সাবেক নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুলতানা আহমেদ লিপিসহ কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ১২ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি।

গতকাল রোববার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এক খুদে বার্তায় এ তথ্য জানান।

সুলতানা আহমেদ লিপি ছাড়া গ্রেপ্তার অন্য ব্যক্তিদের বিস্তারিত নাম-পরিচয় এখনো জানানো হয়নি।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্যের জন্য আর কতকাল অপেক্ষা

পথ চলতে চলতে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় কারও কারও সঙ্গে। একই প্রশ্ন শুনছি জন্মাবধি—কেমন আছ বা আছেন। একই উত্তর দিয়ে যাই—ভালো আছি। আসলে কি আমরা ভালো আছি? ভালো থাকার জো আছে? 

চারদিকে অভাব। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। একবার বাড়লে আর কমার নাম নেই। বেতন কমিশন, মহার্ঘ ভাতা—এসব আছে বড়জোর শতকরা ৫ ভাগ কর্মজীবীর জন্য। সংখ্যাটা আরও কম হতে পারে। অন্যদের চলছে কীভাবে? দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে রাষ্ট্র তাই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, এই প্রতিষ্ঠান তাঁদের উপকারে আসে না। 

রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে যাঁরা খাচ্ছেন, তাঁদের কাছে যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তার একটি হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনটা আসলে কী? রাষ্ট্রের ধারক-বাহকেরা বলে থাকেন, এটি হচ্ছে সর্বরোগের মহৌষধ। দেশে একটি নির্বাচিত সরকার থাকলে সমাজে স্থিতি আসে, শৃঙ্খলা থাকে, রাষ্ট্র চলে সুন্দরভাবে। চারদিকে শুধু শান্তি আর শান্তি! 

আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কি শতভাগ একমত হতে হবে০৫ জুলাই ২০২৫

১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমরা ১২টি নির্বাচন দেখেছি। যাঁরা নির্বাচনের ফসল ঘরে তুলেছেন, তাঁরা সবাই সেগুলোর প্রশংসা করেছেন। তাঁরা দাবি করেছেন, তাঁরা নাগরিকদের ম্যান্ডেট পেয়েছেন। তাঁদের কাছে ম্যান্ডেট হলো—যা খুশি করার স্বাধীনতা। এটা করতে গিয়ে তাঁরা সংবিধানের ওপর চড়াও হয়েছেন, কাটাছেঁড়া করে তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা যেটা করেছেন, তাঁরা সেটির পুনর্বহাল চান। 

সংবিধানের প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন একটি কথা না বললেই নয়। এটি নাকি একটি পবিত্র গ্রন্থ। আমাদের দেশের আনাচকানাচে অনেক ‘পবিত্র’ লুকিয়ে আছে। এই যেমন পবিত্র সংবিধান, সুপ্রিম কোর্টের পবিত্র অঙ্গন, পবিত্র বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, পবিত্র জাতীয় সংসদ। পবিত্রের ছড়াছড়ি। তারপরও কেন জানি মনে হয়, দেশটা একটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে; আর তার দখল নেওয়ার জন্য চলছে কামড়াকামড়ি।

গত ১২টি নির্বাচনের একটি সুরতহাল প্রতিবেদন করলে কেমন হয়? অনেকেই তো অনেক কিছুর জন্য শ্বেতপত্র দাবি করেন। নির্বাচন নিয়ে এ রকম একটি হতে পারত, হয়নি। যারা নির্বাচনে ‘জেতেন’, তাঁরা মনে করেন, এর চেয়ে ভালো নির্বাচন আর হয় না। জনগণের ম্যান্ডেট নাকি তাঁদের পেছনে। আসলে কী? আমরা যদি কাগজের পাতায় চোখ বোলাই আর মানুষের অন্তরের কথা শুনি, তাহলে দেখব, নির্বাচনগুলো ছিল দখলদারি আর লুটপাটের ইজারা স্বত্ব। তাই যদি না হয়, তাহলে আজ কেন আমরা নতুন বন্দোবস্তের কথা বলি? 

