ওয়াক্ফ আইন ইস্যুতে থমথমে মুর্শিদাবাদ, আতঙ্ক
Published: 14th, April 2025 GMT
ভারতে ওয়াক্ফ আইনের বিতর্কিত সংস্কারের প্রতিবাদে সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজ্যের অপর এলাকা শমসেরগঞ্জে এখনও শান্তি ফেরেনি। শনিবার রাতেও এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত দেড়শ জনকে। নতুন হামলার শঙ্কায় ও গ্রেপ্তার এড়াতে বহু মানুষ ঘরছাড়া।
হাইকোর্টের নির্দেশে গত শনিবারই মুর্শিদাবাদে ভারতের কেন্দ্রীয় বাহিনী (আধা সেনা) মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু জনমনে আতঙ্ক এখনও কাটেনি। সূত্র জানায়, শনিবার রাতে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় বিএসএফ গুলি চালায়। আহত সামশের নাকাব নামের ওই যুবকের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানে। গতকাল রোববার সকালে ‘রোড মার্চ’ করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বহু মানুষ ঘরছাড়া। তাদের আশ্বস্ত করে ঘরে ফেরাতে পথে নেমেছেন জনপ্রতিনিধিরা। এলাকায় শান্তি ফেরাতে রাজ্য পুলিশের ডিজিপি বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রে থাকা বিজেপি সরকার সংসদের দু’কক্ষে ওয়াক্ফ আইনের সংশোধনী পাস করে। এর মাধ্যমে মুসলমানদের সম্পত্তিবিষয়ক ওয়াক্ফ বোর্ডে অন্য ধর্মের প্রতিনিধি রাখার আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। ভারতের মুসলমানরা এটাকে চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, হিন্দু ও শিখদের ধর্মীয় বিষয়ে অন্য ধর্মের প্রতিনিধি না থাকলেও মুসলমানদের বেলায় তা করা হচ্ছে। অনেকে সংস্কার ওয়াক্ফ আইনকে ভারতের মুসলোনদের ভূমি ছিনিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি মুসলিমবিদ্বেষী দল হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলেও তাদের কোনো মুসলমান সংসদ সদস্য নেই।
এ আইন পাস নিয়েই ভারতজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতা ঘটেছে। সহিংসতা ঠেকাতে শমসেরগঞ্জে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৬৩ ধারা জারি করা হয়। সেখানে থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে বন্ধ রয়েছে সব দোকানপাট।
এক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবঙ্গে এ সহিংসতা চলছে। ইতোমধ্যে তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেছে একজনের। বাড়িতে ঢুকে দুষ্কৃতির তাণ্ডবে নিহত হয়েছেন বাবা-ছেলে। অনেক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। ফারাক্কা আসনের বিধায়কের ওপর হামলা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে দোকানে দোকানে। মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন কলকাতা হাইকোর্ট।
উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর সেখানে পৌঁছান রাজ্যের ডিজিপি রাজীব কুমার। তিনি বিএসএফ সদস্যদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। পরে জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নেমে ‘রোড মার্চ’ করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সহিংসতা ঠেকাতে রাজ্য পুলিশের ব্যর্থতার অভিযোগ উঠছে। তবে জঙ্গিপুরের সংসদ সদস্য খলিলুর রহমান বলেছেন, রাজ্য পুলিশের প্রচেষ্টায় এলাকায় শান্তি ফিরছে। মুখ্যমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ।
রোববার সকালে শমসেরগঞ্জে যান মালদহ দক্ষিণের সংসদ সদস্য ইশা খান চৌধুরী। মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছেন রানাঘাটের বিজেপি সংসদ সদস্য জগন্নাথ সরকার। এক ধাপ এগিয়ে মুর্শিদাবাদে ‘আফস্পা’ দাবি করেছেন পুরুলিয়ার বিজেপি সংসদ সদস্য জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো।
রাজনৈতিক দলের রশি টানাটানির মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো হলেও সাধারণ মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। আতঙ্ক ও আস্থার অভাবে লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা নিয়ে কেউ এখনও নিশ্চিত নন।
অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে গত শুক্রবার থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে। ধুলিয়ান ফেরিঘাট পার হয়ে ৫০০ শতাধিক নারী-পুরুষ আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী মালদার কালিয়াচক ৩ নম্বর ব্লকের বৈষ্ণবনগরের পারলালপুর হাইস্কুলে। প্রশাসনের তরফে সেখানে খাবার বিতরণ চলছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর স থ ত ম সলম ন আতঙ ক
এছাড়াও পড়ুন:
মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ
১৮৮৬ সালের ১ মেÑএকটি দিন, একটি দাবি, আর হাজারো শ্রমিকের আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে রক্তাক্ত দাগ কেটে দিয়েছিল যে মুহূর্ত, তা আজ বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তখনকার দাবিটি ছিল স্রেফ ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের দাবি শুধু সময়
নয়Ñমর্যাদা, সুরক্ষা ও ন্যায্যতার প্রশ্নও।
এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য “শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে”Ñএ যেন সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বার্তা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, বরং তা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য এক যৌথ দিকনির্দেশনা।
বাংলাদেশের শ্রমচিত্র ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ, কৃষি ও নির্মাণ খাতে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিয়োজিত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে শ্রমনির্ভর খাত থেকে। কিন্তু যাঁরা এই অর্থনীতির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছেন, সেই শ্রমিকরা কি পেয়েছেন তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা?
দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও বহু শ্রমিক পান না ন্যূনতম মজুরি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা কিংবা ছুটি সংক্রান্ত মৌলিক সুবিধা। নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও জটিলÑযত্রতত্র হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব, কিংবা নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে না তোলার ফলে এই খাতেও স্থিতিশীলতা আসছে না।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক: দ্বন্দ্ব নয়, দরকার সহমর্মিতা
এক সময় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক মানেই ছিল দ্বন্দ্ব, ধর্মঘট ও হুমকি। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছেÑসহযোগিতাই টেকসই উৎপাদনের চাবিকাঠি। মালিকপক্ষ যখন শ্রমিককে কেবল “ব্যয়” হিসেবে না দেখে “সম্পদ” হিসেবে বিবেচনা করেন, তখন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। একইভাবে শ্রমিকও যদি বুঝেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মানে তার কর্মস্থলের স্থায়িত্বÑতাহলে দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের
ভিত্তি গড়ে ওঠে।
এই বিশ্বাস গঠনের জন্য প্রয়োজন তিনটি স্তম্ভ:
নীতিগত স্বচ্ছতা Ñ ন্যায্য মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা দায়িত্বশীল মালিকপক্ষ Ñ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে উদ্যোগ সচেতন শ্রমিকশ্রেণি Ñ অধিকার আদায়ের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের মানসিকতা
নীতি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত ২০১৮ সংস্করণ অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেমন কৃষি, গৃহপরিচারিকা, গিগ-ওয়ার্কার) শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনও প্রায় উপেক্ষিত।
এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা বীমা, এবং পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হওয়া জরুরি। সরকার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলেও তা অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে’ দেশ গড়ার বার্তাটি যেন শুধুই স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এটি হোক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক বিনিয়োগ ও মানবিক বিবেচনার এক বাস্তব প্ল্যাটফর্ম।
প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও নতুন শ্রম বাস্তবতা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শ্রমবাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ও গিগ-ইকোনমি অনেক চাকরি বিলুপ্ত করছে, আবার নতুন দক্ষতা চাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়, তাহলে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পুনঃস্কিলিং এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এখানে মালিক ও রাষ্ট্র উভয়ের উচিত হবে, শ্রমিককে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিনিয়োগ করা, কারণ দক্ষ শ্রমিক ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকে না।
মে দিবস: উৎসব নয়, দায়বদ্ধতার প্রতীক
মে দিবস কেবল লাল পতাকা হাতে শোভাযাত্রার দিন নয়, এটি আমাদের মানবিক চেতনার প্রতিফলন। যে শ্রমিক ঘাম ঝরিয়ে ভবন গড়ে, কৃষি জমি চষে, রপ্তানি পণ্য তৈরি করেÑতার জন্য আমাদের উচিত মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।
এবছর, আসুন আমরা সবাই রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকÑএকটি মানবিক, উৎপাদনশীল ও শীদারিত্বভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যাই। শ্রমিকের হাতে গড়া এই বাংলাদেশ হোক তার জন্যই গর্বের জায়গা।
লেখক পরিচিতি:
মীযানুর রহমান
সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক
মোবাইলঃ ০১৭৫৪১০৯০৭২
যোগাযোগ: : [email protected]