টেলিভিশন সম্প্রচারের সংকট ও সম্ভাবনা
Published: 3rd, February 2025 GMT
যারা বলেন, সামাজিক মাধ্যমের দাপটে প্রচলিত টেলিভিশন মাধ্যম তার আকর্ষণ হারিয়েছে, তারা যে ভুল বলছেন, এমনটা নয়। আবার যারা টেলিভিশন কোনোদিনই তার আকর্ষণ হারাবে না; বড়জোর এর ফর্ম পাল্টাতে পারে বলে মনে করেন, তারাও ভুল বলছেন না। তাহলে সংকটটা কোথায়, আর কীভাবেই বা টেলিভিশন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আগের শক্তিমত্তায় আবির্ভূত হবে– সে এক প্রশ্ন বটে।
টেলিভিশন ঘরে বসে দেখার মাধ্যম থেকে বের হয়ে এসে এর পোর্টাবিলিটি বা ‘মোবিলিটি’ নিশ্চিত করে সংকটের শুরুটা মোকাবিলা করতে হবে। ভেবে দেখুন, বিশ্বের গতি এবং মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে।
এমন অবস্থায় একটি স্থির স্ক্রিনে মানুষ টেলিভিশন দেখবে কেন? এটা অন্যভাবে বলা যায়। যদি ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউব আর যেখানে-সেখানে দেখা যাচ্ছে না এবং সেসব উপভোগ করতে আপনাকে ঘরে যেতে হচ্ছে, তাহলে কি আপনি এখনকার মতো সামাজিক মাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকবেন?
আগামী দিনের বাস্তবতা
দিন যতই গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে মানুষের ‘মোবিলিটি’। সঙ্গে বাড়ছে মানুষের প্রত্যাহিক চাহিদা ও বিনোদনের সহজে বহনযোগ্য মাধ্যম বা ‘মোবিলিটি’। ফোনের ‘মোবিলিটি’ বেড়েছে; তার সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারহীন, ওয়াইফাইযুক্ত।
টেলিভিশনে অ্যান্টেনার যুগ সেই কবে শেষ হয়েছে। সম্প্রতি টেলিভিশন সংযোগও তারহীন বিনোদনে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ভূমি থেকে ভূমিতে প্রক্ষেপণযোগ্য টেলিভিশন সিগন্যাল তথা টেরিস্ট্রিয়াল বলি, তা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন টেলিভিশন সিগন্যাল প্রেরণ ও গ্রহণের মাধ্যম হয়ে উঠেছে স্যাটেলাইট। কিন্তু সেটাও বেশি দিন টিকবে না। কেননা মহাকাশ স্যাটেলাইটের ভিড়ে ভারাক্রান্ত; অন্যদিকে স্যাটেলাইট বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে মহাসাগর। দুটিই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশের জন্য অনুকূল নয়।
মাধ্যমের মহামিলন
নিকট ভবিষ্যতে টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টাল আলাদা কোনো সত্তা থাকবে না। টিকে থাকার তাগিদে সবই জোট বাঁধবে। এটাকে ‘মিডিয়া কনভারজেন্স’ বলা যেতে পারে।
টেলিভিশন সম্প্রচার ও গ্রাহক যন্ত্রে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে মানুষের টেলিভিশন দেখার অভিজ্ঞতা আমূল বদলে যাবে। আপনি চিন্তাই করতে পারবেন না, টেলিভিশন কতখানি মিথস্ক্রিয়াসম্পন্ন একটি সুপারমিডিয়ায় পরিণত হবে! সুপারমিডিয়ার ধারণা এ রকম–
১.
