ঢাবি, বুয়েটসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস উত্তপ্ত, বিক্ষোভ
Published: 18th, February 2025 GMT
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে বুয়েট, রাবি, জাবি ও জবিতে। পরস্পরকে দায়ী করে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সব সংগঠনই।
গতকাল সন্ধ্যায় রাজু ভাস্কর্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে ‘কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। অন্যদিকে, ছাত্রদলও রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভের ঘোষণা দেয়।
পরে অবশ্য ছাত্রদল ডাসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বর ঘুরে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যে এসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ সময় জুলাইয়ে ছাত্রলীগের হামলা এবং কুয়েটে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ভিডিওচিত্র বুধবার বিকেলে টিএসসিতে প্রদর্শনীর কর্মসূচি ঘোষণা করেন সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার।
সমাবেশে ছাত্রদলকে জালিম না হওয়ার আহ্বান করেন আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, গত ১৬ বছরে নির্যাতনের কথা ভুলে যাবেন না। এই চাপাতির রাজনীতি ক্যাম্পাসে আবার ‘রি-ইনস্টল’ করতে চাইলে ছাত্রলীগ গেছে যে পথে, আপনারা যাবেন সেই পথে। গত ১৬ বছরে যে নির্যাতন হয়েছে, আপনারা মজলুম ছিলেন, আপনারা জালিম হয়েন না। মজলুম জালিম হলে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়।
হাসনাত বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মান জানাই। একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই, আবার যারা ছাত্রলীগ হয়ে উঠতে চাইবে, শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেবে, তাদের পরিণতি ছাত্রলীগের মতোই হবে। শহীদদের রক্তের দায় আমাদের ওপর রয়েছে। তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে মাদার পার্টির এজেন্ডা বাস্তবায়নের রাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘রি-ইনস্টল’ করতে পারি না। শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি করতে চাইলে তাদের ভাষায় তাদের মতো চলতে হবে। কিন্তু আপনারা যদি আবার ক্যাডার পলিটিক্স করতে চান, হল দখল, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি করতে চান, আপনাদের পরিণতি সাদ্দাম-ইনানের মতো হবে।
সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে কোনো দখলদারিত্বের ঠাঁই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ছাত্র রাজনীতির দরকার আছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ নিয়ে কাজ করতে হবে। যারা জোরজবরদস্তি করে রাজনীতি খাওয়ানোর চেষ্টা করে, তাদের পরিণতি ছাত্রলীগের মতো হবে।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগ তো অনেক পরাক্রমশালী ছিল, তাদের আমরা ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি, ছাত্রদল তো গতকাল সকালে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। আমরা ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছি, তারা যদি আবার শিক্ষার্থীদের ওপর হাত দিতে চায়, আমরা তাদের প্রতিরোধ করব।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সমন্বয়ক রিফাত রশীদ, হাসিব আল ইসলাম, রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, নিশিতা জামান নিহাসহ বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে কুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারকে অপব্যবহার করে ফরম বিতরণের অভিযোগ এনে গুপ্ত সংগঠন শিবির ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের কতিপয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী ছাত্রদলের নেতাকর্মীর ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ছাত্রদল। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে তারা এ হামলার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে।
ছাত্রদলের সমাবেশে ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, কুয়েটে দু’দিন আগে একটি টিম অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ফরম বিতরণ করেছে, যা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। আজকে একটি গুপ্ত সংগঠন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চাই না বলে মিছিল আয়োজন করেছিল। যারা সেখানে ছাত্রদলের ফরম পূরণ করেছে, তাদের ওপর হামলা করেছে। তারা একটি মব তৈরি করে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে চাচ্ছে, ছাত্রদল ছাত্রলীগের মতো আধিপত্য করবে।
তিনি বলেন, যারা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চাই না বলে মিছিল করেছিল, তারা এখন ক্যাম্পাসগুলোতে নামে-বেনামে সংগঠন খুলে বসে আছে। ছাত্রদল কোনো গেস্টরুম-গণরুমের সংস্কৃতি ধারণ করে না।
ছাত্রদল সভাপতি বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি মব তৈরি করা হয়েছিল, ছাত্রদল ডাকসু চায় না। কিন্তু ডাকসু আমাদের প্রাণের দাবি। ৫ আগস্টের পর হয়তো কিছুদিন মব তৈরি করে তাদের আবেগকে নিয়ে খেলাধুলা করা গেছে; কিন্তু শিক্ষার্থীরা বুঝে গেছে, মব তৈরি করে কোনো ধরনের গুপ্তভিত্তিক চর্চা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর হবে না।
ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা, বিক্ষোভে বুয়েট
এদিকে কুয়েটে ছাত্রদলের ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। তারা হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল তারা বুয়েট শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পলাশী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বকশীবাজার ঘুরে পুনরায় বুয়েট শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছেন। সমাবেশে লিখিত বক্তব্য দেন বুয়েটের ১৯তম ব্যাচের ছাত্র আবু ওবায়দা মায়াজ এবং আরাফাত সাকিব।
আরাফাত সাকিব বলেন, আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা পরিষ্কার কণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই, বাংলাদেশকে আরেকটি নৈরাজ্যপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে আমরা দেব না। হাজারো শহীদের রক্তস্নাত এই ফ্যাসিস্টমুক্ত স্বাধীন দেশে ফ্যাসিস্টদের পুরোনো পদচারণা আমরা মেনে নেব না।
তিনি বলেন, ইতোপূর্বে বুয়েটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেমন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছি, ছাত্রদলের বর্তমান সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধেও বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অবস্থান অনড় এবং সুদৃঢ়।
আবু ওবায়দা মায়াজ বলেন, আমরা কুয়েট প্রশাসনকে জানিয়ে দিতে চাই, কোনোভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি পুনর্বাসনের চেষ্টা করবেন না। অন্যথায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতম কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।
জাবি, জবিতেও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সড়ক ঘুরে পুনরায় বটতলায় এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী শোয়াইব হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ না করলে ‘পরিণতি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের চেয়েও ভয়ংকর হবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরাও। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বরের সামনে জড়ো হন। মিছিলটি শাঁখারীবাজার মোড় ও ভিক্টোরিয়া পার্ক প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়।
বিক্ষোভ-পরবর্তী সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কারমূলক রাজনীতি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে হলে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে তা করবেন না। যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়, তবে শিক্ষার্থীরা চুপ থাকবেন না।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এক বিবৃতিতে হামলার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ইবি সংসদ।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরা)
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র শ ক ষ র থ দ র ওপর ছ ত র র জন ত ছ ত রদল র ভ স কর য মব ত র কর ছ ন স গঠন গতক ল আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ
আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।
মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :
তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে
অর্থাৎ :
কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়
[অনুবাদ: লেখক]
অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।
তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:
হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে
অর্থাৎ :
এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য
তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।
আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :
সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি
অর্থাৎ :
হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।
উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।
অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।ই–মেইল: [email protected]