সরকার ও রাজনীতিকরাই ঠিক করুন দেশ কোনদিকে যাবে
Published: 3rd, June 2025 GMT
যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের আশা বা আশঙ্কা জানা জরুরি। সম্প্রতি কয়েকটি এলাকা কার্যোপলক্ষে সফরকালে নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কৃষিজীবী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আইনজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবী, উন্নয়ন ও পরিবেশকর্মী; সর্বোপরি জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী তরুণ শিক্ষার্থীরা। সবার কথা থেকে বুঝতে চেষ্টা করেছি– দেশ যেভাবে চলছে, তাতে তাদের প্রতিক্রিয়া বা ভাবনার স্বরূপ কেমন। তারা কি আশাবাদী? তারা কি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচিকেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে? দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কি সহজে দূর হবে, নাকি আরও বড় স্থিতিহীনতার পথ প্রশস্ত করবে? এই মুহূর্তে কী প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে? রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই বা তাদের প্রত্যাশা কী?
শ্রেণি-পেশা-দলমতে বিশ্বাস-অবিশ্বাস পরিস্থিতির মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ, সমস্যা, সমাধানের উপায় নিয়ে মতের ভিন্নতার পাশাপাশি অভিন্নতাও লক্ষণীয়।
অভিন্ন মতগুলো নিয়েই আলোচনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমত থাকবেই। ঐকমত্যের বিষয়গুলো শনাক্ত করে সমন্বিত কার্যক্রম নির্ধারণই সহনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম নিয়ামক।
এই অভিন্ন মত বা উদ্বেগের বিষয়গুলো কী, যা জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে? স্বৈরশাসকদের হাতে গত দেড় দশকে যারা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন; জুলাই অভ্যুত্থানে নজিরবিহীন পুলিশি বর্বরতা ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে শহীদ, তাদের পরিবার, আহতরা কি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যৌক্তিক সময়ে ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাবেন? স্বৈর শাসনামলে যে চাঁদাবাজি, দখলবাজি চলেছে, তার ব্যাপকতা কিছুটা হ্রাস পেলেও বন্ধ তো হয়নি; হাত বদল হয়েছে মাত্র। সাধারণ মানুষ এসবে ক্ষুব্ধ, হতাশ।
বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিপ্রিয়, সহনশীল, গণতন্ত্রপ্রিয়, ধর্মভীরু। অল্পসংখ্যকই উগ্র ও মতলববাজ। তারা কখনও ধর্ম কখনও রাজনৈতিক মতবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সাধারণ মানুষকে ব্যবহারে সচেষ্ট হয়।
নারীর শিক্ষা ও কর্মের স্বাধীনতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার মুসলিম বিশ্বসহ সারা দুনিয়ায় এখন অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আমাদের সংবিধানেও এই সমঅধিকার স্বীকৃত। জাতিসংঘের বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা, সিডও সনদ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন, অঙ্গীকারের দলিলে নারীর সমঅধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার সুরক্ষা দেওয়ার গ্যারান্টি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পটভূমি এবং জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে যেসব সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, তার অন্যতম নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। ধর্মের নামে উগ্র মতাবলম্বী গোষ্ঠী নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও প্রস্তাবকে উপলক্ষ করে যে নারীবিদ্বেষী প্রচারের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তাও সাধারণ মানুষের আলোচনায় প্রভাব ফেলে বৈকি। আশার কথা, সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে এ ধরনের উগ্র বক্তব্য বা আচরণকে সমর্থন তো করেইনি, বরং এসব বাড়াবাড়িতে বিরক্ত।
সামগ্রিক অর্থেই সংস্কারের বিভিন্ন প্রস্তাব এবং ওইসব প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ নিয়ে সাধারণের মনে আছে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা।
ভালো ভালো প্রস্তাব দেওয়া হলো; কার্যকর হবে তো? বিশেষভাবে এই অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ ও দৃষ্টিভঙ্গিগত দূরত্ব। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি প্রকাশ হচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে, কয়েকটি বড় দল এবং তরুণদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি নতুন দলের মধ্যে মতভেদ ক্রমে মারমুখী হয়ে উঠছে।
