শাকিল ও হাসিবুল বারইকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বন্ধুরা বসে গল্প করার সময় একজন অন্যজনকে গালি দেয়। এ নিয়ে প্রথমে তর্কাতর্কি, পরে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। লোকজন গিয়ে বুঝিয়ে ঝামেলা মিটমাট করে দেন। কিন্তু হাসিবুল এতে সন্তুষ্ট হয়নি। কারণ, সে সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে 
প্রভাবশালী। শাকিল দরিদ্র। প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করে হাসিবুল।
ঘটনার দু’দিন পর শাকিলের বাড়িতে যায় হাসিবুল। এ সময় বাড়ির বাইরে বসে মোবাইল ফোনে গেম খেলছিল শাকিল। তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু শরীর ভালো না থাকায় রাজি হয়নি শাকিল। সঙ্গে সঙ্গে ধারালো রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। চিৎকার করে তার মাকে ডাকতে শুরু করে শাকিল। কিন্তু মা আসার আগেই কোপানো শেষ করে চলে যায় হাসিবুল। দায়ের কোপে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকে সে। এ ঘটনায় বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়েছে শাকিলের। পঙ্গু শাকিল এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।
শেরপুরের নকলা উপজেলার বারইকান্দি দক্ষিণপাড়া গ্রামে এ হামলার ঘটনা ঘটে গত ১৫ জুন বিকেলে। ওই গ্রামের ভ্যানচালক আমির মিয়ার ছেলে শাকিল (১৬)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে। অভিযুক্ত হাসিবুল হাসান পাশের আদমপুর গ্রামের লালু বাদশার ছেলে।
প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে ভুক্তভোগী পরিবারের। দরিদ্র ভ্যানচালক বিচার চেয়ে ছেলের কাটা পা ব্যাগে ভর্তি করে নিয়ে গত বুধবার উপজেলা ও জেলার বিভিন্ন দপ্তরে যান। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। অবশেষে পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম আশ্বস্থ করলে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কাটা পা বাড়ির পাশে পুঁতে রাখা হয়।
কথা হয় ভুক্তভোগীর ফুফু ময়না বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, গত ১৫ জুন বিকেলে তাঁর ভাতিজা শাকিল বাড়ির বাইরে বসে মোবাইল ফোনে গেম খেলছিল। এ সময় হাসিবুল এসে তাকে বেড়াতে নিয়ে যেতে চায়। শাকিল রাজি হয়নি। এ সময় রামদা দিয়ে তাকে কোপাতে থাকে। তিনটি কোপ বাম পায়ের হাঁটুর ওপরে এমনভাবে লাগে যে, সব রগ কেটে যায়। পা ঝুলে পড়ে। তিনি বলেন, ‘ভাতিজা আমার মাটিতে পইরা গেলে পাষণ্ড হাতে ও শরীরে আরও বেশ কয়েকটা কোপ দিয়া চইলা যায়। এই সময় শাকিল চিৎকার কইরা কইতে থাকে, আম্মা আইলা না, আমারে মাইরা ফেলাইলো। এই শুইনা সবাই দৌড়াদৌড়ি করে বাইরে আইসা দেহি মাটিতে পইরা আছে। রক্তে ভাইসা গেছে।’ তাঁর ভাষ্য, দ্রুত শাকিলকে স্থানীয় হাসপাতাল নেওয়া হয়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে 
ভর্তি করা হয়। সেখানে গত মঙ্গলবার পা কেটে ফেলেন চিকিৎসক।
ভুক্তভোগীর বাবা আমির আলী বলেন, ‘আমি বিচার চাই। আমার ছেলের কোনো অপরাধ নাই। আমরা গরিব, তাই এইভাবে ছেলেডারে পঙ্গু কইরা দিল।’ তিনি বলেন, ‘পা নিয়া এসপি স্যারের কাছে গেছিলাম। তিনি আশ্বাস দিছেন বিচার করব।’
মামলার পর থেকে গা ঢাকা দিয়েছে আসামি পক্ষের লোকজন। অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমানের ভাষ্য, দু’জনের মধ্যে কথাকাটি হয়। পরে কুপিয়ে জখম করলে পা কেটে ফেলতে 
হয়। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামি ধরতে অভিযান চলছে।
 

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ এক বছরে ৩৩ গুণ বেড়েছে

ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে ৩৩ গুণ বেড়েছে। জমা অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৯ কোটি সুইস ফ্রাঁ (সুইজারল্যান্ডের মুদ্রা)। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের পর গত বছরই বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে সুইস ব্যাংকগুলোতে।

