ছবি: প্রথম আলো

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

মহানবী (সা.) কীভাবে ভুল সংশোধন করতেন

ভুল মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ। এটি আমাদের তওবা করতে, শিখতে ও জ্ঞানী হতে সাহায্য করে। মহানবী (সা.) ভুলকে লজ্জার কারণ নয়, বরং শিক্ষণীয় মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করতেন। সাহাবিরা কখনো ছোট, কখনো গুরুতর ভুল করতেন। নবীজি এই ভুলগুলো উপযুক্ত আচরণের মধ্য দিয়ে সংশোধন করতেন। মহানবী (সা.) ভুল সংশোধনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১. ভুলের সমাধান করা

মহানবী (সা.) ভুলকে সমাধান ছাড়া রেখে দিতেন না। তিনি ব্যক্তির সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে কখনো গোপনে, কখনো সুবিধামতো সময়ে ভুল সংশোধন করতেন। কখনো তাঁর আচরণই সাহাবিদের বুঝিয়ে দিত কিছু ভুল হয়েছে। গুরুতর ভুলের ক্ষেত্রে তিনি জোর দিয়ে বারবার কথা বলতেন।

তারা তাদের ভাইয়ের মাংস খেয়েছে, যা তাদের দাঁতের মাঝে দেখা যাচ্ছে। তারা নবীজির কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি বলেন, তাদের ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে।’সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৮০

উসামা ইবন জায়েদ (রা.) একবার একজন শত্রু সৈনিককে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার পরও তাঁর ওপর তরবারি চালিয়ে দেন। এটি শুনে নবীর মুখভঙ্গি বদলে যায়। তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘তুমি তাকে কীভাবে হত্যা করলে, যখন সে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বলেছিল?’ এই পুনরাবৃত্তির কারণে উসামা এতটাই অনুতপ্ত হন যে তিনি বলেন, তার মনে হয়, তিনি আজই মুসলিম হলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪,২৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৬)

আরও পড়ুনমহানবী (সা.) কীভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন১০ মে ২০২৫মক্কা বিজয়ের পর আবু মাহজুরা নামের এক কিশোর ও তার বন্ধুরা বিলাল (রা.)-এর আজানের সময় তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করে। নবীজি তাকে ডেকে পাঠান। ভয়ে কাঁপতে থাকা কিশোরকে তিনি তিরস্কার করেননি।

২. সৌজন্য বজায় রাখা

নবীজি সাহাবিদের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি ভুল সংশোধনের সময়ও সৌজন্যবোধ হারাতেন না।

একবার এক বেদুইন মসজিদে প্রথমবার প্রবেশ করেন। তিনি উচ্চস্বরে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে ও মুহাম্মদকে ক্ষমা করো, কিন্তু অন্য কাউকে ক্ষমা করো না।’ নবীজি (সা.) হাসেন ও সৌজন্যের সঙ্গে বলেন, ‘তুমি একটি বিশাল জিনিসকে সীমিত করছো।’

সেই লোকই বা অন্য কোনো লোক মসজিদের মেঝেতে প্রস্রাব করেন। নবীজি বিচলিত সাহাবিদের শান্ত করেন এবং লোকটিকে একা ছেড়ে দিতে বলেন। বেদুইন পরে বলেন, ‘আমার মা-বাবা তাঁর জন্য উৎসর্গ হোক। তিনি আমাকে তিরস্কার বা অপমান করেননি।’ তিনি কেবল বলেছেন, ‘এই মসজিদে প্রস্রাব করা যায় না, এটি নামাজ ও আল্লাহর স্মরণের স্থান। তারপর তিনি এক বালতি পানি এনে মেঝেতে ঢেলে দিতে বলেন।’ (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদিস: ৫২৯)

৩. কৌশলী হওয়া

নবীজি অগ্রাধিকার বিবেচনা করতেন, সমস্যার সমাধান দিতেন এবং জানতেন কখন কঠোর বা নরম হতে হবে। তিনি বুঝতেন, কখন কেউ ভুলের পরিণতি বহন করতে পারবে।

