কে কত বেশি সময় ফেসবুকে অ্যাকটিভ থাকতে পারে, আবার কাজের ফাইলও ঠিক সময়ে জমা দিতে পারে—এ নিয়ে দেশের অফিস-আদালতের কালচারে এখন এক নতুন ধরনের ‘গোপন ও নীরব প্রতিযোগিতা’ চলছে। কেউ সকালে অফিসে ঢুকেই কম্পিউটার চালিয়ে অফিস ই–মেইলের আগে সব কটি নিউজ পোর্টাল খুলে দেখে, কেউ আবার ‘চা-কফি খাওয়ার ফাঁকে একবার মেসেঞ্জারে বা ইনস্টাগ্রামে ঢুঁ মারা যাক’ বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করে।

এই নিরীহ অভ্যাসই আসলে এক অদৃশ্য কর্মঘাতী ভাইরাস। এর নাম সাইবার-স্ল্যাকিং, অর্থাৎ অফিসের সময় বা অফিসের ইন্টারনেট ও অন্যান্য রিসোর্স ব্যবহার করে ব্যক্তিগত অনলাইন কাজ করা।

২০২৫ সালের শেষে এসে এটা শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়, বিশ্বের প্রায় সব অফিসেই এই ‘ডিজিটাল বিভ্রান্তি’ ছড়িয়ে পড়েছে।

তবে আমাদের দেশের অফিস-আদালতের সংস্কৃতি, সামাজিক ধারা, আর ‘অল্প কাজ বেশি আরাম’ মানসিকতা এই প্রবণতাকে আরও আনন্দদায়ক করে তুলেছে।

কেউ এটাকে সময় কাটানোর মাধ্যম বলে। কেউ মনে করে, এটা স্ট্রেস কমানোর উপায়। কিন্তু কর্মঘণ্টার পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের অনেক অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কার্যত দিনের ৩০-৪০ শতাংশ সময় অফিসের কাজের বাইরে অনলাইন কর্মকাণ্ডে ব্যয় করছেন। এটি প্রাতিষ্ঠানিক উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে ভয়ানকভাবে।

বিশেষ করে দেশের পাবলিক সার্ভিস সেক্টরে সাইবার-স্ল্যাকিং সার্ভিসকে কাছিমের গতি দিচ্ছে। এতে দেখা যায়, সার্ভিস নেওয়ার লাইন শেষ হয় না, কিন্তু সার্ভিসদাতা ফেসবুক স্ক্রলে ব্যস্ত।

সাইবার-স্ল্যাকিং মানে আসলে কী

‘স্ল্যাকিং’ শব্দের মানে ঢিলেমি। আর সাইবার-স্ল্যাকিং মানে হলো ডিজিটাল মাধ্যমে সেই ঢিলেমিকে চর্চা করা।

অফিসের সময় ই–মেইল চেক করতে গিয়ে হঠাৎই দেখা গেল, ইউটিউবে ‘একটা ভিডিও’ দেখে নিচ্ছেন। তারপর পরের ভিডিওটাও দেখলেন। এভাবে সময় গড়িয়ে গেল এক ঘণ্টা।

কেউ অফিসের ডেস্কে বসে অনলাইন শপিং করছেন, কেউ হোয়াটসঅ্যাপে পারিবারিক গ্রুপে আলোচনা করছেন। কেউ হয়তো চাকরি ছাড়ার আগে পরের চাকরির বিজ্ঞাপন খুঁজছেন। এসবই সাইবার-স্ল্যাকিংয়ের মধ্যে পড়ে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাইবার-স্ল্যাকিং আসলে ‘মাইক্রো-ব্রেক’ হিসেবে শুরু হয়। অর্থাৎ মানুষ একঘেয়ে কাজের চাপ থেকে সাময়িক বিশ্রাম নিতে চায়, যেমন কেউ চা-কফি খায়, কেউ জানালার বাইরে তাকায়, কেউ আবার ফোনটা তুলে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করে।

