সীমান্তে বিএসএফ-এর সাম্প্রতিক কার্যকলাপে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে মন্ত্রণালয়ে ‘ডেকে নিয়ে’ সরকারের পক্ষ থেকে ‘কড়া বার্তা’ জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। বিশেষ করে, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে বিএসএফ-এর অননুমোদিত প্রচেষ্টা ‘সীমান্তে উত্তেজনা’ সৃষ্টি করেছে—এমনটাও জোর দিয়ে জানান তিনি।

রবিবার (১২ জানুয়ারি) বিকেল ৩টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হাইকমিশনারকে তলব করা হয়। এ সময় পররাষ্ট্র সচিব মো.

জসীম উদ্দিনের সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। আধা ঘণ্টার বে‌শি সময় পররাষ্ট্র স‌চিবের দপ্তরে ছি‌লেন ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা‌।

বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত জসিম উদ্দিন জোর দিয়ে বলেন, ‘‘এই ধরনের কার্যকলাপ, বিশেষ করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের অননুমোদিত প্রচেষ্টা এবং বিএসএফের সংশ্লিষ্ট অপারেশনাল পদক্ষেপ সীমান্তে উত্তেজনা ও ঝামেলা সৃষ্টি করেছে।’’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তৌ‌ফিক হাসান পররাষ্ট্র স‌চি‌বের বরাত দি‌য়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

তিনি বলেন, ‘‘যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চেতনাকে ক্ষুণ্ন করে।’’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, আসন্ন বিজিবি-বিএসএফ ডিজি পর্যায়ের আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হবে।

জবাবে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, ‘‘অপরাধ দমনে সীমান্ত নিরাপত্তায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব থাকাও প্রয়োজন। সীমান্তের বেড়া নির্মাণে সহযোগিতামূলক মনোভাব আশা করি আমরা।’’

সুনামগঞ্জে বিএসএফ সম্প্রতি একজন বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা করেছে— এ তথ্য জানিয়ে, পররাষ্ট্র সচিব সীমান্তে হত্যার পুনরাবৃত্তি নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে এবং এই সমস্ত সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত পরিচালনা ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জরুরি ব্যবস্থার আহ্বান জানান পররাষ্ট্র সচিব।

বিএসএফের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে সীমান্ত এলাকায় জড়ো হন স্থানীয় বাসিন্দারা। ১০ জানুয়ারি বিকেলে পাটগ্রামের মুন্সিপাড়া সীমান্তে।

পররাষ্ট্র সচিব বর্ণনা করেন, ‘‘এটিও গুরুতর উদ্বেগের বিষয় যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বারবার অ-প্রাণঘাতী কৌশল অনুসরণ ও হত্যা বন্ধ করার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে।’’

পররাষ্ট্র সচিব ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন ভারত-সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এমন কোনো উসকানিমূলক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন; যা ভাগাভাগি করা সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে পারে।

সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।

পররাষ্ট্র সচিব আরো বর্ণনা করেন, বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, এ ধরনের সমস্যাগুলো গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুসারে এবং সীমান্তে শান্তি ও স্থায়িত্ব বজায় রাখার উপায়ে সমাধান করা উচিত।

সচিবের দপ্তর থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের ভারতীয় দূত বলেন, ‘‘অপরাধমুক্ত সীমান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে। চোরাচালান ও অবৈধ অনুপ্রবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়েও কথা হয়েছে। দুই সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যেও কথাবার্তা হয়।’’

একই দিনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, সীমান্তে কোনো বিরূপ ঘটনা যাতে না ঘটে, সেজন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘‘ভারত এরই মধ্যে ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। বাকি ৮৮৫ কিলোমিটার এলাকায় কাজ শুরু করতে হলে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি অনুযায়ী আলোচনার প্রয়োজন।’’

সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘‘ভারত সম্প্রতি লালমনিরহাটের তিন বিঘা করিডোর, ফেনী, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া এবং নওগাঁর পত্নীতলায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি অনুযায়ী, এ ধরনের উন্নয়ন কাজ দুদেশের আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে। বিজিবি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কঠোর অবস্থানের কারণে ভারতের নির্মাণ কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।’’