২. টেলিভিশন স্টেশন ও যন্ত্রের সঙ্গে চ্যাট করা সম্ভব হবে। এমনকি ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলা যাবে।
৩. বৈশ্বিক টেলিভিশন চ্যানেল দেখার ক্ষেত্রে ভাষাগত কোনো প্রতিবন্ধকতা আর থাকবে না। যে কোনো ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠান পছন্দমতো ভাষায় রূপান্তর টেলিভিশনই করে দেবে।
৪. টেলিভিশন সংবাদে সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব সাধিত হবে। কোন সংবাদ কতটা সত্য অথবা কতটা মিথ্যা, সেটা যাচাই টেলিভিশনই করে দেবে। উদাহরণস্বরূপ বলে দেবে, এই সংবাদটি ১০০ ভাগ সত্য, অথবা সংবাদটি অসত্যতার সম্ভাবনা ৪০ ভাগ বা ৭০ ভাগ– এ রকম।
৫. অন্যের কনটেন্ট চুরি করার প্রবণতা টেলিভিশন নিজেই ঠেকিয়ে দেবে। এ ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব নিয়ে মারামারির বড় একটা সমাধান হবে এখানেই।
৬. টিভি সেট আপনি ও আপনার অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ চালাতে পারবে না। শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে বড়দের অনুষ্ঠান আর দেখা সম্ভব হবে না। সে সুযোগই থাকবে না টেলিভিশনে। টেলিভিশনে এই প্রযুক্তিতে ঠিক ঠিক তাকে চিনে নিয়ে তার জন্য একটু সাজুয্যপূর্ণ অনুষ্ঠানমালা সাজিয়ে দেবে।
আরও কিছু চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার ক্ষেত্র
একদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষ, অন্যদিকে সর্বব্যাপিতা টেলিভিশন সিস্টেমকে যেমন অনেক সম্ভাবনা এনে দেবে, তেমনি দেখা দেবে নানা চ্যালেঞ্জ। এখনই সব বলা না গেলেও মোটা দাগে এর কয়েকটি আলোকপাত করা যেতে পারে।
১. মেটা ডেটা ও আইওটির ব্যবহার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে টেলিভিশন সম্প্রচারেও যুক্ত হবে ডেটা ও ইন্টারনেট অব থিংস। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এ দুটি টুল টেলিভিশনকে অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। যেমন, টেলিভিশন কি আইটি প্রোডাক্ট, নাকি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট? এ ছাড়া মেটা ডেটা ও আইওটির ব্যবহার নিয়ে আইওপির স্বত্ব অংশীদারিত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
২. টেলিভিশনের মালিকানা ও লাইসেন্স সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন মাধ্যম তো প্রায় একই ধরনের কাজ করে থাকে। তাহলে টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য লাইসেন্স নিতে হবে কেন? আগামী কয়েক দশকে যখন টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কয়েক গুণ হবে, তখনই এ দাবি আরও জোরালো হবে। অন্যদিকে, বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা টেলিভিশন সম্প্রচারের উন্মুক্ত স্বাধীনতা দেবে না। সুতরাং, দেশে দেশে দ্বন্দ্বের একটা জায়গা থাকছেই।
৩. আউটসোর্সিং সমস্যা: টেলিভিশন কনটেন্ট দিন দিন আউটসোর্সিংনির্ভর হয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে অনেক টিভি চ্যানেল শুধু সম্প্রচার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টিকে থাকবে। এ অবস্থায় কনটেন্টের দায় নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণ করা একটি অসাধ্য কাজ হয়ে যাবে। সরকারের কনটেন্ট মনিটরিংও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৪. পাবলিক সার্ভিস টিভি: বাণিজ্যিক টিভির দাপটে এখনই সরকারি টিভি অনেকটা কোণঠাসা। ভবিষ্যতে পাবলিক সার্ভিস টিভি যেমন আরও জৌলুস হারাবে, তেমনি দর্শকপ্রিয়তা হারাবে। এমন অবস্থায় শুধু ভর্তুকি দিয়ে পাবলিক সার্ভিস টেলিভিশন চালানো কঠিন হয়ে যাবে। এক সময় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে জনগণের পয়সায় পরিচালিত টিভি সার্ভিস।
সব মিলে একদিকে নতুন সম্ভাবনা, অন্যদিকে নতুন সংকট। অনেকে হয়তো পুরোনো টেলিভিশন, অনুষ্ঠান ও সম্প্রচারের নস্টালজিয়ায় ভুগবেন। তবে প্রচলিত ধারায় টেলিভিশন সম্প্রচার বা মেইন স্ট্রিম টিভি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে না– এ কথা বিশ্বাস করে টেলিভিশন শুভানুধ্যায়ীরা আপাতত স্বস্তিতে থাকতে পারেন।
জাহিদুল ইসলাম: বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ টেলিভিশন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কনট ন ট
এছাড়াও পড়ুন:
নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পে নারী কর্মীদের চাকরি কেন অনিশ্চিত
গত ২২ মে থেকে প্রেসক্লাবের সামনে একদল নারী অবস্থান নিয়েছেন; ঈদের দিনেও তাঁরা সেখানে ছিলেন। সুদূর কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন জেলা থেকে তাঁরা এসেছেন। আগামী ৩০ জুন থেকে তাঁরা চাকরিহীন হবেন। এই নারীদের অনেকেই তাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সন্তানের স্কুলের খরচ, মাসের বাজার খরচ, পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার খরচ—এসব এক হাতে সামলান তাঁরা।
