শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের একই আইনজীবী নিয়ে বার্গম্যানের প্রশ্ন
Published: 4th, August 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। তাঁর অনুপস্থিতিতে গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে এ বিচার শুরু হয়।
এ নিয়ে গতকাল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তিনি বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখে আসছেন।
পোস্টে ডেভিড বার্গম্যান লিখেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশে আজ (রোববার) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচারের প্রথম দিন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমার কিছু উদ্বেগ রয়েছে:
এক.
আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত এক আইনজীবী, দুই মক্কেল
ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার পক্ষে যে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি কেবল সাবেক প্রধানমন্ত্রীরই নন, তাঁর সঙ্গে অভিযুক্ত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানেরও আইনজীবী। আসাদুজ্জামান খানও পলাতক। এটি বড় ধরনের সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাতের সমস্যা তৈরি করে, যা তাঁদের প্রত্যেকের যথাযথ আইনি সুরক্ষাপ্রাপ্তিতে বাধা। কারণ, বিচারে এই দুই অভিযুক্ত ব্যক্তির স্পষ্টতই একেবারে ভিন্ন স্বার্থ থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ওপর দায় চাপাতে পারেন অথবা এর উল্টোটাও হতে পারে।
প্রত্যেক পলাতক আসামির পক্ষে অবশ্যই আলাদা একজন আইনজীবী থাকা উচিত। সিদ্ধান্তটি ট্রাইব্যুনালকেই নিতে হবে।
দুই. আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রস্তুতির সময়
দুই অভিযুক্ত ব্যক্তির রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ২৫ জুন ২০২৫ তারিখে, অর্থাৎ বিচার শুরুর পাঁচ সপ্তাহ আগে প্রসিকিউশনের সরবরাহ করা সব সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়েছেন। আমি মনে করি, (এই সময়ের মধ্যে) কোনো আইনজীবীর পক্ষে উভয় মক্কেলের জন্য যথাযথ আত্মপক্ষ সমর্থনের কৌশল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করা অসম্ভব। বিশেষ করে যখন আইনজীবী তাঁর মক্কেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, শেখ হাসিনা ও (আসাদুজ্জামান) খানের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রস্তুতির জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে আরও সময় চেয়ে আবেদনও করেননি। যখন আমি আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তিনি আজ শুনানি মুলতবির আবেদন করেননি? তখন তিনি বলেন, ‘যখন প্রয়োজন হবে, তখনই তিনি মুলতবির আবেদন করবেন এবং তিনি আজ প্রথম সাক্ষীকে জেরা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।’
আমি মনে করি, আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, হাসিনার যদি নিজস্ব আইনজীবী উপস্থিত থাকতেন, তাহলে তাঁরা অবশ্যই শুনানি মুলতবির আবেদন করতেন। আর বাস্তবতা হলো, বর্তমান রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী এই আবেদন করেননি, যা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
তিন. সাক্ষ্যের ‘বৈপরীত্য’ নিয়ে জেরা বন্ধ করলেন প্রসিকিউশন/ট্রাইব্যুনাল
(জামায়াত নেতা) কাদের মোল্লার যুদ্ধাপরাধ মামলায় (যেখানে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় হয়েছিল এবং যেটি শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল) ২০১৩ সালের আপিল বিভাগের একটি রায় ব্যবহার করে প্রসিকিউটররা আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীকে প্রথম সাক্ষীকে জেরা করা থেকে বিরত রাখেন। এই জেরা ছিল পূর্বে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে যা বলেছিলেন এবং আজ আদালতে যা বলেছেন, দুই বক্তব্যের মধ্যে বৈপরীত্য নিয়ে। এ ধরনের জেরা বাংলাদেশের সাধারণ ফৌজদারি আদালতগুলোয় একটি প্রচলিত প্রথা।
যে পরিহাসের ঘটনা, এমনকি এর চেয়েও শক্তিশালী কোনো শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যেতে পারে!—প্রসিকিউশন আইনজীবীরা যা করেছেন, সেটি খুবই চোখে পড়ার মতো। এক দশক আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে অনুষ্ঠিত আগের বিচারগুলোতে, যেখানে মূলত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার হয়েছিল, তৎকালীন প্রসিকিউটররাও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দুটি সাক্ষ্যের মধ্যে থাকা বৈপরীত্য তুলে ধরা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলেন।
ওই সময় জামায়াতের আইনজীবীরা, যাঁদের মধ্যে তাজুল ইসলাম ও অন্য যাঁরা বর্তমানে প্রসিকিউটর দলের অংশ, তাঁরা তখন প্রসিকিউশনের বিরুদ্ধে জোরালো যুক্তি দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, এটি খুবই অন্যায়, কারণ, এটি তাঁদের সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। যখন কাদের মোল্লার মামলায় বিষয়টি আপিল বিভাগে আসে, তখন প্রধান বিচারপতি সিনহা (এস কে সিনহা) তাঁর রায়ে প্রসিকিউশনের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, আইসিটি আইন ও বিধিতে এ সুযোগ নেই।
সুতরাং, এখন আমরা এমন একটি পরিস্থিতি দেখছি, যেখানে বর্তমানে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সেই একই আপিল বিভাগের রায় ব্যবহার করছেন, যে রায়ের ফলে তিনি একসময় যেসব ব্যক্তির পক্ষে আইনি লড়াই করেছিলেন তাঁদের একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল। সেই একই নিয়ম তিনি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন, যা তিনি অতীতে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জন্য অত্যন্ত অন্যায্য বলে মনে করেছিলেন আর ট্রাইব্যুনাল বিচারকেরা তা মেনে নিয়েছেন।