সমস্যা তখনই হয়, যখন এই ছোট বিরতি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায় এবং কাজের ধারাবাহিকতা ভেঙে ফেলে।

বাংলাদেশে সাইবার-স্ল্যাকিংয়ের আরেকটি বড় কারণ হলো অফিস-আদালতে ‘মনিটরিং সংস্কৃতির অভাব’। অনেক অফিসেই ডিজিটাল আচরণের কোনো স্পষ্ট নীতিমালা নেই, অথচ ডিজিটাল ডিভাইসের অভাব নেই। কর্মীরা জানেন না, কতটা ব্যক্তিগত কাজ গ্রহণযোগ্য, আর কোথা থেকে সেটা অসদাচরণ হয়ে দাঁড়ায়।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আমাদের সংস্কৃতিগত ঢিলেঢালা কর্মধারা। ‘বস আসার আগে কাজ শুরু না করলেও চলে’, ‘মিটিং শুরু হবে চা-কফি শেষে’—এমন মনোভাবই ধীরে ধীরে সাইবার-স্ল্যাকিংকে ‘অফিস লাইফস্টাইল’-এর অংশে পরিণত করেছে।

অন্যদিকে বর্তমান তরুণ কর্তা বা কর্মীরা অনেক সময় কাজের পরিবেশে একঘেয়েমি বা প্রেরণার অভাব অনুভব করেন। তাঁরা কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে না পেলে বিকল্প বিনোদন খুঁজে নেন, যার সহজতম মাধ্যমই হলো ইন্টারনেট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের কাছে হয়ে ওঠে একধরনের মানসিক আশ্রয়স্থলও।

উন্নত দেশগুলোও কিন্তু সাইবার-স্ল্যাকিং সমস্যা থেকে মুক্ত নয়, তবে তারা বিষয়টিকে ‘অপরাধ’ হিসেবে নয়, বরং ‘মানবিক আচরণ’ হিসেবে দেখে কৌশলগতভাবে প্রতিকার করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ‘নিয়ন্ত্রিত অনলাইন বিরতি’ নীতি গ্রহণ করেছে। যেমন গুগল বা মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয় ‘ডিজিটাল ব্রেক’ নেওয়ার জন্য, যাতে তাঁরা ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মানসিক বিশ্রাম নিতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের নীতিতে কর্মীদের মনোযোগ ও উৎপাদনশীলতা উভয়ই বৃদ্ধি পায়।

জার্মানিতে কিছু কোম্পানি ‘ডিজিটাল ডিটক্স আওয়ার’ চালু করেছে, যেখানে কর্মীরা দিনের নির্দিষ্ট এক ঘণ্টায় ইন্টারনেট থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকেন, শুধু কাজের ওপর মনোযোগ দেন। এতে মনোযোগ বাড়ে, মন শান্ত থাকে, আর কাজের সময়ও কম লাগে।

জাপানে আবার ‘নরম প্রযুক্তিগত নজরদারি’ চালু করা হয়েছে, অর্থাৎ কর্মীর ইন্টারনেট ব্যবহার ট্র্যাক করা হলেও তাঁকে শাস্তি না দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, তিনি কোথায় সময় বেশি ব্যয় করছেন। তারপর ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দেওয়া হয় কীভাবে কাজের সময় অনলাইন বিভ্রান্তি কমানো যায়। এতে কর্মী নিজে সচেতন হন, অপমানিত বোধ করেন না। যুক্তরাজ্যের কিছু প্রতিষ্ঠানে ‘ডিজিটাল ওয়েলবিয়িং ওয়ার্কশপ’ আয়োজন করা হয়, যেখানে কর্মীদের শেখানো হয় কীভাবে ই–মেইল, মেসেজ ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এই পদ্ধতি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সাহায্য করে।

এসব উদাহরণ দেখায়, উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তিকে শত্রু হিসেবে নয়, সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করে সাইবার-স্ল্যাকিং মোকাবিলা করছে।

তাহলে মুক্তি কোথায়?

