বলীখেলা এ অঞ্চলের আদি অকৃত্রিম একটা ঐতিহ্য। আগে পাড়ায় পাড়ায়, অর্থাৎ বিভিন্ন থানা এলাকায় এ আয়োজন ছিল। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ ও বৈশাখ মাসে খালি জমিতে আয়োজন করা হতো বলীখেলা। অনেক জায়গায় বলীখেলার পাশাপাশি গরুর (ষাঁড়) লড়াইও হতো। কালক্রমে বলীখেলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লালদীঘি মাঠের শতবর্ষী আবদুল জব্বারের বলীখেলা।

বলীখেলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নাম। এটাকে কুস্তি বা মল্লযুদ্ধ প্রতিযোগিতাও বলা হতো। প্রচলিত, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক কুস্তি প্রতিযোগিতার সঙ্গে এর মিল পাওয়া ভার। এই বলীখেলা হয়ে আসছে পুরোপুরি গ্রামীণ নিয়মকানুনে। নির্মল বিনোদনই কেবল নয়, শোষণকারীদের বিপক্ষে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য নিজেকে কিংবা সমাজকে তৈরি করার প্রচেষ্টাও ছিল এই মল্লযুদ্ধে।

আবদুল হক চৌধুরীর ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘মল্লযুদ্ধে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সুপ্রাচীনকালের। চট্টগ্রামে মল্ল নামে খ্যাত বহু সুপ্রাচীন হিন্দু-মুসলমান পরিবার দেখা যায়। চট্টগ্রামের ২২টি মল্ল পরিবার ইতিহাস বিখ্যাত। তাঁরা সবাই মধ্য চট্টগ্রাম, অর্থাৎ কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদের মধ্যবর্তী এলাকার ২০ গ্রামের লোক ছিলেন। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।’

মল্লযুদ্ধ কখন বলীখেলা নামে পরিবর্তিত হয়েছে, তা জানা নেই জানিয়ে বইটিতে উল্লেখ করা হয়, প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলের প্রতি জেলায় হাতে গোনা কুস্তি প্রতিযোগিতা বা মল্লযুদ্ধ আয়োজন হতো। চট্টগ্রামের মতো দুই মাস ধরে বলীখেলা আর কোথাও হতো না। মল্লরা সাধারণত খুব সুঠামদেহী এবং শক্তিশালী হতেন।

ঢোলবাদনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পাড়া থেকে বলীরা খেলার স্থানে ভিড় করতেন। যাঁরা বলীখেলা দিতেন, তাঁরা সোনার অথবা রুপার মেডেল পুরস্কার হিসেবে রাখতেন। মাটি খুঁড়ে ধুলাময় করে রিং তৈরি করা হতো, যাতে বলীরা ব্যথা না পান। এক বলী অপরজনকে মাটিতে ফেলে দিতে পারলেই শুধু হতো না, পিঠ মাটিতে ছোঁয়াতে পারলেই বিজয়ী ঘোষণা করা হতো। তখন বিজয়ীর গলায় মেডেল পরিয়ে দেওয়া হতো। বিজয়ী বলীর নাচও ছিল দর্শনীয়। বাদ্যের তালে তালে কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা।

চট্টগ্রামের বলীখেলা প্রতিযোগিতার বেশির ভাগই ছিল মানুষের নামে। যে ব্যক্তি আয়োজক থাকতেন মূলত তাঁর নামেই প্রতিযোগিতা প্রচলিত হতো। তবে এর বাইরেও হাটহাজারীর বলীখেলা, ফতেপুরের বলীখেলা, পটিয়ার বলীখেলা, মক্কার বলীখেলা ইত্যাদি জনপ্রিয় ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময় সাহিত্যিক আবুল ফজল সেখানে বলীখেলার প্রবর্তন করেছিলেন। এতে ছাত্ররাও অংশ নিতেন। তবে তা কয়েক বছর পর বন্ধ হয়ে যায়।

আবদুল হক চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আস্তে আস্তে বলীখেলা কমতে থাকে। এখনো দু–একটি বলীখেলা সগৌরবে আয়োজিত হয়। তার মধ্যে জব্বারের বলীখেলা অন্যতম। ছয় দফার মাঠ লালদীঘি ময়দানে এই বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও বলীখেলার শুরুর সময়ে এ মাঠ ঐতিহাসিক হয়ে ওঠেনি।

বলীখেলায় দুই প্রতিযোগীর লড়াই.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র র বল খ ল বল খ ল র