শিক্ষার্থী-জনতার অকুতোভয় আত্মত্যাগ আর জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকারগুলো বারবার ফিরে আসে বিভিন্ন আলোচনা ও মতবিনিময় সভায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অঙ্গীকার পূরণের দায় কার? শুধুই শিক্ষার্থী-জনতার, যাদের চরম ত্যাগ ও জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে অতি দানবীয় স্বৈরশাসকের পতন হলো? অথবা সেই অভ্যুত্থানের অনিবার্য ফলস্বরূপ যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার? তারা তো অবশ্যই সংস্কারের পুরোভাগে থাকবে। এটা তাদের ঐতিহাসিক দায়; জনপ্রত্যাশাও বটে। তবে দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের ওপরেও কম দায় বর্তায় না।
মনে রাখতে হবে, দায়িত্বশীল রাজনীতির খুব বেশি নজির গত অর্ধশতাব্দীকালে দেখিনি আমরা, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে। চরম দায়িত্বহীন-লুটেরা রাজনীতির স্বরূপ কেমন হয়, তা তো দেখেছি গত দেড় দশকজুড়ে। তাই জুলাই অভ্যুত্থানের দাবি শুধু সুশাসন, জবাবদিহির নির্বাচিত সরকার, রাষ্ট্র সংস্কার, বৈষম্যের অবসান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নয়। যথার্থ অর্থেই দায়িত্বশীল রাজনীতির সুপ্রতিষ্ঠাও জুলাই অভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য ম্যান্ডেট।
আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকার স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছেই হস্তান্তর হতে হবে। সেই ক্ষমতা রাজনীতিবিদরাই জনগণের সব অধিকার রক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োগ করবেন– এটিই জনআকাঙ্ক্ষার মর্মবাণী। রাজনীতিবিদদের সেই দায়িত্বশীলতার প্রকাশ এখনও যথেষ্ট দৃশ্যমান
হচ্ছে না।
আমরা জানি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক ত্যাগী, অভিজ্ঞ, দক্ষ ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষ আছেন। যারা বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণে যৌথ কাণ্ডারির ভূমিকায় সক্রিয় হতে পারেন। তরুণদের মধ্যেও
কিছু রাজনীতিবিদ আছেন, যারা সাহসী উদ্যম ও উদ্ভাবনী নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের আশান্বিত করেছেন। ভবিষ্যৎ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে তাদের দক্ষ, সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব আরও বাস্তবমুখী হোক– এটিই মানুষের প্রত্যাশা।
ভয়, শঙ্কা এ কারণে যে, সমন্বয়হীনতা, পারস্পরিক বিরোধ নিয়ে আন্তরিকতাপূর্ণ মতবিনিময়ের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ সহমতে উপনীত হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট নয়। আলোচনায় নেই রাজনৈতিক দলগুলোর স্বউদ্যোগে জনআকাঙ্ক্ষার সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিভিত্তিক দৃঢ়পণ আচরণবিধি বা কোড অব কন্ডাক্ট, যা আগামী ৫-১০ বছরের জন্য কার্যক্রম পরিচালনার গাইডলাইন হিসেবে থাকবে। জনআকাঙ্ক্ষায় এই প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে প্রতিফলন নেই। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এই কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন ও ঘোষণা দায়িত্বশীল রাজনীতির ঐতিহাসিক দলিল বলে বিবেচিত হতে পারে। জনমনের অনেক শঙ্কা দূর করতেও সহায়ক হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদেরই ঠিক করতে হবে– তারা জনগণকে অতীতের মতো হতাশার অন্ধকার যুগে ঠেলে দেবেন; নাকি আশা, প্রগতি, বৈষম্যহীন, দৃঢ় জনসংহতির সমাজ নির্মাণে নেতৃত্ব দেবেন।
শামসুল হুদা: অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি)
নির্বাহী পরিচালক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন র জন ত ব দ প রস ত ব র জন ত র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সরকার ও রাজনীতিকরাই ঠিক করুন দেশ কোনদিকে যাবে
যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের আশা বা আশঙ্কা জানা জরুরি। সম্প্রতি কয়েকটি এলাকা কার্যোপলক্ষে সফরকালে নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কৃষিজীবী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আইনজীবী, শিক্ষক, পেশাজীবী, উন্নয়ন ও পরিবেশকর্মী; সর্বোপরি জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী তরুণ শিক্ষার্থীরা। সবার কথা থেকে বুঝতে চেষ্টা করেছি– দেশ যেভাবে চলছে, তাতে তাদের প্রতিক্রিয়া বা ভাবনার স্বরূপ কেমন। তারা কি আশাবাদী? তারা কি মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচিকেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে? দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা কি সহজে দূর হবে, নাকি আরও বড় স্থিতিহীনতার পথ প্রশস্ত করবে? এই মুহূর্তে কী প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে? রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই বা তাদের প্রত্যাশা কী?
