ফল উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়িয়ে কৃষকের সমৃদ্ধি চায় সরকার
Published: 19th, June 2025 GMT
ফল চাষ কৃষির সম্ভাবনাময় খাত। দেশজুড়ে আম, পেয়ারা, লিচু, কলা, কাঁঠালসহ নানা মৌসুমি ও বারোমাসি ফলের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। তবে এর বিপণন, সংরক্ষণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও রপ্তানি খাতে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এ খাতের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহিদুর রহমান
সমকাল: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ফল উৎপাদনের চিত্র কেমন?
সচিব: এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। দেশে ফল উৎপাদনের ধারা এক দশকে বেশ ইতিবাচক, বৃদ্ধির হার প্রায় ৪৪ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, এ মুহূর্তে বিশ্বে ফলের উৎপাদন বাড়ার সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফল উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ টন। মৌসুমি ফলের পাশাপাশি বারোমাসি ফল চাষকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
সমকাল: এই সফলতার পেছনের কারণ কী?
সচিব: কৃষক, নার্সারি মালিক, কৃষিবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণকর্মী এবং সরকারের সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত চেষ্টার ফলে এসেছে এই অর্জন। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ৬২ প্রজাতির ফলের ১০৪টি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টার ২৫ প্রজাতির ফলের ৮৪টি উচ্চ ফলনশীল জাতসহ এসব ফলের দ্রুত প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি এবং প্রায় ১২ হাজার নার্সারি মালিকের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ফল উৎপাদন বাড়ার পেছনে অবদান রেখেছে। বেশ কিছু বিদেশি ফল বাংলাদেশে সফলভাবে চাষ করার প্রযুক্তিও উদ্ভাবিত হয়েছে।
সমকাল: সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হচ্ছে কোন কোন ফল।
সচিব: কলা, কাঁঠাল, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস–এসব ফল সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়। আম নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেশি হয়, লিচু দিনাজপুরে, পেয়ারা পিরোজপুর-ঝালকাঠি অঞ্চলে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে অষ্টম ও পেঁয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আম, কাঁঠালের বাইরে মৌসুমি ফলের মধ্যে আছে জাম, লিচু, কুল, কামরাঙা, পেঁপে, বেল, লেবু, আনারস, আতা, সফেদা, লটকন, তরমুজ ইত্যাদি।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফল চাষে কি কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে?
সচিব: অসময়ে বেশি তাপমাত্রা, অসম বৃষ্টি, ঋতুর সময় পরিবর্তন– ফলের গুণগত মানে প্রভাব ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবনে গবেষণা জোরদার করছে সরকার। এখানে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কিছু অপ্রচলিত বিদেশি ফল যেমন– আঙ্গুর, খেজুর, ড্রাগন ফল, রাম্বুটান ইত্যাদি চাষের সম্ভাবনা বেড়েছে।
সমকাল: ফলচাষিকে সবচেয়ে বেশি কোন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে?
সচিব: বাজারজাত আর ন্যায্য দাম পাওয়া– এ দুটিই প্রধান সমস্যা। অধিকাংশ ফলের বাজার মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় একসময় প্রচুর ফল বাজারে আসে, তখন দাম পড়ে যায়। হিমাগার বা রেফ্রিজারেটেড পরিবহন সুবিধা না থাকায় সংরক্ষণ ও বাজারজাতের সংকটের কারণে ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় বাড়ে। এ সমস্যা সমাধানে হিমাগার এবং রেফ্রিজারেটেড পরিবহন সুবিধা বাড়নোর চেষ্টা হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষকের পণ্য সরাসরি কৃষকের বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে ফল সংরক্ষণে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সংরক্ষণাগার তথা হিমাগারের যন্ত্রপাতি আমদানিতে বাজেটে দেওয়া হয়েছে শুল্ক সুবিধা। যেখানে ফল বেশি উৎপাদন হয়, সেখানে হিমাগার স্থাপনে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
সমকাল: ফল সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি কমাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
সচিব: ফলের ২৫-৩০% নষ্ট হয়, সংগ্রহোত্তর পর্যায়ে বিশেষত পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্যাকেজিংয়ের অভাবে। তাই কৃষককে ফল সংগ্রহ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্যাকহাউস, সর্টিং-গ্রেডিং সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
সমকাল: কী কী ফল রপ্তানি হচ্ছে এখন?