আরও পড়ুনমানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিচার শুরু ৯ ঘণ্টা আগেআমি যখন তাজুল ইসলামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন তিনি বললেন, ‘আইন পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এটি আপিল বিভাগের নির্দেশনা।’
জেরার শেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীকে ‘একটি ভালো জেরা’ করার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বরং অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীর জেরা করার ক্ষমতা যখন উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে, তখন তিনি কীভাবে এমন মন্তব্য করতে পারেন, তা পরিষ্কার নয়।
যদি ট্রাইব্যুনাল আপিল বিভাগের সেসব রায় অনুসরণ করতে থাকেন, যা এখন সাধারণত অত্যন্ত বিতর্কিত ও অন্যায্য বলে বিবেচিত, তাহলে সরকারের উচিত আইন পরিবর্তন করা, যাতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে সাক্ষীরা যা বলেছিলেন ও আদালতে তাঁরা যা বলেছেন, দুটোর মধ্যে বৈপরীত্যের ভিত্তিতে তাঁদের জেরা করার সুযোগ পান।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আপ ল ব ভ গ র আস দ জ জ ম ন আইনজ ব র ব পর ত য বল ছ ল ন অন য য র জন য ইসল ম অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সেই ১৮৭ শিক্ষার্থীর তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা নিতে নির্দেশ
সাভারের আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সেই ১৮৭ শিক্ষার্থী সমাজকর্ম, পরিসংখ্যান ও ভূগোল—এই তিন বিষয়ে পরীক্ষায় বসতে পারবেন। তাঁদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া ভূগোল ও পরিসংখ্যান পরীক্ষা আবারও নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৭ ও ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য সমাজকর্ম বিষয়ে ১৮৭ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার রুলসহ এ আদেশ দেন। ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা গত ২৬ জুন শুরু হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ১৮৭ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সমাজকর্ম, পরিসংখ্যান ও ভূগোল পরীক্ষার আয়োজনে নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. বাকির হোসেন মৃধা গত সপ্তাহে রিটটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও তানিম খান এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইকরামুল কবির।
আদেশের পর আইনজীবী মো. বাকির হোসেন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৮৭ শিক্ষার্থী কলেজটির ভুলের কারণে সমাজকর্ম, পরিসংখ্যান ও ভূগোল পরীক্ষা দিতে পারছিলেন না। কলেজটির এই বিষয়গুলোর অনুমতি ছিল না। যে কারণে নিজে আবেদনকারী হয়ে জনস্বার্থে রিটটি করেন। এই ১৮৭ জন শিক্ষার্থীর ওই তিন বিষয়ের পরীক্ষা নিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এখন ১৮৭ শিক্ষার্থী পরীক্ষাগুলো দিতে পারবেন।
সাভারের আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে। গত ১৪ জুলাই এক বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড জানায়, আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে সমাজকর্ম, পরিসংখ্যান ও ভূগোল বিষয়ে পাঠদানের কোনো অনুমোদন না থাকায় পরও কলেজ কর্তৃপক্ষ ১৮৬ জন শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন এবং ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছে কলেজের অনুমোদনপ্রাপ্ত ভিন্ন তিনটি বিষয়ে। কলেজ কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা শুরুর অনেক আগেই পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র পেয়েছে এবং তাতে সমাজকর্ম, পরিসংখ্যান ও ভূগোল বিষয়ে পরীক্ষাদানের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও বোর্ডের সঙ্গে তারা কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি।
আদেশের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৮৭ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া ভূগোল ও পরিসংখ্যান পরীক্ষা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ৭ ও ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য সমাজকর্ম বিষয়ে ১৮৭ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসতে অনুমতি দিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা বাস্তবায়ন বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের গত ১৪ জুলাইয়ের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আবশ্যিক পাঁচটি পত্রের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৯ জুলাই ২০২৫ তারিখে কলেজ কর্তৃপক্ষ (আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়) বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৮৬ জন পরীক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য মৌখিকভাবে অনুরোধ করে। ইতিমধ্যে পূর্বনির্ধারিতসংখ্যক প্রশ্নপত্র সব কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠিয়ে দেওয়ায় বোর্ডের পক্ষে কিছু করার ছিল না। আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা বোর্ডের আওতাধীন আরও ৬টি কলেজে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে তাঁদের সংখ্যা মাত্র ২২। অন্যদিকে আশুলিয়া উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৮৬ জন। উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ শতভাগ দায়ী।