এই নারীরা ‘মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়’ (বর্তমানে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়) আওতাধীন একটি প্রকল্পের কর্মী। প্রকল্পটির নাম হলো ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়)’। ১৯৮৯ সালে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে নারীদের প্রশিক্ষণ, নারীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার খাত তৈরি করা এবং স্বাস্থ্য ও আইনি কাঠামোর অগ্রসরতা নিয়ে কাজ রয়েছে। কিন্তু গত দুই দশকে এগুলোর কলেবর বেড়েছে।
বিদেশি অর্থায়নের সহায়তায় সামাজিক সুরক্ষার আওতায় মন্ত্রণালয়টি নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু বড় বাজেটের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম, জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্প (৬৪ জেলা), তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল, তথ্য আপা প্রভৃতি। এ প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম, প্রভাব ও ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী সরকারের আমলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের মতো মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলোও লুটপাটের অংশ হয়ে উঠেছিল। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের একটা বড় দায়িত্ব হচ্ছে এ প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে, সেগুলোর ভুলত্রুটি ও সাফল্য-ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের ভূমিকাকে আরও গতিশীল করা। অথচ আমরা দেখছি নারীর ক্ষমতায়ন অনিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে; তথ্য সেবাদানকারী নারী কর্মকর্তা ও সহকারীদের কর্মসংস্থান অনিশ্চিত করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এমন একটি উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে।
২.সরকারের সব বিভাগের সহযোগিতার তথ্য নিয়ে দেশের ৪৯২টি উপজেলায় নারী ও শিশুদের ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রদান করার চিন্তা থেকেই ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পটি শুরু হয়েছে। ২০১১ সালে প্রকল্পটির ১ম পর্যায় শুরু হয় ১৩টি উপজেলায়। পরে ২০১৭ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৯২টি উপজেলায় এটি বিস্তৃত হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকেই প্রতিটি উপজেলা তথ্যকেন্দ্রে একজন তথ্যসেবা অফিসার এবং দুজন তথ্যসেবা সহকারী অফিসার নিয়োগ হয়। এই তথ্যসেবা প্রদানকারী অফিসাররা ‘তথ্য আপা’ বলে পরিচিতি পান।
‘তথ্য আপা’রা তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, আইন, জেন্ডার, ব্যবসা, পরিবার-পরিকল্পনাসেবাসহ অনলাইনভিত্তিক সেবা বিনা মূল্যে প্রদান করেন। তা ছাড়া বাড়ির দোরগোড়ায় (ডোর স্টেপ সার্ভিস) উঠান বৈঠক আয়োজনের মাধ্যমে ‘তথ্য আপা’রা বিনা মূল্যে সরকারি সেবা–সম্পর্কিত তথ্য পৌঁছে দেন। অনলাইনে আবেদনের জন্য নারীদের সহযোগিতা করে। বিশেষ করে উপজেলাভিত্তিক নারীরা তাঁদের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মা ও শিশুসহায়তা ভাতার জন্য অনলাইন আবেদন, সরকারি খাদ্যসহায়তা, ঘর বরাদ্দের আবেদন, জাতীয় পরিচয়পত্র হালনাগাদ, পাসপোর্ট এবং ভিসার অনলাইন আবেদন, টিকার রেজিস্ট্রেশন পূরণ ও সনদ সংগ্রহ, টিন সার্টিফিকেটের আবেদনের কাজগুলো ‘তথ্য আপা’র সহায়তায় করে থাকেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে নারীরা ‘তথ্য আপাদের’ কাছে যান। অনেক সময় নারীরা পুলিশের কাছে কীভাবে সহায়তা পাবেন, তা জানা না থাকলে ‘তথ্য আপাদের’ ওপর আস্থার কারণে তাঁদের সহায়তা চান। গ্রামীণ নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রতিটি তথ্যসেবাকেন্দ্র এক একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে থাকে। গ্রামীণ উদ্যোক্তা নারীরা যাতে তাঁদের পণ্য ‘লালসবুজ ই-কমার্স’ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারে, সে ক্ষেত্রেও তথ্য আপারা নারীদের সহায়তা করেন।
কোনো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে কীভাবে ভুক্তভোগী নারী সরকারি সহায়তা পেতে পারেন, সেই কাজও ‘তথ্য আপা’রা করেন। প্রকল্পের আওতায় তথ্য আপারা প্রাথমিক কিছু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রশিক্ষণও পেয়েছেন। এর ফলে বাড়ির উঠানে গিয়ে তাঁরা নারীদের রক্তচাপ, ওজন পরীক্ষা নিয়মিতভাবে করে থাকেন। এককথায় বলা যায়, দেশব্যাপী প্রায় ১ হাজার ৯৬৮ জন ‘তথ্য আপা’ গ্রামীণ নারীদের তথ্যসেবার ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন।
সেই তথ্য আপারা চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রেসক্লাবে বসে আছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করা তথ্য আপারা নিজেরা কতটুকু ক্ষমতায়িত হলেন? এত দিনে তৈরি হওয়া তাঁদের দক্ষতা, তাঁদের ওপর নারীদের তৈরি হওয়া আস্থা তো তাঁরা অর্জন করেছেন বহুদিনের পরিশ্রম ও বিনিয়োগের মাধ্যমে; তাঁদের এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব?