সচিব: আমরা এখন কাঁঠাল, আম, লেবু, ড্রাগন ফল, পেয়ারা, নারিকেলসহ প্রায় ৩০ ধরনের ফল রপ্তানি করছি। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ– জাপান, কানাডা, হংকং, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এসব ফল যাচ্ছে। রপ্তানি আয়ও ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাংলাদেশের আম বিশ্বের প্রায় ৩৬ দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এবার মৌসুমের শুরুতেই ২৫ দেশে ৬০০ টন আম রপ্তানি করা হয়েছে।
সমকাল: রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় বাধা কী?
সচিব: মাননিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রক্রিয়াজাত করা– এই দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। কৃষকরা চাষ জানেন, তবে রপ্তানিযোগ্য মানে
পৌঁছাতে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণে উৎপাদন, সংগ্রহ, পরিবহন, প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, বিমান ভাড়া কমানো, রপ্তানি প্রক্রিয়ার ট্রিটমেন্ট ফ্যাসিলিটি তৈরি করা এবং সার্টিফিকেশন ব্যবস্থাপনার দিকগুলোতে আরও দক্ষতা দরকার। এখন ক্লাস্টারভিত্তিক রপ্তানি এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে। রপ্তানিকারকদের অভিযোগ, রপ্তানি পণ্যের বিমান ভাড়া বেশি। উড়োজাহাজ ভাড়া কমাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ চলছে। এ ছাড়া ফল রপ্তানির সব বাধা দূর করার চেষ্টা হচ্ছে।
সমকাল: কৃষকের জন্য ফলভিত্তিক কোনো আলাদা সহায়তা আছে কি?
সচিব: হ্যাঁ, ফলচাষির প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ, মাঠ সহায়তা ও কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে। বিশেষ করে, ফলের বাগান তৈরি এবং নতুন নতুন ফল চাষে কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ফলের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাতকরণে উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। এ জন্য কৃষি ঋণের ব্যবস্থা থাকবে। রাজধানীর গাবতলীতে আম ও অন্যান্য সতেজ কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে বাষ্প তাপ প্রয়োগ প্ল্যান্ট করা হচ্ছে। এতে হিট ও ওয়াটার প্লান্টও থাকছে। এখান থেকে সরাসরি ফল বিমানবন্দরে চলে যাবে। উত্তরায় বিএডিসির কোল্ড স্টোরেজের ছয়টি রুম আছে। সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স থাকার বিষয়ে আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি হলে যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (জিএপি) অনুসরণ করে ফল চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। যেখানে ফল যাবে, সেসব দেশের নীতিমালা অনুযায়ী ফল চাষ করা হচ্ছে। এ জন্য পার্টনার প্রকল্প থেকে কৃষককে সব সহায়তা দেওয়া হবে। ২৫ বছরমেয়াদি মহাপরিকল্পনায়ও এ বিষয়গুলো থাকবে।
এ ছাড়া বিজ্ঞানীদের ফলের স্থায়িত্বকাল বাড়ানোর বিষয়ে গবেষণা করার অনুরোধ করা হয়েছে। ফলের আদি দেশীয় স্বাদ বজায় রেখে অধিক উৎপাদনশীল ফলের জাত উদ্ভাবনেও বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন।
সমকাল: উদ্যোক্তাদের জন্য কী সুযোগ আছে?