ঢাকা/হাসান/এনএইচ

উৎস: Risingbd

এছাড়াও পড়ুন:

‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা

বাংলাদেশে পুলিশে পেশাদারি মনোভাব গড়ে না ওঠার জন্য এই বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারকে দায়ী করছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি বলেছেন, বিভাজিত সমাজে ‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’—এমন নানা তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি। যৌথভাবে এ বৈঠক আয়োজন করে প্রথম আলো ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি। বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। একটি প্রবন্ধ তুলে ধরেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (অবসরপ্রাপ্ত) ও বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি ইয়াসমিন গফুর।

নিজের পেশাজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, ‘আমি দুই সরকারপ্রধানের (সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গেই কাজ করেছি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে একটা ভদ্রতা, সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে হয়। দেখা করলে অনেক কথার পরও বা অল্প কথার পরও ‘এ কি আমাদের?’—এমন কথা শুনলে প্রথমেই বিব্রত বোধ করতে হয়।’

সরকারের পরিবর্তনে পুলিশে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে প্রভাবিত হওয়ার উদাহরণ দিয়ে মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘বাড়ি ফরিদপুর যদি হয় বা ফরিদপুরের আশপাশে হয়, কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট হবে না। আবার আরেক সময় বগুড়ায় বাড়ি, ঝিনাইদহে বাড়ি, দিনাজপুরের বাড়ি, তাহলে চাকরিতে নেওয়া যাবে না বা ক্ষেত্রবিশেষে পদোন্নতি হবে না।’ এ ধরনের মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার বা পেশাদারি মনোভাব ফেরানো কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও আচরণের পরিবর্তন না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে নুরুল হুদা বলেন, ‘এক অদ্ভুত ব্যাপার। এখানে দুই হাজারের মতো লোক মারা গেল। অথচ বিহেভিয়ারে চেঞ্জ নেই।’

দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঠিকভাবে কাজ করতে না পারার অন্তরায় হিসেবে নিয়োগে দুর্নীতি এবং সমাজে বিভাজনকে চিহ্নিত করেন সাবেক এই পুলিশপ্রধান। তিনি বলেন, ‘এই যে প্রচুর সংখ্যার লোক পয়সা দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে বা এখানে হলে...অনেক পয়সা হয়, এই অ্যাটিচিউড (আচরণ) থাকলে তো ল এনফোর্সমেন্ট (আইনশৃঙ্লা নিয়ন্ত্রণ) মুশকিল। আর ল এনফোর্সমেন্টের আরেকটা বড় জিনিস হচ্ছে আমি যে সমাজে কাজ করতে যাচ্ছি, সেই সমাজ কতখানি বিভাজিত।’

সংস্কারের পটভূমিতে স্বাধীন পুলিশ কমিশনের কর্মপদ্ধতি জানতে চেয়েছেন নুরুল হুদা। পুলিশ রিমান্ডের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এই গোলটেবিল বৈঠকে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতির সভাপতি এম আকবর আলী, মানবাধিকার কর্মী নূর খান বক্তব্য দেন।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, পুলিশের অতিরিক্ত আইজি কাজী মো. ফজলুল করীম বৈঠকে অংশ নেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিলেট সীমান্তে বাংলাদেশে ঢুকে খুঁটি উপড়ে ফেলে বিএসএফ, স্থানীয়দের প্রতিবাদ
  • পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনে কর্মকর্তা নিয়োগ, বেতন ৫১,০০০ টাকা
  • পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত, সচিব কমিটি উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাবে
  • পুলিশ লাইনসগুলো গোপন কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছিল: নূর খান
  • মাঝে মধ্যে শুনতে হয়, ‘উনি কী আমাদের লোক’: আইজিপি
  • ‘আওয়ামী পুলিশ, বিএনপি পুলিশ’ তকমা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ কঠিন: সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা
  • মবের ঘটনা নানাভাবে রাজনীতিকরণ করা হয়: এনসিপি নেতা আদীব
  • জঙ্গি সন্দেহে কলকাতায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি যুবক