শ্রেণি-পেশা-দলমতে বিশ্বাস-অবিশ্বাস পরিস্থিতির মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ, সমস্যা, সমাধানের উপায় নিয়ে মতের ভিন্নতার পাশাপাশি অভিন্নতাও লক্ষণীয়।
অভিন্ন মতগুলো নিয়েই আলোচনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমত থাকবেই। ঐকমত্যের বিষয়গুলো শনাক্ত করে সমন্বিত কার্যক্রম নির্ধারণই সহনশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম নিয়ামক।
এই অভিন্ন মত বা উদ্বেগের বিষয়গুলো কী, যা জনমনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে? স্বৈরশাসকদের হাতে গত দেড় দশকে যারা নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন; জুলাই অভ্যুত্থানে নজিরবিহীন পুলিশি বর্বরতা ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে শহীদ, তাদের পরিবার, আহতরা কি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যৌক্তিক সময়ে ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ পাবেন? স্বৈর শাসনামলে যে চাঁদাবাজি, দখলবাজি চলেছে, তার ব্যাপকতা কিছুটা হ্রাস পেলেও বন্ধ তো হয়নি; হাত বদল হয়েছে মাত্র। সাধারণ মানুষ এসবে ক্ষুব্ধ, হতাশ।
বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিপ্রিয়, সহনশীল, গণতন্ত্রপ্রিয়, ধর্মভীরু। অল্পসংখ্যকই উগ্র ও মতলববাজ। তারা কখনও ধর্ম কখনও রাজনৈতিক মতবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সাধারণ মানুষকে ব্যবহারে সচেষ্ট হয়।
নারীর শিক্ষা ও কর্মের স্বাধীনতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার মুসলিম বিশ্বসহ সারা দুনিয়ায় এখন অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আমাদের সংবিধানেও এই সমঅধিকার স্বীকৃত। জাতিসংঘের বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা, সিডও সনদ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন, অঙ্গীকারের দলিলে নারীর সমঅধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার সুরক্ষা দেওয়ার গ্যারান্টি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পটভূমি এবং জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে যেসব সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, তার অন্যতম নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। ধর্মের নামে উগ্র মতাবলম্বী গোষ্ঠী নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও প্রস্তাবকে উপলক্ষ করে যে নারীবিদ্বেষী প্রচারের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তাও সাধারণ মানুষের আলোচনায় প্রভাব ফেলে বৈকি। আশার কথা, সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে এ ধরনের উগ্র বক্তব্য বা আচরণকে সমর্থন তো করেইনি, বরং এসব বাড়াবাড়িতে বিরক্ত।
সামগ্রিক অর্থেই সংস্কারের বিভিন্ন প্রস্তাব এবং ওইসব প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ নিয়ে সাধারণের মনে আছে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা।
ভালো ভালো প্রস্তাব দেওয়া হলো; কার্যকর হবে তো? বিশেষভাবে এই অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ ও দৃষ্টিভঙ্গিগত দূরত্ব। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি প্রকাশ হচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে এমন ধারণা বদ্ধমূল হতে পারে, কয়েকটি বড় দল এবং তরুণদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি নতুন দলের মধ্যে মতভেদ ক্রমে মারমুখী হয়ে উঠছে।