সচিব: যারা ফল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং বা রপ্তানি চেইনে কাজ করতে চান, তাদের জন্য উত্তম কৃষিচর্চা অনুশীলনের প্রশিক্ষণ ও তা বাস্তবায়নে প্রণোদনা সহায়তাসহ এসএমই ঋণ সুবিধা, কৃষিঋণ ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ নীতিমালার আওতায় সহায়তার সুযোগ রয়েছে। জেলা পর্যায়ে ‘এগ্রোফুড হাব’ গড়ে তোলার কাজ চলমান। উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণে উদ্যোক্তাদের বিশেষ ইনকিউবেশন সুবিধা দেওয়া শুরু হয়েছে।
সমকাল: ফল খাত নিয়ে আলাদা কোনো নীতিমালা আছে কী?
সচিব: জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফল উৎপাদন বাড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়ানোর রোডম্যাপের আওতায় ফল খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ২০ জেলায় রপ্তানিযোগ্য ফল চাষে বিশেষায়িত অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
সমকাল: সামনের পাঁচ বছরে ফল খাতকে কোথায় দেখতে চান?
সচিব: আমরা চাই, বাংলাদেশ ফল উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, রপ্তানিতে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। এ ছাড়া জনগণের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ফল বিশেষ ভূমিকা রাখবে, যা পর্যাপ্ত ফল উৎপাদন ও এর সুষম বণ্টনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি কৃষক যাতে ফল চাষ করে টেকসই জীবনযাপন করতে পারেন, সেটিই এই সরকারের মূল লক্ষ্য।
সমকাল: কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার বার্তা কী?
সচিব: ফল চাষ শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, এটি পুষ্টি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বড় খাত। জনগণের পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে কৃষকদের ফল উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি, মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজারমুখী চিন্তায় প্রস্তুত হতে হবে। সরকার সবসময় তাদের পাশে আছে। বছরজুড়ে মানসম্মত ফলের পর্যাপ্ত সরবরাহের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে ভোক্তার কাছে সহজলভ্য হবে। ফলের সংগ্রহোত্তর অপচয় কমানো সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। আশা করা যায়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফল প রক র য় জ ত ব যবস থ পর বহন র জন য পর য য় লক ষ য ফল চ ষ র ফল র স গ রহ সমক ল সবচ য় সমস য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বরফ গলে মেরু এলাকায় নতুন বাস্তুতন্ত্রের খোঁজ
তাপপ্রবাহ, ওজোন গ্যাসের উপস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর দুই মেরু এলাকার বরফ গলে যাচ্ছে। তবে উত্তর মেরুর আর্কটিক সাগরের গলিত বরফ ভিন্ন ধরনের লুকানো বাস্তুতন্ত্র প্রকাশ করছে। সেখানে ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে পুষ্টিতে রূপান্তরিত করে শৈবালের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে দেখা গেছে। পুরু বরফের নিচে এই প্রক্রিয়া অসম্ভব বলে মনে করা হলেও এখন আর্কটিকের খাদ্যশৃঙ্খল ও বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন শোষণের জন্য এই প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন নতুন বাস্তুতন্ত্র জলবায়ুগত সুবিধা দেবে নাকি নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে আসবে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন।
আর্কটিক মহাসাগরকে দীর্ঘকাল ধরে হিমায়িত ও প্রাণহীন একটি সীমান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন এই অঞ্চলের সমুদ্রের বরফ গলতে শুরু করেছে, তখন পানির নিচ থেকে আশ্চর্যজনক নতুন নতুন সব তথ্য জানা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, গলিত বরফ আসলে শৈবালের বৃদ্ধি বাড়িয়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে পারে। এই শৈবালই মহাসাগরের খাদ্যশৃঙ্খলের ভিত্তি তৈরি করে। সেখানকার নতুন পরিবেশ আমাদের গ্রহের সংবেদনশীল জলবায়ু ভারসাম্যের জন্য সহায়ক হবে নাকি ক্ষতিকারক হবে, তা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
