১৯৭১ সালে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যেখানে নাগরিকদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অন্যতম সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলো প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু নির্বাচন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বহুলাংশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আবার কিছু নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত, যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় কিংবা সামরিক সরকারের অধীনে। 

সংবিধান থেকে তত্ত্বাধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বস্তুত নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে পড়েছিল এবং জবাবদিহির কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। ফলে দেশের সর্বস্তরে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। তাই এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।

আরো পড়ুন:

ফিরে দেখা আমাদের জুলাই বিপ্লব

জুলাই গণঅভ্যুত্থান: সিরাজগঞ্জে ৪ আগস্ট নিহত হয় ২৯ জন

আশার কথা হলো, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে এবং ৮ই আগস্ট তারিখে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু কেমন ছিল সরকারের প্রথম এক বছরের শাসন? 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল নির্বাচনব্যবস্থাসহ দেশের বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন, যাতে দেশে আর কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসতে না পারে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অচলাবস্থার অবসান হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও জবাবদিহির কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়। জনগণের আরও প্রত্যাশা ছিল জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার করা এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচ আয়োজন করা। সংক্ষেপে বলতে গেলে সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো, বিচার, সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন। 

প্রথমত, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামীদের বিচার শুরু হয়েছে। বর্তমানে বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে প্রধান অভিযুক্তদের বিচার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, স্থানীয় সরকার এবং নারী বিষয়ক আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।  

সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের কার্যক্রম শেষ করে ৭০০-এর অধিক সুপারিশ প্রণয়ন করে। এরপর উক্ত কমিশনগুলোর সুপারিশ সম্পর্কে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি জাতীয় সনদ প্রণয়নের জন্য ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ নামে নতুন একটি কমিশন গঠন করার কথা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলের মতামত সংগ্রহের জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন পাঁচটি স্বতন্ত্র স্প্রেডশিট তৈরি করে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব বলে স্প্রেডশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ৫টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে এ স্প্রেডশিটগুলো তৈরি করা হয় এবং ০৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে তা ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে তাদের মতামত প্রদানের জন্য প্রেরণ করা হয়। ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ২০টি।

স্প্রেডশিট প্রেরণের পর কিছু কিছু দল স্প্রেডশিটে মতামত দেওয়ার পাশাপাশি কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখিত সুপারিশের ব্যাপারে বিস্তারিত মন্তব্য ও বিশ্লেষণ জমা দেয়। স্প্রেডশিটে মতামত সংগ্রহের পরবর্তী ধাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করে। ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে ২০২৫ পর্যন্ত মোট ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের প্রথম পর্বের ওই বৈঠকগুলোতে অনেকগুলো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হয়। তবে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ পর্বে ঐকমত্য হয়নি। প্রথম পর্বের আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি বা দলগুলোর অবস্থান কাছাকাছি সেসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোকে নিয়ে ২ জুন ২০২৫ থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত উক্ত আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

শেষ দিনের আলোচনা শেষে গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি সংস্কার বিষয়ে দল ও জোটগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে এসবের কিছু কিছু ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট আছে। যে বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো হলো: ১. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০; ২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; ৩. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ; ৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান; ৫. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ: (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ; ৬. জরুরি অবস্থা ঘোষণা; ৭. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; ৮. সংবিধান সংশোধন; ৯. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান; ১০. নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত; ১১. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল; ১২. পুলিশ কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব; ১৩. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; ১৪. উচ্চকক্ষের গঠন ও এর সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার, ইত্যাদি; ১৫. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি; ১৬. তত্ত্বাবধায়ক সরকার; ১৭. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব; ১৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি; ১৯. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব।

ইতোমধ্যে জাতীয় সনদের একটি খসড়া রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত প্রদানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আশা করা যায়, বাস্তবায়নের ওপর আলোচনার পর খুব শীঘ্রই জাতীয় সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হবে। এছাড়া সংস্কার কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারি করা-সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়-সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। 

