রাঙামাটির কুতুকছড়ি বাজারে রাস্তার ওপর সারি সারি আনারসের স্তূপ। ব্যাপারীর জন্য অপেক্ষা করছেন বাগানি ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। সেখানে কথা হয় বাগানি এফেন চাকমার সঙ্গে। তিনি ১৪ হাজার আনারসের চারা রোপণ করেছিলেন। সেই আনারসের কিছু বিক্রির জন্য এনেছেন বাজারে। চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি সদর থেকে ব্যাপারীরা গেলে এসব আনারস বিক্রি করবেন। আনারস ছাড়াও অন্যান্য ফলের চাষও করেন তিনি।

এবার পাহাড়ে আনারসের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানান বাগানিরা। সে কারণে দাম তুলনামূলকভাবে কম। এ ছাড়া সদ্য শেষ হওয়া কুল, বাউকুল, কমলা, রাম্বুটান, জাম্বুরাসহ অন্যান্য ফলের ফলনও বাড়ছে তিন পার্বত্য জেলায়। আর পেঁপের আবাদ বছরজুড়ে। এখন বাগানিদের অপেক্ষা আম, কাঁঠালের।

পার্বত্য অঞ্চলে প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফলের আবাদও দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে লটকন, কমলা, ড্রাগন, বলসুন্দরী কুল, রাম্বুটান, কাজুবাদাম, কফি, মাল্টা, কামরাঙা, সফেদার চাষ বেড়েছে। বেড়েছে আয়ও। গত অর্থবছরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ফল বিক্রি হয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, দুভাবেই ফলের চাষ হচ্ছে পাহাড়ে। কৃষি সম্প্রসারণ রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো.

নাসিম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ফলের উৎপাদন দিন দিন বেড়েই চলছে। এবার আগাম আনারস হয়েছে প্রচুর। পাহাড়ে নিত্যনতুন ফলের আবাদ হচ্ছে। পাহাড়ের মাটি অত্যন্ত উর্বর। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে নানা ধরনের ফল চাষে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই দশক আগে পাহাড়ে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ শুরু হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফল উৎপাদিত হয় প্রায় ১৯ লাখ টন। মোট বাগান এলাকা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৭২৯ হেক্টর। এর আগের অর্থবছরে মোট ফলের উৎপাদন ছিল প্রায় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার টন। মোট বাগান এলাকা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ২১১ হেক্টর।

যেসব ফলের চাষ হয়    
— তিন পার্বত্য জেলায় যেসব ফলের আবাদ ও ফলন বাড়ছে আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস, লিচু, মাল্টা, ড্রাগন, কুল, বাউকুল, আপেল কুল, রাম্বুটান, জাম্বুরা, লটকন, কমলা, বলসুন্দরী কুল, কাজুবাদাম, কফি, কামরাঙা ও সফেদা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটি অঞ্চলের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, গত অর্থবছরে টাকার অঙ্কে ফলের উৎপাদন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

সরেজমিন চিত্র

আনারস ও কমলার জন্য বিখ্যাত রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা। উপজেলার ঘিলাছড়ি রাবারবাগান এলাকায় দেখা যায়, বাগান থেকে কমলা তুলে এনে রাস্তার পাশে স্তূপ করছেন বাগানি নির্মল চাকমা। তাঁর সঙ্গে পাড়া–প্রতিবেশীরাও যোগ দেন এই কাজে। রাস্তার পাশ থেকে এগুলো ট্রাকে তুলছিলেন দুই শ্রমিক। এই কমলা যাবে চট্টগ্রামে। নির্মল চাকমা বলেন, ১৮ হাজার চারা রোপণ করেছেন তিনি। ফলনও ভালো হয়েছে। তবে পার্বত্য এলাকায় এবার ভালো ফলন হওয়ায় দাম তুলনামূলক কম।

ঘিলাছড়ি থেকে আনারস তুলে কেউ রাস্তার পাশে, কেউবা কাছাকাছি কুতুকছড়ি বাজারে জড়ো করেন। সেখান থেকে ব্যাপারীরা কিনে নিয়ে যান। রবি ও বৃহস্পতিবার রাঙামাটির সাপ্তাহিক বনরূপা বাজারে বেচাবিক্রি বেশি ভালো হয় বলে জানান বাগানিরা। কুতুকছড়ি বাজারে আকার অনুযায়ী, প্রতি ১০০ আনারস ৮০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়।

খাগড়াছড়ির মহালছড়ির লাচিমংয়ের ৪০ একরের বেশি বাগান রয়েছে। জেলার কয়েকজন শীর্ষ বাগানির মধ্যে তিনি অন্যতম। আম, আনারস, ড্রাগন ও মাল্টার আবাদ হয় তাঁর বাগানে। এ বছর ড্রাগন ও মাল্টার ব্যাপক ফলন হয়েছে তাঁর বাগানে। কৃষি পুরস্কার পাওয়া লাচিমং বলেন, পাহাড়ে প্রতিবছর বাগান যেমন বাড়ছে, তেমনি ফলের উৎপাদনও বাড়ছে। নতুন নতুন অপ্রচলিত ফলের চাষও হচ্ছে।

আম–আনারসের পাশে কাজুবাদাম

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলায় একসময় ৪০টির মতো ফল উৎপাদিত হতো। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে ৫০ ছাড়িয়েছে। তবে তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত মোট ফলের প্রায় ৮৫ শতাংশই আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, আনারস, লিচু, মাল্টা ও ড্রাগন। গত ১০ বছরে পাহাড়ে আম, পেঁপে ও আনারস চাষের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এ কারণে গত অর্থবছর আমের ফলন হয়েছে দুই লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম হয় বান্দরবানে ১ লাখ ১২ হাজার টনের বেশি। রাঙামাটিতে ৩৬ হাজার ২০০ টন ও খাগড়াছড়িতে আমের ফলন ছিল সাড়ে ৫৪ হাজার টন। গত অর্থবছরে তিন পার্বত্য জেলায় আনারস উৎপাদন হয় দুই লাখ টনের বেশি। আর পেঁপে উৎপাদিত হয় ১ লাখ ৮১ হাজার টন।

কৃষি বিভাগের হিসাবে, তিন পার্বত্য জেলায় মোট বাগানির সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। সারা দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ১৫ শতাংশ আসে এসব জেলা থেকে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে যায় এসব ফল। বর্তমানে অনলাইনে বিক্রি বাড়ছে।

একসময় শীতকালে পাহাড়ে দেশি সাধারণ কুলের ফলন হতো। এরপর বাউকুল, আপেল কুল চাষ শুরু হয়। এখন বল সুন্দরী বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে পাহাড়ে। রাঙামাটির সুশান্ত তঞ্চঙ্গ্যা জানান, ‘কয়েক বছর ধরে বল সুন্দরী আবাদ করছি। এতে বেশ লাভবানও হচ্ছি। এ ছাড়া নতুন নতুন নানা ফলের আবাদ শুরু করেছি।’

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এবার ২১ হাজার ১৭২ টন কুল উৎপাদিত হয়েছে তিন পার্বত্য জেলায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়ে ১১ হাজার টন উৎপাদিত হয় বান্দরবানে। এ ছাড়া ২ হাজার ৮৭৪ টন কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়েছে। পাঁচ বছর আগেও তিন পার্বত্য জেলায় কাজুবাদামের চাষ সেভাবে হতো না।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফল র চ ষ হ জ র টন ত ফল র স ন দর র ফলন

এছাড়াও পড়ুন:

সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে

সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এ ব্যয় বহন করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাজেটে সরকারের সুদ পরিশোধ সংক্রান্ত পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে সুদ ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে।

পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৫ ভাগ অর্থই সুদ খাতে খরচ করতে হচ্ছে এখন। এ পরিস্থিতিতে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতেই ব্যয় করতে হবে চার লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শতাংশের হিসাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাড়বে।

অর্থ বিভাগের করা ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি-২০২৫-২০২৬ থেকে ২০২৭-২০২৮’ এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হয়েছিল এক লাখ  ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ খাতে সুদ ব্যয় ছিল ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় গেছে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে (যা চলতি জুনের ৩০ তারিখে শেষ হয়ে যাবে) মূল বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে এই সীমায় সুদ ব্যয় ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ হিসাবের মধ্যে ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের ২২ হাজার কোটি টাকা।

একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়েরও একটি প্রক্ষেপণ করেছে অর্থ বিভাগ। এই হিসেবে দেখা যায় আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয় হবে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (অভ্যন্তরীণ এক লাখ কোটি টাকা , বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ২২ হাজার কোটি টাকা)। একইভাবে এর পরের অর্থবছর ২০২৬-২০২৭ অর্থবছরে একলাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা(অভ্যন্তরীণ এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে সুদ খাতে ব্যয়ের  প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। 

অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে,  মোট সুদ ব্যয়ের সিংহভাগই অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে  ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে এক লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গিয়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মোট বাজেটের অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সুদ পরিশোধের হার ২০২৩ -২০২৪ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ মোট সুদ ব্যয়ের তুলনায় কম, তবে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে এটি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৭-২০২৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। মোট বাজেটের অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ এ সময়কালে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।

বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের কার্যকর ব্যবস্থাপনা শুধু আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যই নয়, বরং এটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক ঋণমান বজায় রাখা এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন সম্ভাবনা সুরক্ষিত রাখার জন্য অপরিহার্য।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাঁচ বছরে বাড়বে ৬৫ শতাংশ
  • ডিজিটাল খাতে বাজেটের প্রভাব কেমন
  • সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে
  • ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ে বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ বিএসইসির
  • বেসরকারি খাত পিপিপিতে আকৃষ্ট নয়, বরাদ্দ ৫ হাজার কোটি টাকা
  • কমপ্লায়েন্সের অভাবে ধুঁকছে চামড়া খাতের রপ্তানি