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কারের একাল-সেকাল

ওয়ান-ইলেভেনকালে জরুরি অবস্থার গর্ভে জন্ম নেওয়া সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘সংস্কারের জিগির’ তোলা হয়েছিল। সে সংস্কারের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, যা ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ হিসেবে চিহ্নিত।

দল দুটির যেসব নেতা ওই তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারা ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হন। এক পর্যায়ে ‘সংস্কারপন্থি’ শব্দটিই রাজনৈতিক গালিতে পরিণত হয়।  

সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। ২০০৭ সালের নিন্দিত ‘সংস্কার’ ২০২৪ সালে এসে নন্দিত ‘সংস্কার’ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, লন্ডভন্ড নির্বাচন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আর যাতে কোনো দল সরকারে গিয়ে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার ‘প্রয়োজনীয়’ সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায় এবং এ জন্য পর্যাপ্ত সময় ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে। 

ধারণা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানকে গণমুখী করা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অধিকতর শক্তিশালী করতে বিধিবিধান পরিবর্তনের মধ্যেই সংস্কার কার্যক্রম সীমিত রাখবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অস্ত্রোপচার করে রাষ্ট্রের আকার-আকৃতি, চেহারা-সুরত পাল্টে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞের সূচনা করেছে। গঠন করেছে ছোট-বড় ১১টি সংস্কার কমিশন: সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, নারীবিষয়ক, স্থানীয় সরকার এবং গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। আবার এসব বিষয়ে যাতে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয় সে জন্য গঠন করা হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’।

সন্দেহ নেই, জাতীয় স্বার্থে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। সাধারণত প্রয়োজনের নিরিখে সে ঐক্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার প্রয়োজনে। এবারও দেশকে আক্ষরিক অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে এমনিতেই জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। সে জন্য আলাদা কমিশন গঠন করার প্রয়োজন কেন হলো, বোধগম্য নয়।

গঠিত ১১টি কমিশনের বেশ কয়েকটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে সরকারের কাছে। সেসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবগুলোর কিছু বিষয়ে সবাই একমত হলেও অধিকাংশ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। বিশেষত একই ব্যক্তি দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না বা একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা না হওয়ার যে প্রস্তাব সংস্কার কমিশন করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এসব সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার শামিল। কেননা, একটি দল সরকারে গেলে সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান কে হবেন বা থাকবেন, সেটা সংশ্লিষ্ট দলের গঠনতান্ত্রিক বিষয়। রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তা ছাড়া নির্বাচন কমিশন প্রণীত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ দ্বারা রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিয়ন্ত্রিত। নতুন করে রাজনৈতিক বিধিবিধান গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। 

এদিকে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা বরাবর পেশ করেছে, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছে কয়েকটি সংগঠন। ১৫টি মূল বিষয়সহ ৪৩৩টি প্রস্তাবনার একটিতে জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্য মোট আসন ৬০০ করে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। নারীদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষিত রাখার সুপারিশকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে করছেন অনেকে। কেননা, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বিলোপের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে।

এটা বলা অসমীচীন নয়, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্তরে কোটা পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সে প্রত্যাখ্যাত কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালের সুপারিশ নারী কমিশন কেন করল, বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ ধরনের কোটা নারীদের জন্য অবমাননাকর নয় কি? জাতীয় সংসদে নারীদের কোটায় আবদ্ধ রাখার অর্থ তাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করা। অথচ আমাদের দেশের নারীরা এখন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম।

মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে আমাদের গ্রামের মাথার বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আজিমের চায়ের দোকানে প্রায়ই আড্ডা জমে। ঢাকা থেকে গেলে আমিও অংশীজন হই। সেদিনও সে আড্ডায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছিল। কবে সংস্কার শেষ হবে, কবে নির্বাচন হবে– তা নিয়ে একেকজন তাদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত ব্যক্ত করছিলেন। এরই মধ্যে কলেজপড়ুয়া এক কিশোর ফোড়ন কেটে বলল, এর পর হয়তো সরকার ‘জাতিসংঘ সংস্কার কমিশন’ গঠন করে বলবে, নির্বাচন ওই সংস্কারের পর। ছেলেটির কথায় হাসির ফোয়ারা ছুটল আসরে। কারও কারও কাপ থেকে ছলকে পড়ে গেল কিছুটা চা।

মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক   

সম্পর্কিত নিবন্ধ