ভারতে ওয়াক্ফ আইনের বিতর্কিত সংস্কারের প্রতিবাদে সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজ্যের অপর এলাকা শমসেরগঞ্জে এখনও শান্তি ফেরেনি। শনিবার রাতেও এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত দেড়শ জনকে। নতুন হামলার শঙ্কায় ও গ্রেপ্তার এড়াতে বহু মানুষ ঘরছাড়া।

হাইকোর্টের নির্দেশে গত শনিবারই মুর্শিদাবাদে ভারতের কেন্দ্রীয় বাহিনী (আধা সেনা) মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু জনমনে আতঙ্ক এখনও কাটেনি। সূত্র জানায়, শনিবার রাতে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় বিএসএফ গুলি চালায়। আহত সামশের নাকাব নামের ওই যুবকের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার ধুলিয়ানে। গতকাল রোববার সকালে ‘রোড মার্চ’ করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। গ্রেপ্তার আতঙ্কে বহু মানুষ ঘরছাড়া। তাদের আশ্বস্ত করে ঘরে ফেরাতে পথে নেমেছেন জনপ্রতিনিধিরা। এলাকায় শান্তি ফেরাতে রাজ্য পুলিশের ডিজিপি বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। 

সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রে থাকা বিজেপি সরকার সংসদের দু’কক্ষে ওয়াক্ফ আইনের সংশোধনী পাস করে। এর মাধ্যমে মুসলমানদের সম্পত্তিবিষয়ক ওয়াক্ফ বোর্ডে অন্য ধর্মের প্রতিনিধি রাখার আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। ভারতের মুসলমানরা এটাকে চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, হিন্দু ও শিখদের ধর্মীয় বিষয়ে অন্য ধর্মের প্রতিনিধি না থাকলেও মুসলমানদের বেলায় তা করা হচ্ছে। অনেকে সংস্কার ওয়াক্ফ আইনকে ভারতের মুসলোনদের ভূমি ছিনিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি মুসলিমবিদ্বেষী দল হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলেও তাদের কোনো মুসলমান সংসদ সদস্য নেই। 

এ আইন পাস নিয়েই ভারতজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতা ঘটেছে। সহিংসতা ঠেকাতে শমসেরগঞ্জে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৬৩ ধারা জারি করা হয়। সেখানে থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে বন্ধ রয়েছে সব দোকানপাট। 

এক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবঙ্গে এ সহিংসতা চলছে। ইতোমধ্যে তিনজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। পুলিশের গুলিতে প্রাণ গেছে একজনের। বাড়িতে ঢুকে দুষ্কৃতির তাণ্ডবে নিহত হয়েছেন বাবা-ছেলে। অনেক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে লুটপাট করা হয়েছে। ফারাক্কা আসনের বিধায়কের ওপর হামলা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে দোকানে দোকানে। মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেন কলকাতা হাইকোর্ট। 

উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর সেখানে পৌঁছান রাজ্যের ডিজিপি রাজীব কুমার। তিনি বিএসএফ সদস্যদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। পরে জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নেমে ‘রোড মার্চ’ করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সহিংসতা ঠেকাতে রাজ্য পুলিশের ব্যর্থতার অভিযোগ উঠছে। তবে জঙ্গিপুরের সংসদ সদস্য খলিলুর রহমান বলেছেন, রাজ্য পুলিশের প্রচেষ্টায় এলাকায় শান্তি ফিরছে। মুখ্যমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ। 

রোববার সকালে শমসেরগঞ্জে যান মালদহ দক্ষিণের সংসদ সদস্য ইশা খান চৌধুরী। মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি দিয়েছেন রানাঘাটের বিজেপি সংসদ সদস্য জগন্নাথ সরকার। এক ধাপ এগিয়ে মুর্শিদাবাদে ‘আফস্পা’ দাবি করেছেন পুরুলিয়ার বিজেপি সংসদ সদস্য জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো।

রাজনৈতিক দলের রশি টানাটানির মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো হলেও সাধারণ মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। আতঙ্ক ও আস্থার অভাবে লোকজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা নিয়ে কেউ এখনও নিশ্চিত নন।

অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে গত শুক্রবার থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন অনেকে। ধুলিয়ান ফেরিঘাট পার হয়ে ৫০০ শতাধিক নারী-পুরুষ আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী মালদার কালিয়াচক ৩ নম্বর ব্লকের বৈষ্ণবনগরের পারলালপুর হাইস্কুলে। প্রশাসনের তরফে সেখানে খাবার বিতরণ চলছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর স থ ত ম সলম ন আতঙ ক

এছাড়াও পড়ুন:

গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও

রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।

গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।

পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়। 

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো। 

ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।” 

তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।” 

আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”

রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”

গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।

গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।” 

উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।

ঢাকা/আমিরুল/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি ট্রাম্পের
  • থমথমে পরিস্থিতিতে এক পক্ষের বিক্ষোভের ডাক
  • মেসি বনাম ইয়ামাল: ফিনালিসিমার সময়-সূচি ঘোষণা
  • গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও