কারখানায় গ্যাস সরবরাহে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করবে সরকার: প্রেস সচিব
Published: 25th, April 2025 GMT
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের কারখানাগুলোতে স্বচ্ছন্দে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার দোহায় সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেছেন, ‘অনেকে বলেছেন, গ্যাসের অভাবে তারা কারখানা স্থাপন করতে পারছেন না। তাই, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করতে চাই যাতে পর্যাপ্ত গ্যাস (বিদেশ থেকে) আনা যায়।’
তিনি বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের দোহা সফরের সময় কাতার এনার্জির সঙ্গে একটি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে মিগগির স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনালটি স্থাপন করা হবে। খবর-বাসস
প্রধান উপদেষ্টার দোহা সফর সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এই সফর অত্যন্ত সফল এবং ফলপ্রসূ হয়েছে। আমি বলব এটি সবচেয়ে সফল এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় সফরগুলোর মধ্যে একটি।
শফিকুল আলম আশা প্রকাশ করেছেন, এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসবেন। দেশের অর্থনীতির উত্থান-পতনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সময় ৩শ’ ২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ ছিল, কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা কমিয়ে ৬০ কোটি মার্কিন ডলারে নিয়ে এসেছে।
প্রেস সচিব বলেছেন, অবশিষ্ট ঋণ কয়েক মাসের মধ্যে পরিশোধ করা হবে। তিনি আরও বলেছেন, ‘এটি বিশ্বের বাইরে ইতিবাচক সংকেতের অনুভূতি যে আমরা ব্যবসার জন্য প্রস্তুত।’ চার দিনের সফর শেষে প্রফেসর ইউনূস আজ শুক্রবার পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্যে যোগদানের জন্য দোহা থেকে ইতালির রোমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ য স সরবর হ বল ছ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা রোববার জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদিও মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে তথাকথিত ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি (সমকাল অনলাইন, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)।
আলোচনাটি যে হঠাৎ এসে গেছে– এমন মনে করার কারণ নেই। গত বছর ১১ নভেম্বর আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই মানবিক করিডোরের বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছিল। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন। ওই সভাতেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি ও মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাব রাখেন।
দু’মাস পর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দুই দিনের সফরে বাংলাদেশ আসেন। তখনই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর দুই দিনের সফর শেষে ১৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টই বলেছিলেন– ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। পরিস্থিতি অনুকূল হলে বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে বাংলাদেশকে চ্যানেল বা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে যথাযথ অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন’ (সমকাল, ১৬ মার্চ ২০২৫)।
সর্বশেষ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন রোববার এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে করিডোরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সে ব্যাপারে বিস্তারিত আপাতত বলছি না। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব (সমকাল, ২৮ এপ্রিল ২০২৫)।
বিধৃত পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানুষের জন্য বাংলাদেশকে মানবিক করিডোর হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি জাতিসংঘের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যুদ্ধরত অনেক দেশেই বেসামরিক লোকদের কাছে মানবিক সহায়তা প্রদানে মানবিক করিডোর স্থাপন ও ব্যবহার করা হয়েছে। এসবের কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃপ্রণোদিত আলোচনার মাধ্যমে, কোনো কোনোটি তৃতীয় পক্ষ বিশেষত জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। উদ্দেশ্য যা-ই থাকুক না কেন, ফল সবসময় খুব একটা ভালো হয়নি।
যেমন ১৯৮৯ সালে প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় বেসামরিক মানুষদের সাহায্য করার জন্য লাচিন করিডোর স্থাপিত হয়েছিল। এটি নাগোর্নো-কারাবাখের আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক করিডোর বা ‘জীবনরেখা’ হিসেবে বিবেচিত ছিল। শুরুতে কিছুদিন ভালো চললেও বছর দুয়েকের মাঝেই করিডোরটি আজারবাইজান বন্ধ করে দেয়। তাদের অভিযোগ ছিল, প্রতিপক্ষ এটিকে সামরিক সরবরাহ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ‘অবৈধ’ পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছিল; যদিও আর্মেনিয়া ও তার মিত্র প্রজাতন্ত্রগুলো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে আক্রমণের পর আজারবাইজানি বাহিনী পুরো নাগোর্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে নাগোর্নো-কারাবাখের প্রায় সব আর্মেনীয় বাসিন্দা লাচিন করিডোর দিয়ে আর্মেনিয়ায় চলে যায়। এভাবেই একটি মানবিক করিডোরের অমানবিক মৃত্যু ঘটে।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় মানবিক করিডোরের ইতিহাস আরও রক্তাক্ত। সেখানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মানবিক করিডোর।