মক্কা বিজয়ের পর আবু মাহজুরা নামের এক কিশোর ও তার বন্ধুরা বিলাল (রা.)-এর আজানের সময় তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করে। নবীজি তাকে ডেকে পাঠান। ভয়ে কাঁপতে থাকা কিশোরকে তিনি তিরস্কার করেননি। তিনি তার কণ্ঠ পরখ করেন, আজানের শব্দগুলো তাকে শেখান এবং তার বুকে হাত রেখে দোয়া করেন। আবু মাহজুরা পরে মক্কার মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পান। (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদিস: ৭১৫)

৪. অযথা কঠোরতা প্রয়োগ না করা

কখনো কখনো কঠোরতা ব্যক্তিগত সংশোধনের জন্য জরুরি। তিনি জানতেন কখন কঠোর বা নরম হতে হবে।

যখন দুজন সাহাবি পরনিন্দা করছিলেন, নবীজি কঠোর শব্দে বলেন, ‘তারা তাদের ভাইয়ের মাংস খেয়েছে, যা তাদের দাঁতের মাঝে দেখা যাচ্ছে। তারা নবীজির কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি বলেন, তাদের ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৮০)

আরেকবার তরুণ ফজল ইবন আল-আব্বাস (রা.) নবীজির সঙ্গে সওয়ার ছিলেন। এক সুন্দরী নারী প্রশ্ন করতে এলে ফজল তাকিয়ে থাকেন। নবীজি তাঁর চিবুক ধরে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২২৮)

আবু লুবাবা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন তিনি নবীর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। তিনি মসজিদে গিয়ে নিজেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শপথ করেন, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তিনি নড়বেন না।আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন০৯ মে ২০২৫

৫. মানুষের মর্যাদা রক্ষা করা

নবীজি ভুলের সমালোচনা করতেন, ব্যক্তিকে নিন্দা করতেন না।

একবার কিছু লোক মদ্যপানে মাতাল এক ব্যক্তিকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন। নবীজি বলেন, ‘তাকে অভিশাপ দিয়ো না… আমি জানি, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮০)

এক যুবক রাতের নামাজ অবহেলা করছিলেন। নবীজি তাঁকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘আবদুল্লাহ কত চমৎকার মানুষ, যদি সে রাতে নামাজ পড়ত…’ এরপর আবদুল্লাহ কখনো রাতের নামাজ ত্যাগ করেননি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৪৭০)

তাকে অভিশাপ দিয়ো না… আমি জানি, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮০

৬. দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা

আবার আবু লুবাবা (রা.) বনু কুরাইজার কাছে দূত হিসেবে গিয়ে এমন ভঙ্গি করেন, যা মুসলিমদের পরিকল্পনা প্রকাশ করতে পারত। তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন তিনি নবীর বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। তিনি মসজিদে গিয়ে নিজেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শপথ করেন, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত তিনি নড়বেন না। অবশেষে তাঁর ক্ষমার আয়াত নাজিল হয়। নবীজি নিজ হাতে তাঁকে খুলে দেন। (তাফসির ইবন কাসির, সুরা তাওবা, আয়াত: ১০২)

তাবুকের যুদ্ধে তিনজন সাহাবি নবীজির সঙ্গে যাননি। মুনাফিকরা মিথ্যা অজুহাত দেখালে নবী তাঁদের ক্ষমা করেন, কিন্তু এই তিনজন সত্য স্বীকার করেন যে তাঁদের কোনো যথাযথ অজুহাত নেই। তাঁদের এক মাসের বেশি সময় সবাই বর্জন করেন, যা ছিল তাঁদের জন্য কঠিন পরীক্ষা।

তবে এই প্রক্রিয়া তাঁদের পবিত্র করে এবং আল্লাহ তাঁদের ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে আয়াত নাজিল করেন। নবীজি বলেন, ‘সকল মানুষ প্রায়ই ভুল করে। যারা প্রায়ই ভুল করে, তাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা আল্লাহর কাছে তওবা করে।’ (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২,৩৩৯)

সূত্র: মুসলিম ম্যাটার্স

আরও পড়ুনকঠিন সময়ে মহানবী (সা.)-এর জয়ের কৌশল১১ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