তৃতীয়ত, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে এবং এ জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৬০ হাজার সেনাসদস্য নির্বাচনী ডিউটিতে থাকবে বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এবং নির্বাচনকে ঘিরে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় আরো জোরদার করতে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য একটি মিডিয়া সেন্টার খোলার নির্দেশনা আদেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশন ‘ফুল গিয়ারে’ প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন এ এম এম নাসির উদ্দিন।

আমরা আশা করি, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্ধারিত সময়ে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এর মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটবে। আর সেটিই হবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা।

নেসার আমিন: লেখক ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর
 

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গণঅভ য ত থ ন গণত ন ত র ক ক ল ন সরক র ন র জন য অন ষ ঠ ত সরক র র জনগণ র প রস ত মন ত র আম দ র প রথম মত মত আগস ট র অবস

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ: সো ফার সো গুড

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা গত বৃহস্পতিবার শেষ হলো। ২৩ দিন ধরে এই আলোচনা চলে। প্রথম পর্বের আলোচনা ছিল এর চেয়েও দীর্ঘ। প্রায় দুই মাস ধরে চলা এই আলোচনা নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, এত দিনকার বৈঠকে ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৯টি বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে।

প্রায় ছয় মাস আগে ৫টি বিষয়ে মোট ১৬৬টি ইস্যুতে প্রথম পর্বের সংলাপ শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত ঐকমত্য কমিশন ইস্যুগুলো তৈরি করে। পুলিশ বিভাগেও সংস্কারের প্রশ্ন ছিল। তবে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় স্থান পায়নি।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিভাগীয়ভাবেই সংস্কারের এ প্রক্রিয়া চলবে। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে মোট ১৫টি বিষয়ের ওপর আলোচনা শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে কেবল অর্থনীতির ওপর যে টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, তাদের প্রস্তাবনা ও নীতিগুলো সাধারণের উদ্দেশে প্রকাশিত হয়।

আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত২১ জুন ২০২৫

এ কথা সত্য, সংস্কার বলতে আমরা প্রধানত রাজনৈতিক সংস্কারকে বুঝেছিলাম বা বুঝিয়েছিলাম। ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে লড়াই করতে হয়েছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। পরপর তিনটি নির্বাচনকে পুরোপুরি গিলে খাওয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে সমগ্র লড়াইয়ের দাবি কেন্দ্রীভূত হয়েছিল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে।

কিন্তু কীভাবে সেই নির্বাচন সম্ভব? ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তো ১৫ বছরে গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে ‘বিবস্ত্র’ করে ফেলেছিল। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে যে প্রশাসন ও পুলিশ দরকার, তা তার জনমুখী চরিত্র সম্পূর্ণ হারিয়ে জনগণ ও গণতন্ত্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। এখানেই এসেছিল সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা।

যেসব রাজনৈতিক দল এ লড়াই করেছিল, তারা মিলে সংস্কারের কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিল। আরেকটা কারণেও সংস্কারের কথা উঠেছিল। আন্দোলন করতে গিয়ে যখন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল, রক্ত ঝরছিল, অকাতরে মানুষ রক্ত দিচ্ছিল, তখনো প্রশ্ন উঠেছিল, জনতার এই রক্তধারা তার সফল অভিধায় পৌঁছাতে পারবে তো? ’৫২ থেকে এযাবৎকাল এই ভূখণ্ডের মানুষ কম রক্ত তো দেয়নি। সেই আত্মত্যাগ–রক্তদান যথাযথ মর্যাদা পেয়েছিল?