বাংলাদেশে সাইবার-স্ল্যাকিং মোকাবিলায় প্রথমেই দরকার প্রাতিষ্ঠানিক বোঝাপড়া ও নীতিনির্ধারণে সচেতনতা। শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নয়, বরং অফিস কর্মীদের মনস্তাত্ত্বিক ও প্রযুক্তিগত দুই দিক থেকেই সমাধান আনতে হবে।

প্রথমত, অফিসে ‘নিয়ন্ত্রিত অনলাইন সময়’ চালু করা যেতে পারে। যেমন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজের ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়া বা ই–মেইল চেক করতে পারবেন। এতে তাঁরা অফিসের সময় গোপনে স্ল্যাকিং না করে স্বচ্ছভাবে বিরতি নিতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, অফিসে কাজের পরিবেশকে আরও ইন্টারেকটিভ ও আকর্ষণীয় করা দরকার। যদি কর্মীরা মনে করেন, তাঁদের কাজ অর্থবহ এবং তাতে ব্যক্তিগত উন্নতির সুযোগ আছে, তবে তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই মনোযোগী হন। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহার করেও সাইবার-স্ল্যাকিং কমানো সম্ভব। যেমন অফিস নেটওয়ার্কে নির্দিষ্ট সময়ে কিছু সাইট ব্লক করা, অথবা ‘ফোকাস মোড’ অ্যাপ ব্যবহার করে কাজের সময় সোশ্যাল মিডিয়া নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা। চতুর্থত, কর্মীদের ‘ডিজিটাল শৃঙ্খলা’ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। যেমন, কীভাবে সময় ব্যবস্থাপনা করতে হয়, কবে, কখন অনলাইনে থাকা প্রয়োজন আর কবে নয়—এসব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ম্যানেজমেন্ট ও কর্মীর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক বৃদ্ধি। কর্মীরা যদি মনে করেন, তাঁদের প্রতিটি ক্লিক নজরদারিতে আছে, তাহলে তাঁরা আরও গোপনে স্ল্যাক করবে। বরং তাঁদের বিশ্বাস করতে হবে এবং উৎসাহ দিতে হবে, যেন তাঁরা নিজেরাই দায়িত্বশীলভাবে কাজ ও বিনোদনের ভারসাম্য রাখেন। সাইবার-স্ল্যাকিং পুরোপুরি নির্মূল করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কারণ, মানুষ রোবট নয়, তাঁকে মাঝেমধ্যে মানসিক বিশ্রাম নিতে হয়। মূল চাবিকাঠি হলো ‘নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা’।

পরিশেষে অফিস-আদালতে কাজের মধ্যে যদি আনন্দ থাকে, তবে স্ল্যাকিংয়ের আনন্দ অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি জানেন, তাঁদের কাজের ফলাফল মূল্যবান, তাঁরা যদি আত্মতৃপ্তি পান, তাহলে তাঁরা স্বেচ্ছায় স্ল্যাকিং কমিয়ে দেন। তাই হয়তো বলা যায়, ‘কাজের থেকে স্ল্যাকিং আনন্দদায়ক’—এই ধারণাকে পুরোপুরি মুছে ফেলা যাবে না, কিন্তু এটাকে এমনভাবে বদলানো যায়, যেন কাজই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় আনন্দ।

আর যদি এমন হয়, আপনি এই লেখা অফিসে বসে পড়ছেন, তাহলে অভিনন্দন। আপনি এখনই প্রমাণ করলেন যে সাইবার-স্ল্যাকিং এখনো পুরোপুরি নির্মূল হয়নি!

ড.

ইকবাল আহমেদ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর কর ম দ র ইন ট র ক ত গত কর ম র অফ স র মন য গ র সময় করছ ন আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।

সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।

ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