নতুন বন্দোবস্তের কবলে পড়েছে রাষ্ট্র, সংবিধান ও নির্বাচন। বন্দোবস্তটা কী, তা এখনো পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি। শহরের কিতাব পড়া মধ্যবিত্ত একরকম বোঝেন আর শহরের গরিব-গুর্বা আর গ্রামের চাষারা বোঝেন অন্য রকম। শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্য থেকে গজিয়ে ওঠা রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সুফি আর চিন্তকেরা যেভাবে ব্যাখ্যা করেন, তাতে মনে হয়, তাঁরাই সঠিক কথা বলছেন, মানবমুক্তির ধন্বন্তরির দাওয়াইটা তাঁদের হাতেই।

আরও পড়ুনসংস্কার প্রশ্নে বিএনপি যে ছাড় দিল, অন্যরা কি দিচ্ছে২৯ জুন ২০২৫

তাঁদের কথামতো চললেই দেশটা বেহেশতের বাগান হয়ে যাবে। এ নিয়ে তাঁদের আছে নানান ইশতেহার কিংবা ডিসকোর্স। এখন এই ইশতেহার ও ডিসকোর্স নিয়ে বেঁধে গেছে ফ্যাসাদ। কেউ কারোটা মানেন না। মীমাংসার জন্য বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে নাগরিকেরাই রায় দেবেন, কোনটা তাঁদের পছন্দ আর কোনটা অপছন্দ। 

নির্বাচনে যাঁদের সুবিধা হবে না, তাঁদের তূণেও আছে তির। তাঁরা বলেন, নির্বাচনে মুক্তি নেই। নির্বাচনে একটি দলের বদলে আরেকটি দল আসবে। এ হচ্ছে জ্বলন্ত উনুন থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়া। এসবের কী দরকার। এ মুহূর্তে দরকার একটি বিপ্লবী সরকার। 

১২টা নির্বাচনের পর একটি গণবিদ্রোহের দেখা মিলেছিল ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। কেউ কেউ এটাকেই বলছেন বিপ্লব। এই অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট নিয়েই নাকি ক্ষমতায় আছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি? যাঁরা এই বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এখন অনেক ফেরকা। তাঁরা শুধু পরস্পরের সমালোচনা করছেন না, রীতিমতো তুলাধোনা করছেন। একদা সহযাত্রী এখন ভয়ংকর শত্রু। বছর না পেরোতেই এই বিভাজন হয়ে গেল সাম্প্রতিক সময়ের ভয়াবহতম অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স। কেন এমন হলো?

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১৩ নম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সংস্কার, ঘোষণা আর সনদ নিয়ে বাহাস জারি রেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের জন্য নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনি ন্যূনতম কিছু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে ঐকমত্যও কম জরুরি নয়। সবাই সব বিষয়ে একমত হবেন—সেটি আশা করা যায় না।

সুযোগটা নিচ্ছে সেই গোষ্ঠী, যারা চব্বিশের গণবিদ্রোহে উৎখাত হয়েছিল। তারা এখন ক্রমে প্রকাশ্য হচ্ছে। কচ্ছপ যেমন খোলস থেকে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে চারপাশ দেখে পথ চলতে শুরু করে, অনেকটা সে রকম। তারা বলছে, ‘আগেই তো ভালো ছিলাম।’ 

