দেশভাগের বেদনায় নিমজ্জিত এক চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক (৪ নভেম্বর ১৯২৫–৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬) যেন মনোজগৎ থেকে পূর্ববঙ্গকে কখনোই বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। পৈতৃক নিবাস তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজশাহী, জন্মেছিলেন ঢাকায়। ব্রিটিশদের প্রায় দুই শ বছর শাসনের পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ তিন টুকরো হয়ে গেল। তাতে সবচেয়ে বেশি পীড়িত হলো কাশ্মীর, পাঞ্জাব আর বাংলা প্রদেশ। র‍্যাডক্লিফের তৈরি এই বিভাজনে সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা না থাকলেও শেষতক এর ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়েছে শেকড়চ‍্যুত সাধারণ মানুষকেই। র‍্যাডক্লিফ লাইন নোটিশ জানাল, এখন থেকে মুসলিমরা থাকবে এপার বাংলায় আর সনাতনীদের ঠাঁই হবে ওপার বাংলায়। কিন্তু তারপর কী হলো? আজীবনের ঠিকানা বদলে গেল, বদলে গেল জীবন, মাথায় চাপ চাপ জমে রইল সাম্প্রদায়িকতার ট্রমা। চোখের সামনে তারা পরিবার, প্রতিবেশী, স্বজনকে হত্যা হতে দেখেছে; নাড়ি-পোঁতা ভিটায় জ্বলতে দেখেছে দাউ দাউ আগুন। এই শেকড়চ্যুত মানুষেরা পরে কি সত্যিই আর নতুন করে ঘর বাঁধতে পেরেছিল? প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে দুনিয়াদারিতে মত্ত হতে পেরেছিল আর? দেশভাগোত্তর ওপার বাংলায় ঋত্বিকের চলচ্চিত্র ত্রয়ী যেন এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছে।

মানুষ হয়তো নিজের দেহটা সরিয়ে নিতে পারে, কিন্তু মন এক জটিল বস্তু, সে কি অত সহজে স্থানান্তরিত হতে পারে? নদীর ঢেউয়ের মতন রিফিউজি মানুষের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত পাড় ভাঙে। ফেলে আসা গ্রামের প্রতিটি ঘাস, উঠোনের তুলসী মঞ্চ কিংবা জলের ঘাটে কোথায় যেন মনটা পড়ে থাকে আজীবন। এত বড় আকাশ সে কি আর রিফিউজি কলোনিতে খুঁজে পায়! দেশভাগ তো হলো, তারপর এই ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষেরা রাষ্ট্র আর সমাজের সিস্টেম আর তার তৈরি হেজিমনিতে খাবি খেতে খেতে টিকে থাকে, যা ঋত্বিকের শিল্পমানসকে প্রভাবিত করেছে গভীরভাবে, যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর নির্মিত দেশভাগ ত্রয়ী—‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ও ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬৫) চলচ্চিত্রে।

শেকড়চ্যুত মানুষেরা পরে কি সত্যিই আর নতুন করে ঘর বাঁধতে পেরেছিল? প্রতিবেশীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে দুনিয়াদারিতে মত্ত হতে পেরেছিল আর? দেশভাগোত্তর ওপার বাংলায় ঋত্বিকের চলচ্চিত্র ত্রয়ী যেন এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছে।

এই তিনটি ছবিতে দেশভাগের সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ওইপারে দেশভাগ–পরবর্তী সময়ের মানুষের সংকট। এই সংকটে ঋত্বিকের ব‍্যক্তিগত উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাও যুক্ত হয়েছে। নিজেকে তিনি পূর্ববঙ্গ থেকে আসা রিফিউজি চরিত্রে বসাতে পেরেছেন অনায়াস। প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষেরা হয়তো তা–ই করেন, একান্ত নিজস্ব অনুভূতি শিল্পের আবছায়ায় আড়াল করে রাখতে শেখেন। সুযোগ পেলেই তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের সংগ্রাম ও জীবনগাথাকে করেছেন চলচ্চিত্রের উপজীব্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি পাগলের মতো চাঁদা তুলে সহায়তা পাঠাতেন আর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ছুটে এসে নির্মাণ করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩)। ছবিটি মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক।