প্রথমে ১৯৯৩ সালের ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে স্রেব্রেনিকা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে একই বছরের ৬ মে নিরাপত্তা পরিষদের ৮২৪ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ৬টি মানবিক করিডোর ঘোষণা করা হয়। এগুলোকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী ইউনিটের সুরক্ষাধীনে রাখা হয়। এটা জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তের একটি বিবেচিত হয়ে থাকে। কারণ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মতো যুদ্ধক্ষেত্রে এই নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত করা হবে, সেটি সম্পর্কে সুস্পষ্ট রূপরেখা ছিল না। ফলে প্রস্তাবটি পরে জটিল ও কঠিন কূটনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। কারণ এর পক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক কারণে নিরাপদ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক ছিল না। এ অবস্থায় ১৯৯৫ সাল নাগাদ জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকাগুলোতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে এবং স্রেব্রেনিকা গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার একটি।
উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদের ৮১৯ নম্বর প্রস্তাবে স্রেব্রেনিকাকে ‘বল প্রয়োগসহ সব প্রয়োজনীয় উপায় ব্যবহার করে সুরক্ষিত নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপদ এলাকার ওপর অব্যাহত আক্রমণের পাশাপাশি সারায়েভোর অব্যাহত অবরোধের ফলে শেষ পর্যন্ত বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় অপারেশন ডেলিবারেট ফোর্স নামে ন্যাটো হস্তক্ষেপের সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের শেষ নাগাদ প্রতিটি নিরাপদ এলাকায় ‘রিপাবলিকা শ্রপস্কা আর্মি’ বা বসনিয়ান সার্ব সেনাবাহিনী আক্রমণ এবং স্রেব্রেনিকা ও জেপা দখল করে।
আফ্রিকার দেশ কঙ্গোতে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করে। সেখানেও জাতিসংঘের প্রস্তাবমতে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু দেশটির সমস্যা সমাধানে এই পদক্ষেপও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে, এমন মনে করার অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয়নি।
২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ও বিভিন্ন সময় নিরাপদ অঞ্চল, উত্তেজনা কমানোর অঞ্চল বা নো-ফ্লাই জোন প্রস্তাব বা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুই তেমন কাজে লাগেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। সিরিয়ার বর্তমান অবস্থাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বস্তুত বিশ্বজুড়ে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে যেসব জায়গায় ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো শেষ পর্যন্ত শুধু মানবিক করিডোরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি। অনিবার্যভাবেই সামরিক নানা বিষয় যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যে এমনটি ঘটবে না– সে ব্যাপারে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। কারণ আরাকান রাজ্যে এ ধরনের করিডোর মিয়ানমার সহজভাবে গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। ভূরাজনৈতিক কারণে এ অঞ্চলে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীনের দীর্ঘদিনের স্বার্থ-সংঘাত সুবিদিত। সঙ্গে রয়েছে ভারত ও রাশিয়ার স্বার্থও। সর্বোপরি রাখাইনে মানবিক সহায়তার করিডোরে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকদের লাভ হবে কিনা, তারও নিশ্চয়তা নেই।
আমরা জানি, আরাকান আর্মির রসদ সরবরাহের অন্যান্য পথ বন্ধ করে রেখেছে মিয়ানমার জান্তা সরকার। এখন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘মানবিক সহায়তা’ তারা নিজেদের বদলে বেসামরিক নাগরিকদের হাতে তুলে দেবে? আবার আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এই জনগোষ্ঠীর আরও এক লাখ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
কথা হচ্ছে, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, কঙ্গো কিংবা সিরিয়া– কোথাও মানবিক করিডোর সফল হয়নি। সর্বশেষ ইউক্রেন-রাশিয়াতেও জাতিসংঘ প্রস্তাবিত মানবিক করিডোরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এখন সেটা বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ক্ষেত্রে কী ম্যাজিক দেখাতে পারে, বোধগম্য নয়। প্রস্তাব জাতিসংঘ বা যেখান থেকেই আসুক; সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।
মোশতাক আহমেদ; কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার, জাতিসংঘ