৩.তথ্য আপা প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে সুনির্দিষ্টভাবে লেখা আছে, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ করার পর তথ্য আপাদের স্থায়ী করা হবে অথবা নতুন পদ সৃজন করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হবে। নিয়োগ অস্থায়ী হলেও তথ্য আপারা বারবার তাঁদের পদ স্থায়ীকরণ কিংবা নতুন পদ সৃজন করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরকরণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে এসেছেন। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে যা লেখা হয়, তা অনেক সময় লেখা হয়, প্রকল্প ব্যয় বেশি দেখাতে এবং নিয়োগকে আকৃষ্ট করতে। প্রস্তাবে তাঁদের আত্তীকরণের কথা লেখা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ শেষে তথ্য আপাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।
তথ্য আপা প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বের মেয়াদ প্রায় শেষ। এখন তৃতীয় পর্ব শুরু হওয়ার অপেক্ষা। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নতুনভাবে আউটসোর্সিং করে তথ্য আপাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সাত বছর ধরে ১ হাজার ৯৬৮ জন তথ্য আপা দক্ষ কর্মী হিসেবে নিয়োজিত আছেন; তাই পুনরায় নতুন করে কর্মী নিয়োগ করা হলে তাঁদের দক্ষ করতে প্রকল্প পরিচালন ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাবে। তা ছাড়া আউটসোর্সিংয়ে কর্মী সংগ্রহের বিষয়টি দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের জন্য একটি নেতিবাচক অভিজ্ঞতা।
চলমান তথ্য আপা দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পেও সিকিউরিটি গার্ড পদটি আউটসোর্সিংয়ে রাখার কথা প্রস্তাবে বলা হয়েছিল। অথচ সিকিউরিটি গার্ডের অর্থ উপজেলায় পাঠানো হলেও গত সাত বছরে তথ্যসেবাকেন্দ্রে কোনো সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এই দেশের বাস্তবতায় আউটসোর্সিংয়ে কর্মী নিয়োগ মানেই ঘুষবাণিজ্য ও লুটপাটকে আরও প্রশস্ত করা। সেই বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও দক্ষ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করে নারী ও শিশু মন্ত্রণালয় কেন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মী নিতে ইচ্ছুক?
৪.২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তথ্য আপা প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে তথ্যসেবা অফিসাররা ২৭ হাজার ১০০ টাকা এবং তথ্যসেবা সহকারী অফিসাররা ১৭ হাজার ৪৫ টাকা বেতনে নিয়োগ পান। কিন্তু চার মাস যেতে না যেতেই কোনো লিখিত কারণ ছাড়াই ২০১৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে তথ্যসেবা কর্মকর্তারা ২৪ হাজার ৭০০ টাকা এবং তথ্যসেবা সহকারী অফিসাররা ১৫ হাজার ৬৫০ টাকা বেতন পেতে শুরু করেন। এভাবে কেন তাঁদের বেতন কর্তন করা হয়েছিল, তার কোনো সুস্পষ্ট উত্তর মন্ত্রণালয় দিতে পারেনি। অথচ এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্য প্রকল্পের সমমান গ্রেডের কর্মীদের কোনো বেতন কাটা হয়নি।
২০২২ সালে ৫৮৩ জন তথ্য আপা বেতন কর্তনের বিরুদ্ধে আদালতে রিট দাখিল করেন। আদালত থেকে তাঁদের এই কর্তিত বেতন ফেরত দেওয়ার রুল জারি করা হয়। কিন্তু ২০২২ সালে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদকাল এক বছর করে বাড়ানো হয়। আদালতের রায় মেনে কর্তিত বেতনের টাকা দেওয়া দূরে থাক, প্রকল্পের বর্ধিত সময়ে একইভাবে বেতন কাটা হয়।
এভাবে প্রত্যেক তথ্যসেবা অফিসারের কাছ থেকে প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা এবং তথ্যসেবা সহকারীর কাছ থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৬০০ টাকা কাটা হয়। অর্থাৎ ১ হাজার ৯৬৮ জন তথ্য আপার কাছ থেকে ৭ বছরে মোট ২০ কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার ২০০ টাকা কাটা হয়। প্রকল্পের প্রস্তাবনায় তো এই টাকা ধার্য করা হয়েছিল। তাহলে এই টাকা কোথায় গেল?
