ঢাবি, বুয়েটসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস উত্তপ্ত, বিক্ষোভ
Published: 18th, February 2025 GMT
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাস। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে বুয়েট, রাবি, জাবি ও জবিতে। পরস্পরকে দায়ী করে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সব সংগঠনই।
গতকাল সন্ধ্যায় রাজু ভাস্কর্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে ‘কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। অন্যদিকে, ছাত্রদলও রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভের ঘোষণা দেয়।
পরে অবশ্য ছাত্রদল ডাসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বর ঘুরে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যে এসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ সময় জুলাইয়ে ছাত্রলীগের হামলা এবং কুয়েটে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ভিডিওচিত্র বুধবার বিকেলে টিএসসিতে প্রদর্শনীর কর্মসূচি ঘোষণা করেন সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার।
সমাবেশে ছাত্রদলকে জালিম না হওয়ার আহ্বান করেন আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, গত ১৬ বছরে নির্যাতনের কথা ভুলে যাবেন না। এই চাপাতির রাজনীতি ক্যাম্পাসে আবার ‘রি-ইনস্টল’ করতে চাইলে ছাত্রলীগ গেছে যে পথে, আপনারা যাবেন সেই পথে। গত ১৬ বছরে যে নির্যাতন হয়েছে, আপনারা মজলুম ছিলেন, আপনারা জালিম হয়েন না। মজলুম জালিম হলে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়।
হাসনাত বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্মান জানাই। একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাই, আবার যারা ছাত্রলীগ হয়ে উঠতে চাইবে, শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেবে, তাদের পরিণতি ছাত্রলীগের মতোই হবে। শহীদদের রক্তের দায় আমাদের ওপর রয়েছে। তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে মাদার পার্টির এজেন্ডা বাস্তবায়নের রাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘রি-ইনস্টল’ করতে পারি না। শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি করতে চাইলে তাদের ভাষায় তাদের মতো চলতে হবে। কিন্তু আপনারা যদি আবার ক্যাডার পলিটিক্স করতে চান, হল দখল, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি করতে চান, আপনাদের পরিণতি সাদ্দাম-ইনানের মতো হবে।
সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে কোনো দখলদারিত্বের ঠাঁই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ছাত্র রাজনীতির দরকার আছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ নিয়ে কাজ করতে হবে। যারা জোরজবরদস্তি করে রাজনীতি খাওয়ানোর চেষ্টা করে, তাদের পরিণতি ছাত্রলীগের মতো হবে।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগ তো অনেক পরাক্রমশালী ছিল, তাদের আমরা ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি, ছাত্রদল তো গতকাল সকালে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। আমরা ছাত্রদলকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছি, তারা যদি আবার শিক্ষার্থীদের ওপর হাত দিতে চায়, আমরা তাদের প্রতিরোধ করব।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন সমন্বয়ক রিফাত রশীদ, হাসিব আল ইসলাম, রাফিয়া রেহনুমা হৃদি, নিশিতা জামান নিহাসহ বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীরা।
এদিকে কুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারকে অপব্যবহার করে ফরম বিতরণের অভিযোগ এনে গুপ্ত সংগঠন শিবির ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের কতিপয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী ছাত্রদলের নেতাকর্মীর ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে ছাত্রদল। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে তারা এ হামলার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে।
ছাত্রদলের সমাবেশে ঢাবি ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, কুয়েটে দু’দিন আগে একটি টিম অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ফরম বিতরণ করেছে, যা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। আজকে একটি গুপ্ত সংগঠন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চাই না বলে মিছিল আয়োজন করেছিল। যারা সেখানে ছাত্রদলের ফরম পূরণ করেছে, তাদের ওপর হামলা করেছে। তারা একটি মব তৈরি করে শিক্ষার্থীদের বোঝাতে চাচ্ছে, ছাত্রদল ছাত্রলীগের মতো আধিপত্য করবে।
তিনি বলেন, যারা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চাই না বলে মিছিল করেছিল, তারা এখন ক্যাম্পাসগুলোতে নামে-বেনামে সংগঠন খুলে বসে আছে। ছাত্রদল কোনো গেস্টরুম-গণরুমের সংস্কৃতি ধারণ করে না।
ছাত্রদল সভাপতি বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি মব তৈরি করা হয়েছিল, ছাত্রদল ডাকসু চায় না। কিন্তু ডাকসু আমাদের প্রাণের দাবি। ৫ আগস্টের পর হয়তো কিছুদিন মব তৈরি করে তাদের আবেগকে নিয়ে খেলাধুলা করা গেছে; কিন্তু শিক্ষার্থীরা বুঝে গেছে, মব তৈরি করে কোনো ধরনের গুপ্তভিত্তিক চর্চা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর হবে না।
ন্যক্কারজনক হামলার নিন্দা, বিক্ষোভে বুয়েট
এদিকে কুয়েটে ছাত্রদলের ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। তারা হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল তারা বুয়েট শহীদ মিনার থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পলাশী, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বকশীবাজার ঘুরে পুনরায় বুয়েট শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছেন। সমাবেশে লিখিত বক্তব্য দেন বুয়েটের ১৯তম ব্যাচের ছাত্র আবু ওবায়দা মায়াজ এবং আরাফাত সাকিব।
আরাফাত সাকিব বলেন, আমরা বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা পরিষ্কার কণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই, বাংলাদেশকে আরেকটি নৈরাজ্যপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে আমরা দেব না। হাজারো শহীদের রক্তস্নাত এই ফ্যাসিস্টমুক্ত স্বাধীন দেশে ফ্যাসিস্টদের পুরোনো পদচারণা আমরা মেনে নেব না।
তিনি বলেন, ইতোপূর্বে বুয়েটে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যেমন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছি, ছাত্রদলের বর্তমান সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধেও বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অবস্থান অনড় এবং সুদৃঢ়।
আবু ওবায়দা মায়াজ বলেন, আমরা কুয়েট প্রশাসনকে জানিয়ে দিতে চাই, কোনোভাবেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি পুনর্বাসনের চেষ্টা করবেন না। অন্যথায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতম কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।
জাবি, জবিতেও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি সড়ক ঘুরে পুনরায় বটতলায় এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী শোয়াইব হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে কুয়েটের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ না করলে ‘পরিণতি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের চেয়েও ভয়ংকর হবে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরাও। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বরের সামনে জড়ো হন। মিছিলটি শাঁখারীবাজার মোড় ও ভিক্টোরিয়া পার্ক প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়।
বিক্ষোভ-পরবর্তী সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কারমূলক রাজনীতি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না। ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে হলে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে তা করবেন না। যদি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়, তবে শিক্ষার্থীরা চুপ থাকবেন না।
এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এক বিবৃতিতে হামলার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ইবি সংসদ।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিরা)
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র শ ক ষ র থ দ র ওপর ছ ত র র জন ত ছ ত রদল র ভ স কর য মব ত র কর ছ ন স গঠন গতক ল আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।