ইউনূস সরকারের সঙ্গে বিএনপির এবারই প্রথম মুখোমুখি বিরোধ হলো। বেশ কয়েক মাস ধরে বিএনপি নির্বাচনের সময়সূচি ও সরকারে জুলাই আন্দোলনের দুই উপদেষ্টাদের নিয়ে অসোন্তষ জানিয়ে আসছিল। তবে প্রবীণ নেতারাসহ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও চাচ্ছিলেন না, এত শিগগিরই ইউনূস সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি বিরোধে লিপ্ত হতে।

যেটা শুরু হয়েছিল ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অংশগ্রহণে তা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার আন্দোলনে। সমাজের সব স্তর থেকে নির্বাচন নিয়ে নানা অভিমত শোনা গেল। সেনাবাহিনীর অফিসার্স অ্যাড্রেসেও তা নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানা গেল। যে তিন পক্ষের অভিমত বেশি আলোচনায় এল, তারা হলো—সরকার, বিএনপি ও এনসিপি। সঙ্গে যোগ হলেন সেনাপ্রধান।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিরক্ত হলেন। অনেকে বলবেন, বিচলিতও হয়ে পদত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। সংকট আরও বাড়ার আগে সবাই আলোচনায় বসলেন।

কেউ অবস্থান থেকে নড়েননি

আলোচনা শেষে সংকট যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেল। কেউ কাউকে তেমন দোষ দিলেন না। নিজেদের পুরোনো দাবিগুলোই পুনর্ব্যক্ত করলেন। সবাই নিজ নিজ মতো স্পিন করে আপাতত সংকট ধামাচাপা দিলেন।

প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের কাছে ব্যক্ত করেছেন যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পর দেশের ভেতরে ও বাইরে একধরনের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘তারা বিভাজন সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না।’ মনে হয়, তিনি সমস্যার মূল কারণগুলো এড়িয়ে গেছেন।

বিএনপি বলেছে, তারা অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ চায়নি। শুধু নির্বাচনের তারিখ চেয়েছে। সেনাপ্রধানের প্রস্তাবকে ইতিবাচক অভিহিত করে বিএনপি নেতা আমীর খসরু বলেছেন, ‘তিনি (সেনাপ্রধান) বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। বিএনপিও তা–ই বলেছে।’ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘দ্রুত নির্বাচন হলে স্বচ্ছ-সুষ্ঠু হবে না, তাহলে ওই নির্বাচন কলঙ্কে পরিণত হবে।’

কেউ কারও অবস্থান থেকে একটুও নড়েননি। নিজ নিজ ডেরাতে ফিরে গিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবছেন। বিএনপি সভা-সমিতি করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার দাবি নিয়ে চাপ অব্যাহত রেখেছে।

কার কী লাভ–ক্ষতি হলো

অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের হুমকিকে কেউ বলেছেন ‘মাস্টার স্ট্রোক’, কেউ বলেছেন ‘অভিমান’। তবে অনেকে যেমনটি আশা করেছিলেন, অধ্যাপক ইউনূসের সরকারকে রাখার জন্য বিএনপি পিছু হটেনি। তারা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মেনে নিচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির খাতিরে। বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘ড.

ইউনূস না থাকতে চাইলে জনগণই ঠিক করবে কে অস্থায়ী সরকার চালাবে।’ মনে হচ্ছে, বিএনপি সরকারের ওপর চাপ কমাবে না। সরকার দিন দিন বেশ দুর্বল হবে বলে মনে হয়।

মেয়র পদের জন্য আন্দোলন ও পৌরসভার অফিস তালা দেওয়া ইত্যাদি জনগণের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করবেন, বিএনপি পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গেল কেন? তবে নির্বাচন নিয়ে যেসব বক্তব্য সামনে চলে এসেছে, তা বিএনপির অন্য সব কার্যক্রমকে আলোচনার বাইরে ফেলে দিয়েছে। বিএনপি নেতা আমীর খসরু বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে সেনাপ্রধান বক্তব্য দিলে সমস্যা কোথায়?’ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যেভাবে এগিয়েছে, তা বিএনপিকে উদ্দীপ্ত করেছে।

এনসিপি যে এই সংকটে খুব লাভবান হয়েছে, তা বলা যাবে না। এনসিপির আত্মবিশ্বাস হয়তো কিছুটা হোঁচট খেল। তারা মুখোমুখি গিয়ে বুঝল অর্ধশতক পুরোনো একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া নবীনদের পক্ষে সহজ নয়। একমাত্র ইসলামি দলগুলো এনসিপি ও সংস্কার নিয়ে সরকারের বক্তব্যগুলোকে কিছুটা সমর্থন দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ হিসেবে জামায়াতের নেতারা সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান।

মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল হক ও জোনায়েদ সাকির দল এবার আরও বিএনপি ঘেঁষা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। ছোট দলগুলোর নেতাদের জন্য তারেক রহমানের আগেভাগে মনোনয়ন আসন ছেড়ে দেওয়া একটা চৌকস রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। নির্বাচন বিষয়ে সেনাপ্রধানের মতপ্রকাশ নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কোনোভাবেই নেতিবাচক ছিল না। আরেকবার প্রমাণিত হলো যে দেশের জনগণ বিপদে সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখে।