১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের রক্তাক্ত থাবা এখনো টিকে থাকা মানুষের বুকে তুষের আগুনের মতো জ্বলে। এ জন্যই সবাই এমন সংস্কার চেয়েছে, যাতে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে না পারে। সে জন্য কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ নয়, বরং গণতন্ত্র চালু রাখতে সংবিধানে বা দেশের প্রচলিত বিধানে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক বিধান চালুর দাবি উঠেছে।

এ ধরনের প্রশ্নের সরাসরি জবাব হয় না। প্রশ্নের পেছনে আবেগ যতখানি থাকে, তা দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং তা থেকে এ প্রশ্নের জবাবে যে নীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা উচিত, তা করা সম্ভব হয় না। তবে বর্তমান সময়ের জন্য আমি বলব, বিশেষ করে তরুণেরা শেষের দিকে এসে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল বলে এই প্রশ্নগুলো জীবন্ত ছিল।

এ কারণে প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে পাওয়া তথা এই মহান আত্মত্যাগকে তার যথাযথ অভিধায় নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন সব সময় সামনে ছিল। তবে আন্দোলনের বিজয় মানে সব সময় কেবল শত্রুপক্ষের পরাজয় নয়, বরং আন্দোলন যে লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, তার সফল বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে। আর এ জন্যই বিজয়ের পর কারা নেতৃত্ব তথা ক্ষমতা দখল করল, তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, সম্ভবত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউই পটপরিবর্তনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের আগমনকে বিবেচনায় নেননি। যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন বা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরাও শুরুতে এই পরিণতি সম্পর্কে সম্যকভাবে বুঝতে পারছিলেন না। ফলে শেষতক তারুণ্যের বুকে স্পন্দিত বিপ্লব ইউনূসের পরিপক্ব মস্তিষ্কপ্রসূত পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে মিলল না। এ নিয়েই এই বিশাল গণ–অভ্যুত্থানের কাঠামো গড়ে উঠল।

অতি সম্প্রতি গণ–অভ্যুত্থানের তরুণ নেতা নাহিদ ইসলাম (যিনি বর্তমানে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক) ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, তিনি বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে যে জাতীয় সরকার গঠন করার কথা বলেছিলেন, সেটি বিএনপি গ্রহণ করেনি। কার কথা ঠিক, সেই বিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। তবে নাহিদ ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁরা মনে করতেন, একটি জাতীয় সরকার করা দরকার। আর প্রধান দল বিএনপি সেই ধারণা গ্রহণ করেনি।

আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত২১ জুন ২০২৫

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মুহাম্মদ ইউনূস যে কাজের ওপর জোর দিয়েছেন, সেটি হলো সংস্কার। বিষয়টি মূল্যায়ন করার আগেই গোড়ার গলদটা বুঝতে হবে। নিশ্চিতভাবে সেই গলদ হয়েছে গত বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহেই। যখন অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তখন জাতীয় ঐক্য যে অবস্থায় বা যে অবস্থানেই থাকুক, অভ্যুত্থান প্রশ্নে আমরা সবাই একমত ছিলাম না এবং তা তো হতেই পারে।

যে রকম বলা হয়—বহুজন, বহুমত; সে রকম করেই প্রতিটি দলই চিন্তাচেতনায় একটা আরেকটা থেকে আলাদা। আর এমনিতে আমাদের সমাজ চিন্তাচেতনায়, রুচি–সংস্কৃতিতে বহুধা বিভাজিত। মুহাম্মদ ইউনূস বা তাঁর সরকারের কৃতিত্ব এই যে তিনি এ রকম একটি বিভাজিত সমাজে বিভিন্ন সামাজিক–রাজনৈতিক প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার এক বিরাট যজ্ঞ শুরু করতে পেরেছিলেন। এ জন্য তাঁকে একক কৃতিত্ব দিচ্ছি না। সে রকম একটি পরিস্থিতিরই উদ্ভব হয়েছিল এবং অন্তর্বর্তী সরকার সেটাকে সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।

আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দল সংসদে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে গেলে তার স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থার কথা এ জন্যই চালু হয়েছে, যাতে ওপরের কক্ষ নিম্নকক্ষকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় বাধা দিতে পারে।