শিক্ষার্থী-জনতার অকুতোভয় আত্মত্যাগ আর জুলাই অভ্যুত্থানের অঙ্গীকারগুলো বারবার ফিরে আসে বিভিন্ন আলোচনা ও মতবিনিময় সভায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অঙ্গীকার পূরণের দায় কার? শুধুই শিক্ষার্থী-জনতার, যাদের চরম ত্যাগ ও জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে অতি দানবীয় স্বৈরশাসকের পতন হলো? অথবা সেই অভ্যুত্থানের অনিবার্য ফলস্বরূপ যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার? তারা তো অবশ্যই সংস্কারের পুরোভাগে থাকবে। এটা তাদের ঐতিহাসিক দায়; জনপ্রত্যাশাও বটে। তবে দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের ওপরেও কম দায় বর্তায় না।
মনে রাখতে হবে, দায়িত্বশীল রাজনীতির খুব বেশি নজির গত অর্ধশতাব্দীকালে দেখিনি আমরা, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে। চরম দায়িত্বহীন-লুটেরা রাজনীতির স্বরূপ কেমন হয়, তা তো দেখেছি গত দেড় দশকজুড়ে। তাই জুলাই অভ্যুত্থানের দাবি শুধু সুশাসন, জবাবদিহির নির্বাচিত সরকার, রাষ্ট্র সংস্কার, বৈষম্যের অবসান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নয়। যথার্থ অর্থেই দায়িত্বশীল রাজনীতির সুপ্রতিষ্ঠাও জুলাই অভ্যুত্থানের উল্লেখযোগ্য ম্যান্ডেট।
আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকার স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছেই হস্তান্তর হতে হবে। সেই ক্ষমতা রাজনীতিবিদরাই জনগণের সব অধিকার রক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োগ করবেন– এটিই জনআকাঙ্ক্ষার মর্মবাণী। রাজনীতিবিদদের সেই দায়িত্বশীলতার প্রকাশ এখনও যথেষ্ট দৃশ্যমান
হচ্ছে না।
আমরা জানি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক ত্যাগী, অভিজ্ঞ, দক্ষ ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষ আছেন। যারা বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণে যৌথ কাণ্ডারির ভূমিকায় সক্রিয় হতে পারেন। তরুণদের মধ্যেও
কিছু রাজনীতিবিদ আছেন, যারা সাহসী উদ্যম ও উদ্ভাবনী নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের আশান্বিত করেছেন। ভবিষ্যৎ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণে তাদের দক্ষ, সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব আরও বাস্তবমুখী হোক– এটিই মানুষের প্রত্যাশা।
ভয়, শঙ্কা এ কারণে যে, সমন্বয়হীনতা, পারস্পরিক বিরোধ নিয়ে আন্তরিকতাপূর্ণ মতবিনিময়ের মাধ্যমে অর্থপূর্ণ সহমতে উপনীত হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট নয়। আলোচনায় নেই রাজনৈতিক দলগুলোর স্বউদ্যোগে জনআকাঙ্ক্ষার সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিভিত্তিক দৃঢ়পণ আচরণবিধি বা কোড অব কন্ডাক্ট, যা আগামী ৫-১০ বছরের জন্য কার্যক্রম পরিচালনার গাইডলাইন হিসেবে থাকবে। জনআকাঙ্ক্ষায় এই প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে প্রতিফলন নেই। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এই কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন ও ঘোষণা দায়িত্বশীল রাজনীতির ঐতিহাসিক দলিল বলে বিবেচিত হতে পারে। জনমনের অনেক শঙ্কা দূর করতেও সহায়ক হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদেরই ঠিক করতে হবে– তারা জনগণকে অতীতের মতো হতাশার অন্ধকার যুগে ঠেলে দেবেন; নাকি আশা, প্রগতি, বৈষম্যহীন, দৃঢ় জনসংহতির সমাজ নির্মাণে নেতৃত্ব দেবেন।
শামসুল হুদা: অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি)
নির্বাহী পরিচালক