বিএনপি এখন দারুণ উজ্জীবিত। তারা স্পষ্ট জয়ের সম্ভাবনা দেখছে। গত মার্চে ওয়াশিংটনে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান বলেছিলেন, বিএনপির অভ্যন্তরীণ জরিপে দেখা গেছে, আগামী এক বছরের মধ্যে কোনো নির্বাচন হলে তাঁর দল সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। গত দুই মাসের ঘটনাপ্রবাহ এ ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়েছে। এখন বিএনপির বড় ভয়, জয়টা যেন কোনোভাবে হাতছাড়া না হয়! বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য কিছু অসিলা বের করা হচ্ছে।’

জয়ের আভাস

সরকারের সঙ্গে টানাপোড়নে বিএনপির সাময়িক সাফল্যে সবখানে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হচ্ছে। বিএনপি এনসিপিকে কখনো খুব বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেনি। কিন্তু নির্বাচনের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসকে কীভাবে তারা মোকাবিলা করবে, তারা পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। তারা মনে করে, সেই পথটা তারা পেয়ে গেছে। ইউনূস সরকার দুর্বলতা দেখানোয় তাদের কাজটা আরও সহজ হয়ে গেছে।

একজন বিএনপি নেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারেক রহমান দেশে আসছেন না কেন? তিনি যা বললেন তা বেশ চমকপ্রদ, ‘একটা বড় দল ছোট দলগুলোর সঙ্গে খেলতে সাধারণত তাদের চৌকস ফরোয়ার্ডকে নামায় না। তাকে ধরে রাখে বড় দলগুলোর সঙ্গে খেলতে।’ বোঝা যাচ্ছে, সামনের নির্বাচনে বিএনপি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে খুব চিন্তিত নয়। তাদের একমাত্র সমস্যা, অধ্যাপক ইউনূস নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা না করা।

বিএনপি মনে করতে পারে, তাদের ক্ষমতায় আসা শুধু সময়ের ব্যাপার। তবে যতই সময় গড়াবে, তাদের ক্ষমতার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা হবে। তাই তারা সরকারের ওপর চাপ আরও বাড়াবে। অধ্যাপক ইউনূস সরকারের অধীন নির্বাচন করে নির্বাচিত হওয়া তাদের অগ্রাধিকার। এতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতার সুযোগ বেশি থাকবে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে গড়াচ্ছে, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে প্রয়োজনে তারা ইউনূস সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে।

অধ্যাপক ইউনূস প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন, শুধু নির্বাচন দেওয়ার জন্য তিনি সরকারে আসেননি। তাঁর লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার। সংকটের পরবর্তী পর্যায়ে অধ্যাপক ইউনূস কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সবার দৃষ্টি সেদিকে থাকবে।

প্রচলিত পথে বিএনপি

সরকার ও শাসনতন্ত্রে অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কার প্রচেষ্টা নিয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমান কখনো উৎসাহী ছিলেন না। তিনি বলেছেন, প্রয়োজন হলে তারা ক্ষমতায় গেলে সংস্কার করবেন। কী ধরনের সংস্কার করবেন, তা খোলাসা করে বলেননি। তবে বিএনপির কর্মপদ্ধতি দেখে মনে হয় না, তারা তাদের রাজনীতি বা মানসিকতার কোনো পরিবর্তন করেছে। তারা যে প্রচলিত রাজনীতির ধরন অনুসরণ করে ক্ষমতায় আসার প্রচেষ্টা চালাবে, এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এই প্রচলিত রাজনীতি অনুসরণ করে দেশের সব অঞ্চলে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ ধরনের প্রাধান্য বিস্তার হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ মেয়রের শপথ গ্রহণ করানোর চাপ সৃষ্টির জন্য যেভাবে সরকারি ভবনে তালা দেওয়া হয়েছে বা রাস্তাঘাট বন্ধ করে আন্দোলন করা হয়েছে, সেটাও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অতিপরিচিত। নির্বাচনের দাবিতে গত কয় দিনের প্রতিবাদ সভাগুলোতে বাসবোঝাই লোক আনা হচ্ছে এবং রাস্তাঘাট বন্ধ করা হচ্ছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হয়তো এর পুনরাবৃত্তি চলবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের এক নেতার হত্যাকে কেন্দ্র করে বিএনপির ছাত্র অঙ্গসংগঠন যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে এবং প্রশাসনে ভিসি, প্রক্টরকে পদত্যাগ করিয়ে নিজেদের লোকেদের বসাতে চাচ্ছে, সেটাও পুরোনো রীতিনীতির অনুলিপি। ২৬ মে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের সাদা দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স সভা করেছেন। একসময় মনে করা হচ্ছিল যে রাজনৈতিক দলগুলো লেজুড়বৃত্তি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ও শিক্ষকেরা বের হয়ে আসবেন। এখন মনে হচ্ছে, সেই ধারণা ভুল। সামনের দিনগুলোতে আশা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনে সাদা দল প্রভাব বিস্তার করবে এবং হয়তো হলগুলোতেও ছাত্রদলের একচেটিয়া দাপট বাড়বে।

এই সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পুরোনো পথেই হাঁটছে। তবে ক্ষমতায় গেলে তাদের রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হবে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই-মেইল: [email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউন স সরক র ত র ক রহম ন শ বব দ য ল ব শ বব দ য র জন ত ক পদত য গ প রচল ত ক ষমত য় ব এনপ র সরক র র র র জন বল ছ ন র জন য দলগ ল আরও ব এনস প

এছাড়াও পড়ুন:

‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ গাওয়ার পর পালিয়ে থাকতে হয়েছিল

শিল্পীর সৌজন্যে

সম্পর্কিত নিবন্ধ