প্রথম আলোয় ১ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রতিষ্ঠানে বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া, সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। তবে এ দুটিসহ সাতটি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি সিদ্ধান্তে একাধিক দল ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে।

গত ৩১ জুলাই শেষ দিনের আলোচনায় যে সাতটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, সেগুলো হলো চার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, উচ্চকক্ষ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ও সংবিধানের মূলনীতি। মৌলিক কিছু বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়নি, এ নিয়ে দুটি কথা বলা দরকার। ৫৪ বছরের বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চিত হওয়ারই সুযোগ পায়নি। প্রায়ই সে জায়গা দখল করেছে এক ব্যক্তি বা একদলীয় শাসন।

আরও পড়ুনরাজনৈতিক ঐকমত্য থাকলে সংবিধান কোনো বাধা নয়২৩ অক্টোবর ২০২৪

১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের রক্তাক্ত থাবা এখনো টিকে থাকা মানুষের বুকে তুষের আগুনের মতো জ্বলে। এ জন্যই সবাই এমন সংস্কার চেয়েছে, যাতে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে না পারে। সে জন্য কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ নয়, বরং গণতন্ত্র চালু রাখতে সংবিধানে বা দেশের প্রচলিত বিধানে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা বিলুপ্ত করে গণতান্ত্রিক বিধান চালুর দাবি উঠেছে।

আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দল সংসদে দুই–তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে গেলে তার স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনব্যবস্থার কথা এ জন্যই চালু হয়েছে, যাতে ওপরের কক্ষ নিম্নকক্ষকে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় বাধা দিতে পারে।

সংখ্যানুপাতিক ভোট নিয়ে যে বিতর্ক, তাতে কমিশন এই সিদ্ধান্ত দিয়েছে, নিচের কক্ষের ভোট আগের মতোই হবে, কিন্তু ওপরের কক্ষে ১০০টি আসনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত অনুযায়ী দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হবে। বিএনপির প্রস্তাব, নিচে যেভাবে ভোট হবে, যে অনুপাতে আসনে জিতবে, সেই অনুপাতে ওপরের কক্ষেও আসন বরাদ্দ করা হোক। কিন্তু তাহলে সেটা নিচের কক্ষের রেপ্লিকা হয়ে যায়। এ জন্যই ওপরের কক্ষে সংখ্যানুপাতিক আসন বরাদ্দ করা যুক্তিসংগত হবে বলে মনে করি।

এবার ঐকমত্য কমিশনের এই বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো মতপার্থক্য করেছে। কিন্তু তারপরও ২৩ দিনের আলোচনা শেষ পর্যন্ত কোনো রকম বড় মন–কষাকষি ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে। কমিশন নোট অব ডিসেন্টের প্রভিশন রেখে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কোনো মত চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে গণতন্ত্র বা সংসদীয় পদ্ধতিতে বিতর্কের মাধ্যমেও সেই মতপার্থক্যের নিষ্পত্তি হতে পারে।

এ জন্য ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিই। বিশেষ করে ধন্যবাদ দিই কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজকে। তিনি যেভাবে এত দিন ধরে সভা পরিচালনা করেছেন, যেভাবে ভিন্নমতের নির্যাস নিয়ে সেটাকে ঐকমত্যের দিকে নিয়ে গেছেন, সেটা অনন্য। হয়তো আরও ভালো কিছু করা যেতে পারত, কিন্তু বাস্তবতার কারণে তা পারা যায়নি। অতএব, সো ফার সো গুড।

মাহমুদুর রহমান মান্না সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ও ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ কী
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে আবার আলোচনা
  • ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ: সো ফার সো গুড
  • সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন
  • ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে গতি আনতে চায় কমিশন
  • রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর বেশিদিন টিকবে না
  • ঐকমত্য হয়েছে বেশ কিছু মৌলিক সংস্কারে
  • নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ
  • নানা বাধার কারণে রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব হয়নি: আসিফ মাহমুদ