এ বছরের (২০২৪) ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। বিগত সরকারের সময়ের সুবিধাভোগীদের একটি বড় অংশ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠদের অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত হতে শুরু হয়েছে। এতে অনেকে বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তর করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১৪৯ টাকা। সেই হিসাবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ জমা ছিল, যা প্রায় ৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২৩ সালে ছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ। এক বছরে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৫৭ কোটি ১৮ লাখ ফ্রাঁ।

বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১৪৯ টাকা। সেই হিসাবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ জমা ছিল, যা প্রায় ৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা।

এসএনবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ ও ২০২৩ সালে পরপর দুই বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গিয়েছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠদের অর্থসম্পদ বাজেয়াপ্ত হতে শুরু হয়েছে। এতে অনেকে বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তর করে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণের কথা বলছেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে জমা হয়। বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকও বৈধ পথে দেশটির ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুইস ব্যাংকের শাখাগুলোতে সেসব দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও অর্থ জমা রাখেন, সেগুলোও সুইস ব্যাংকে জমা অর্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশ থেকে জমা হওয়া এসব অর্থ সে দেশের দায় হিসাবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থাকে।

সুইজারল্যান্ডের বাইরে এখন পাচারের অর্থ গোপন রাখার সুবিধা অন্য অনেক দেশে রয়েছে। ফলে ওই সব দেশেও পাচারের অর্থের বড় অংশ চলে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, একসময় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো পাচার হওয়া অর্থ জমা রাখার জন্য অন্যতম পছন্দের গন্তব্য ছিল। কারণ, তখন দেশটির ব্যাংকগুলো এসব তথ্য অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আদান–প্রদান করত না। অর্থ পাচারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় ছিল না সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই দৃশ্যপট অনেকটাই পাল্টে গেছে। আন্তর্জাতিক নানা চুক্তির কারণে এখন সুইজারল্যান্ড বিভিন্ন দেশের সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে। এ কারণে যাঁরা পাচারের অর্থ আগে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখতেন, তাঁরা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সুইজারল্যান্ডের বাইরে এখন পাচারের অর্থ গোপন রাখার সুবিধা অন্য অনেক দেশে রয়েছে। ফলে ওই সব দেশেও পাচারের অর্থের বড় অংশ চলে যাচ্ছে।

আমাদের হিসাবে বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৬ বিলিয়ন (১ হাজার ৬০০ কোটি) মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ পাচার হতো। সেই তুলনায় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকের জমা অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সুইজারল্যান্ড এখন অর্থ পাচারকারীদের কাছে খুব বেশি আকর্ষণীয় গন্তব্য নয়। বিকল্প হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশ গড়ে উঠেছে। যেখানে পাচারকারীদের জন্য সহজে ও নিরাপদে পাচারের সুযোগ রয়েছে। তাই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে হঠাৎ বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের হিসাবে বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৬ বিলিয়ন (১ হাজার ৬০০ কোটি) মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ পাচার হতো। সেই তুলনায় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকের জমা অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়।’

সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে শুধু যে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ বেড়েছে, তা নয়। ভারতের নাগরিকদের অর্থও বেড়েছে। ২০২৩ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ১০৩ কোটি ফ্রাঁ, গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৩৫০ কোটি সুইস ফ্রাঁ।

এ ক্ষেত্রে আমি তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় নিচ্ছি। প্রথমত, জমা অর্থের হিসাবের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কোনো পরিবর্তন করা হয়েছে কি না, যার কারণে অতীতে যেসব হিসাবকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, সেগুলোকে গত বছর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অর্থ স্থানান্তর হয়ে সুইস ব্যাংকে জমা হচ্ছে কি না। তৃতীয়ত, সরকার বদলের পর পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও সুইস ব্যাংকে একলাফে বাংলাদেশিদের এত অর্থ বৃদ্ধির ঘটনা পাচার বন্ধের নিশ্চয়তা দেয় না।’সিপিডি সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

এসএনবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে কম অর্থ ছিল ২০২৩ সালে। আর সর্বোচ্চ জমা ছিল ৮৭ কোটি ফ্রাঁ, ২০২১ সালে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমি তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় নিচ্ছি। প্রথমত, জমা অর্থের হিসাবের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কোনো পরিবর্তন করা হয়েছে কি না, যার কারণে অতীতে যেসব হিসাবকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, সেগুলোকে গত বছর বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অর্থ স্থানান্তর হয়ে সুইস ব্যাংকে জমা হচ্ছে কি না। তৃতীয়ত, সরকার বদলের পর পাচার রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও সুইস ব্যাংকে একলাফে বাংলাদেশিদের এত অর্থ বৃদ্ধির ঘটনা পাচার বন্ধের নিশ্চয়তা দেয় না।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