নবীনগরে হেফাজতের কমিটি নিয়ে মুখোমুখি দু’পক্ষ
Published: 23rd, April 2025 GMT
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কমিটি গঠন নিয়ে উত্তেজনা চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। দুটি পক্ষের নেতারা নিজ নিজ কমিটির নেতা দাবি করছেন। বিষয়টি নিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিগত কমিটির সভাপতি মাওলানা আমিরুল ইসলাম নিজেকেই এখনও সভাপতি দাবি করছেন। অপরদিকে নতুন কমিটির সভাপতি হিসেবে মুফতি বেলায়েতুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাওলানা মেহেদী হাসানের নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের অনুসারীরা।
নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি জেলা নেতাদের উপস্থিতিতে কাউন্সিল অধিবেশন হয়। সেখানে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হয়নি। যদিও আজ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে নবীনগর শাখার সভাপতি দাবি করেন মাওলানা আমিরুল ইসলাম। তিনি আগের কমিটিতেও একই পদে ছিলেন।
মাওলানা আমিরুল ইসলামের ভাষ্য, কাউন্সিল অধিবেশনে ৯৭ শতাংশ ভোটার তাঁকেই পুনরায় সভাপতি হিসেবে সরাসরি ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। তখন মেহেদী হাসান বাধা দেন। একই সঙ্গে হুমকিধমকি দেওয়াসহ মারমুখী আচরণ করেন তিনি (মেহেদী)। গঠনতন্ত্রবিরোধী আচরণ করে মেহেদী কমিটি ঘোষণায়ও নিষেধ করেন। জেলার নেতারা পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কমিটি পরে ঘোষণার কথা জানিয়ে কাউন্সিল সমাপ্ত করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মাওলানা আমিরুল বলেন, জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের উচিত নবীনগর এসে আবারো কাউন্সিল অধিবেশন ডেকে তৃণমূল নেতাকর্মীর সরাসরি ভোটে কমিটি ঘোষণা করা।
এদিকে কয়েকদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, উপজেলায় হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। এতে সভাপতি হিসেবে মুফতি বেলায়েতুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাওলানা মেহেদী হাসান নির্বাচিত হয়েছেন। এই দুই নেতার অনুসারীরাই এসব ছড়িয়ে দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
নতুন এই কমিটির অনুমোদন রয়েছে বলে দাবি করেন মাওলানা মেহেদী হাসান। তাঁর দাবি, ১৫ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলের অধিবেশনের পরবর্তী সময়ে জেলা কার্যালয়ে জেলা, উপজেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে কমিটি গঠিত হয়। এতে মুফতি বেলায়েতুল্লাহ সভাপতি ও তিনি (মেহেদী হাসান) সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।
কমিটির অনুমোদনের কাগজপত্র বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, শিগগিরই তারা একটি সংবাদ সম্মেলন করবেন। সেখানেই অনুমোদনের কাগজ উপস্থাপন করা হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আলী আজ্জমের ভাষ্য, ‘ওই কাউন্সিল অধিবেশনে আমরা কমিটির ঘোষণা করতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ও উপজেলার নেতৃবৃন্দদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় মুফতি বেলায়েতুল্লাহকে সভাপতি ও মাওলানা মেহেদী হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি কমিটির সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ একই সঙ্গে তিনি স্বীকার করেন বিষয়টি জানিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি এখনও তারা দেননি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় কম ট র স আম র ল ইসল ম উপস থ
এছাড়াও পড়ুন:
মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ
১৮৮৬ সালের ১ মেÑএকটি দিন, একটি দাবি, আর হাজারো শ্রমিকের আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে রক্তাক্ত দাগ কেটে দিয়েছিল যে মুহূর্ত, তা আজ বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তখনকার দাবিটি ছিল স্রেফ ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের দাবি শুধু সময়
নয়Ñমর্যাদা, সুরক্ষা ও ন্যায্যতার প্রশ্নও।
এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য “শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে”Ñএ যেন সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বার্তা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, বরং তা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য এক যৌথ দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশের শ্রমচিত্র ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ, কৃষি ও নির্মাণ খাতে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিয়োজিত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে শ্রমনির্ভর খাত থেকে। কিন্তু যাঁরা এই অর্থনীতির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছেন, সেই শ্রমিকরা কি পেয়েছেন তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা?
দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও বহু শ্রমিক পান না ন্যূনতম মজুরি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা কিংবা ছুটি সংক্রান্ত মৌলিক সুবিধা। নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও জটিলÑযত্রতত্র হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব, কিংবা নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে না তোলার ফলে এই খাতেও স্থিতিশীলতা আসছে না।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক: দ্বন্দ্ব নয়, দরকার সহমর্মিতা
এক সময় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক মানেই ছিল দ্বন্দ্ব, ধর্মঘট ও হুমকি। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছেÑসহযোগিতাই টেকসই উৎপাদনের চাবিকাঠি। মালিকপক্ষ যখন শ্রমিককে কেবল “ব্যয়” হিসেবে না দেখে “সম্পদ” হিসেবে বিবেচনা করেন, তখন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। একইভাবে শ্রমিকও যদি বুঝেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মানে তার কর্মস্থলের স্থায়িত্বÑতাহলে দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের
ভিত্তি গড়ে ওঠে।
এই বিশ্বাস গঠনের জন্য প্রয়োজন তিনটি স্তম্ভ:
নীতিগত স্বচ্ছতা Ñ ন্যায্য মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা দায়িত্বশীল মালিকপক্ষ Ñ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে উদ্যোগ সচেতন শ্রমিকশ্রেণি Ñ অধিকার আদায়ের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের মানসিকতা
নীতি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত ২০১৮ সংস্করণ অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেমন কৃষি, গৃহপরিচারিকা, গিগ-ওয়ার্কার) শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনও প্রায় উপেক্ষিত।
এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা বীমা, এবং পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হওয়া জরুরি। সরকার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলেও তা অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে’ দেশ গড়ার বার্তাটি যেন শুধুই স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এটি হোক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক বিনিয়োগ ও মানবিক বিবেচনার এক বাস্তব প্ল্যাটফর্ম।
প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও নতুন শ্রম বাস্তবতা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শ্রমবাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ও গিগ-ইকোনমি অনেক চাকরি বিলুপ্ত করছে, আবার নতুন দক্ষতা চাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়, তাহলে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পুনঃস্কিলিং এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এখানে মালিক ও রাষ্ট্র উভয়ের উচিত হবে, শ্রমিককে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিনিয়োগ করা, কারণ দক্ষ শ্রমিক ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকে না।
মে দিবস: উৎসব নয়, দায়বদ্ধতার প্রতীক
মে দিবস কেবল লাল পতাকা হাতে শোভাযাত্রার দিন নয়, এটি আমাদের মানবিক চেতনার প্রতিফলন। যে শ্রমিক ঘাম ঝরিয়ে ভবন গড়ে, কৃষি জমি চষে, রপ্তানি পণ্য তৈরি করেÑতার জন্য আমাদের উচিত মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।
এবছর, আসুন আমরা সবাই রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকÑএকটি মানবিক, উৎপাদনশীল ও শীদারিত্বভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যাই। শ্রমিকের হাতে গড়া এই বাংলাদেশ হোক তার জন্যই গর্বের জায়গা।
লেখক পরিচিতি:
মীযানুর রহমান
সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক
মোবাইলঃ ০১৭৫৪১০৯০৭২
যোগাযোগ: : [email protected]