জার্মানির আলফ্রেড ওয়েগেনার ইনস্টিটিউট ও কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল আর্কটিক মহাসাগর সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া পুরু আর্কটিক বরফের নিচে ঘটতে পারে না। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে জীবনের সহায়ক রূপে রূপান্তর করে। এই রূপান্তরের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার জন্য সেখানকার পরিস্থিতিকে খুব চরম বলে মনে করা হতো। নতুন গবেষণা ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে। মধ্য আর্কটিক বরফের নিচে দেখা গেছে, নাইট্রোজেন ফিক্সেশন বা বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া কেবল ঘটছে তা নয়, বরং এটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বিস্তৃত হতে পারে। অন্যান্য সব সমুদ্রে সাধারণত সায়ানোব্যাকটেরিয়া দেখা গেলেও, আর্কটিকে নন-সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামে পরিচিত একটি ভিন্ন দলের উপস্থিতি দেখা যায়। ভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্রবীভূত জৈব পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে ও নাইট্রোজেন যৌগ মুক্ত করে যা শৈবালকে পুষ্টি জোগায়।
আর্কটিক এলাকাকে একসময় প্রাকৃতিক কার্যকলাপের জন্য খুব অনুর্বর বলে মনে করা হতো। গবেষণায় দেখা গেছে, গলে যাওয়া সমুদ্রের বরফের কিনারা বরাবর নাইট্রোজেনের বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে শক্তিশালী। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে সূর্যের আলো, পানি ও পুষ্টির উপাদান মিশে গেছে, যা ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল উভয়ের জন্যই আদর্শ পরিবেশ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আর্কটিকের নাইট্রোজেনচক্র নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী লিসা ডব্লিউ ভন ফ্রাইসেন বলেন, আর্কটিক মহাসাগরে সহজলভ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ অনুমান করা হয়নি এখনো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে শৈবাল উৎপাদনের সম্ভাবনা কেমন হবে তা এখনো জানা যায়নি। শৈবাল আর্কটিক খাদ্যশৃঙ্খলের জন্য অপরিহার্য। তারা আণুবীক্ষণিক ক্রাস্টেসিয়ানদের খাবার হিসেবে কাজ করে, যা পরবর্তী সময়ে ছোট মাছ এবং সিল ও তিমির মতো বড় শিকারি প্রাণীরা খায়। আরও শৈবাল এই শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে আর্কটিক সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
সাধারণভাবে শৈবাল কেবল সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য জোগায় না। তারা সালোকসংশ্লেষণের সময় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইডও শোষণ করে। যখন শৈবাল মরে যায়, তখন এই কার্বনের কিছু অংশ সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। বিজ্ঞানীরা প্রায়শই শৈবালকে প্রাকৃতিক কার্বন সিংক বা মহাসাগরের নিজস্ব ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হিসেবে বর্ণনা করেন। নতুন তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া যদি শৈবালের বৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলে, তবে আর্কটিক মহাসাগর আরও বেশি কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করতে পারবে। বিষয়টি একদিক থেকে জলবায়ুর জন্য সুসংবাদ বলে মনে করা হচ্ছে। শৈবালের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি বৈশ্বিক কার্বন মাত্রাকে সামান্য হলেও প্রশমিত করতে পারে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে জানিয়েছেন, বিষয়টি এত সরল নয়। সামুদ্রিক সিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যান্য পরিবেশগত পরিবর্তন এই ইতিবাচক প্রভাবকে দুর্বল করে দিতে পারে।
বিজ্ঞানী ল্যাসে রিম্যান বলেন, ফলাফল জলবায়ুর জন্য উপকারী হবে কি না, তা আমরা এখনো জানি না। তবে এটি স্পষ্ট যে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে আর্কটিক মহাসাগরের কী হবে, তা অনুমান করার সময় আমাদের নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াকে সমীকরণে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়তে থাকায়, আর্কটিক পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় চার গুণ দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তন কেবল বরফের ওপর নির্ভরশীল প্রজাতিদেরই নয়, বরং মহাসাগর কীভাবে কার্বন সঞ্চয় ও নির্গত করে, তারও পরিবর্তন ঘটায়। নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার ভূমিকা বোঝা গেলে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতের জলবায়ু ধরন সম্পর্কে আরও নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করছেন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া