্তকরণে ভুলের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। রোগ শনাক্ত না হলে সংক্রমণ ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার প্রধান বাহক এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিকটাস নামের মশা। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সাধারণত হঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর দেখা দেয় এবং এর সঙ্গে থাকে তীব্র অস্থি ও সন্ধি ব্যথা, যা কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে। অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, পেশিতে ব্যথা, শরীরে ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ, চোখে জ্বালা, বমি বমি ভাব ও দুর্বলতা। অনেক সময় রোগীর হাত-পা ফুলে যেতে পারে, বিশেষ করে বৃদ্ধাঙ্গুলির জয়েন্টে ব্যথা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়।

এসব উপসর্গ অনেকটাই ডেঙ্গুর সঙ্গে মিলে যায়, তবে চিকুনগুনিয়ায় জ্বরের পাশাপাশি সন্ধিব্যথা বেশি প্রকট হয় এবং তা সপ্তাহ বা মাসব্যাপী স্থায়ী হতে পারে। শিশু, বৃদ্ধ ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্য এই রোগ বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

হাসপাতালগুলোয় ভর্তি রোগীর চিকুনগুনিয়া শনাক্ত না হওয়ার কারণে সেখানে সাধারণ জ্বর হিসেবে বিবেচনা করে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এ কারণে রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে দীর্ঘমেয়াদি জয়েন্ট পেইন ও দুর্বলতার মতো জটিলতায় ভুগছেন। ঝুঁকিতে থাকছে হাসপাতাল বা এর আশপাশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা। সরকারি পর্যায়ে যদি দ্রুত সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা না হয়, তাহলে চিকুনগুনিয়ার প্রকৃত বিস্তার ধরা পড়বে না এবং নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগিদের সংখ্যাও বাড়ছে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চিকুনগুনিয়ার ছোবল: সতর্ক না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে
  • যেভাবে ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল পাকিস্তান