৫.তথ্য আপারা তাঁদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাকরির স্থায়ীকরণ অথবা নতুন পদ সৃষ্টি করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরকরণ এবং অন্যায়ভাবে বেতন থেকে কেটে নেওয়া ২০ কোটি টাকা পাওনার দাবিতে দুই সপ্তাহ ধরে প্রেসক্লাবে বসে আছেন। এ অবস্থান কর্মসূচির আগে তাঁদের ৬৪ জন জেলা প্রতিনিধি নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।
তথ্য আপা প্রকল্পটি যেহেতু আওয়ামী লীগ শাসনামলের এবং সেই আমলেই এই প্রকল্প থেকে লুটপাট শুরু হয়েছে, তাই বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে ওই প্রকল্পের কর্মীদের ‘আওয়ামী আবর্জনা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে—এমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ সিলেটে যিনি তথ্য আপা হিসেবে কাজ করছেন, তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম ফ্রন্টলাইনার। দুঃখজনক হলেও নির্মম বাস্তবতা হলো, যখনই মানুষের অধিকার নিয়ে কেউ ন্যায্য আন্দোলন করছেন, তাঁদের ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।
এ রকম অবস্থায় গত ২৬ মে নিরুপায় হয়ে অনশন চলাকালে তথ্য আপারা তাঁদের অধিকারের কথা বলতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন বরাবর শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল নিয়ে যান। কিন্তু পুলিশ তাঁদের ওপর হামলা করে। এতে বেশ কয়েকজন তথ্য আপা আহত হন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন গর্ভবতী ও মাতৃদুগ্ধ পান করানো মা, ক্যানসার রোগী, প্রতিবন্ধী—এমন অনেকে। পুলিশি হামলার শিকার হন জুলাই ফ্রন্টলাইনার তথ্য আপাও।
এ হামলার ঘটনা আমাদের হতবাক করেছে। হাজার হাজার নারী যাঁরা আর কয়েক দিন পর চাকরিচ্যুত হবেন, সরকার তাঁদের জন্য তো বিকল্প কর্মসংস্থান তো করেইনি, উল্টো তাঁরা নির্মমভাবে হামলা ও নিপীড়নের শিকার হলো!
এসডিজি-৫ তথা জেন্ডার সমতার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এক যুগ ধরে নারী ক্ষমতায়নের প্রকল্পগুলো নেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, যখন দেশের সামাজিক বাস্তবতায় নারীদের বড় অংশ কর্মমুখী নন, তখন এ ধরনের প্রকল্পের নারীরা চাকরি হারালে তা কতটুকু এসডিজি-৫–এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে?
আমরা দেখছি জনপ্রশাসন খাতে পাগলা ঘোড়ার মতো ব্যয় বাড়তেই থাকে; নতুন নতুন পদ সৃষ্টি হয়। এক একটি বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে, ফিজিবিলিটি স্টাডি করে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়, যার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু প্রশ্ন যখন মাঠকর্মীদের কর্মসংস্থানের, তখনই নতুন পদ সৃজনে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। প্রকল্পের পরিচালকেরা ঠিকই নতুন প্রকল্পে স্থানান্তর হয় আর মাঠকর্মীরা তাঁদের মাসিক আয়ের নিশ্চয়তা হারান।
একটি প্রকল্প তার মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ছাড়া মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না। তাই তথ্য আপাদের কথা শুনতে হবে; তাঁদের চাকরি অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে কীভাবে রাজস্ব খাতে পদ সৃজন করে তাঁদের স্থানান্তর করা যায়, তা অবিলম্বে তাঁদের জানাতে হবে। অন্যায়ভাবে কর্তন করা তাঁদের বেতন ফিরিয়ে দিতে হবে। চাকরির অনিশ্চয়তায় হাজারো নারী প্রেসক্লাবে বসে থাকবেন, অথচ তাঁদের কথা সরকার শুনবে না, গণ-অভ্যুত্থানের পর এ রকম বন্দোবস্ত আমাদের কাম্য নয়।
ড. মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সীমা দত্ত সভাপতি, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র
মারজিয়া প্রভা সদস্য, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি
মতামত লেখকদের নিজস্ব