সম্প্রতি দুটি ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে একটু আলোচনা হওয়া দরকার। কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টিতে একটি গোলমাল হলো। আমরা জানি, এটি এক ব্যক্তির পার্টি। চেয়ারম্যান যাঁকে খুশি তাঁকে দলের পদ দিতে পারেন, আবার ছুড়েও ফেলে দিতে পারেন। এত দিন পর কতিপয় নেতা সাবালক হলেন। তাঁরা চেয়ারম্যানের ক্ষমতা কাটছাঁটের আওয়াজ তুললেন। চেয়ারম্যান ঝামেলা ঝেড়ে ফেলার জন্য তাঁদের দল থেকে বাদ দিয়ে কমিটির পুনর্বিন্যাস করলেন। ‘বঞ্চিত’রা নতুন কমিটি বানিয়ে চেয়ারম্যানকে বহিষ্কার করলেন। তাঁদের সঙ্গে জুটলেন জাতীয় পার্টির মূলধারা থেকে অনেক আগেই ছিটকে পড়া জাপা নেতারা। 

আরও পড়ুনজামায়াতের প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত২০ ঘণ্টা আগে

জাতীয় পার্টির অফিস কোন পক্ষের দখলে থাকবে, তা নিয়ে বিরোধ ও উত্তেজনার কথা শোনা যায়। এরই মধ্যে একদল লোক ছুটে গেল জাতীয় পার্টির অফিস পানে। তাঁদের দাবি, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করতে হবে। দাবি জানাতে তাঁরা যমুনায় গেলেন না, আদালতে গেলেন না। গেলেন জাতীয় পার্টির দপ্তরের সামনে। এর মোজেজা আমি বুঝতে অক্ষম। সেখানে পিটাপিটি হলো। পুলিশ-মিলিটারি ছিল খুবই ত্যক্তবিরক্ত। তারা ইচ্ছেমতো পিটুনি দিল। এরপর জাতীয় পার্টির অফিসে আগুন দেওয়া হলো। 

দ্বিতীয় ঘটনাটির কেন্দ্রে আছে ‘ভাঙ্গা’। নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি জাতীয় সংসদের আসন পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে ভাঙ্গাকে ভেঙে দুটি ইউনিয়ন অন্য একটি সংসদীয় আসনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রতিবাদে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়। আর বিক্ষোভ মানেই ভাঙচুর আর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের মোড় আটকে লাখ লাখ মানুষকে কষ্ট দেওয়া। এখানে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট। যাঁরা স্থানীয় নেতা, তাঁরা তাঁদের এলাকাকে নিজেদের পারিবারিক তালুকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মনে করেন। ‘আমার এলাকা’—এই কনসেপ্ট খুবই প্রবল। সেখানে কেউ হাত দিক, এটা তাঁরা চান না। এ দেশের জাতীয়তাবাদ এখনো ইউনিয়ন, উপজেলা আর জেলার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। জাতীয় ঐক্য তো অনেক দূরের বিষয়। 

আরও পড়ুনরাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সংবিধান কোনো বাধা নয়২৩ অক্টোবর ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১৩ নম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সংস্কার, ঘোষণা আর সনদ নিয়ে বাহাস জারি রেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের জন্য নির্বাচন যেমন জরুরি, তেমনি ন্যূনতম কিছু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে ঐকমত্যও কম জরুরি নয়। সবাই সব বিষয়ে একমত হবেন—সেটি আশা করা যায় না। দলের ঘোষণাপত্রে শব্দের সামান্য হেরফের হলেই আমরা দল ভাগ করে ফেলি। তারপর আমরা ঐক্যজোট করি। এর চেয়ে বড় তামাশা আর কী হতে পারে! 

জাতীয় ঐকমত্যের মানে যদি হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা, সেটির জন্য হাজার বছর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সরকারের উচিত কিছু কিছু সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া। একটি রেজিমেন্টেড সরকার হলে সমস্যা হতো না।

মনে আছে, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৬১ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ জারি করেছিলেন। তখন ছিল সামরিক সরকার। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর সব দল সেটি গ্রহণ করেছিল। আইয়ুব খান জামায়াত নেতাদের ধরে ধরে জেলে পুরেছিলেন। আমার মতে, এটি ছিল উপমহাদেশের ওই সময়ের সবচেয়ে প্রগতিশীল আইন। এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। 

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