একাধারে নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাহিত্যিক ও শিক্ষক—ঋত্বিক ঘটক সব পরিচয় ছাপিয়ে উপনিবেশ-উত্তর ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃত। ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের (আইপিটিএ) কর্মী হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিল্পই সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। এখানেই তাঁর বামপন্থী চিন্তার উন্মেষ ঘটে। যদিও তিনি সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন না কিন্তু মার্ক্সবাদী ভাবনায় তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। নিজেই বলেছেন, ‘আমি মার্ক্সিস্ট নই, কিন্তু আমার নির্মাণে আমি মার্ক্সিস্ট।’

১৯৫০-এর দিকে ঋত্বিক ঘটক থিয়েটার ছেড়ে চলচ্চিত্রে মন দেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস ছিল যে চলচ্চিত্রই তাঁকে সবচেয়ে বিস্তৃতভাবে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করতে পারে। সাহিত্য, নাটক কিংবা সিনেমা—ঋত্বিক কোনো নির্দিষ্ট মাধ্যমকে ভালোবাসেননি, বরং যে বক্তব্য তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন, সেই বক্তব্যের উপযোগী মাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন সময় ও প্রেক্ষাপট অনুসারে। তাঁর কাছে শিল্প ছিল সমাজবদলের হাতিয়ার, রাজনৈতিক চেতনা জাগানোর অস্ত্র। এ কারণে আজকের এই স্বল্প পরিসরে ঋত্বিকের ভিজ্যুয়াল ন্যারেটিভ স্টাইল নিয়ে আলোচনায় ঢুকব না, বরং ঋত্বিক যা বলতে চেয়েছেন, সেই বক্তব্যে গুরুত্ব দিতে চাই।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ও ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬৫) এই তিনটি ছবিতে দেশভাগের সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ওইপারে দেশভাগ–পরবর্তী সময়ের মানুষের সংকট। এই সংকটে ঋত্বিকের ব‍্যক্তিগত উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাও যুক্ত হয়েছে।

দেশভাগ ত্রয়ীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রতীকায়ন। ‘কোমল গান্ধার’–এ দুই নাট্যদলের দ্বন্দ্বে ফুটে ওঠে দেশভাগোত্তর সমাজের মতাদর্শগত ফাটল। হিংসা কীভাবে বিভেদের দেয়াল গড়ে তোলে এবং প্রায়ই চক্রান্ত কোন বাস্তবতায় সফল হয়, তা ফুটে উঠেছে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় একটি পরিবার দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে গোটা রাষ্ট্রকাঠামো কী করে শ্রমিককে শোষণ করে টিকে থাকে এবং এলিট শ্রেণিকে পরিতোষণ করে রাষ্ট্র তার ক্ষমতা বা স্ট‍্যাটাস ক‍্যু টিকিয়ে রাখে। ‘সুবর্ণরেখা’য় ফুটে উঠেছে রিফিউজি ক‍্যাম্প ও জাতপাতের দুনিয়ায় নারীর চরম প্রান্তিকীকরণ হয়। পুরুষতন্ত্র কীভাবে নারীকে দেখে, কী করে তাতে মাতৃত্বের মতন দেবত্ব আরোপ করে এবং নারীর সব সিদ্ধান্তের অভিভাবক হয়ে উঠতে চায়।

কিন্তু এর মধ‍্য দিয়েই আবার ঋত্বিক এঁকেছেন দুর্দান্ত সব নারী চরিত্র। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র ‘নীতা’, ‘কোমল গান্ধার’–এর ‘অনুসূয়া’ আর ‘সুবর্ণরেখা’র ‘সীতা’—এই তিন নারী অনন্য হয়ে উঠে এসেছে। সেই ৬০-এর দশকে একটি মেয়ে নীতা পুরো সংসারের হাল ধরে আছে, সিনেমার শুরুতে আমরা দেখি, একটি মেয়ের পায়ের জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গেল; তারপর আমরা জানতে পারি, মেয়েটির নাম নীতা। ছবিটির শেষে আবারও আমরা আরেকটি মেয়ের পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে যেতে দেখি। এর মধ‍্য দিয়ে দরিদ্র পরিবারে জন্মানো নারীদের অনিঃশেষ সংগ্রামের যে সিস্টেম সমাজ বা রাষ্ট্রে তৈরি হয়, সেটাকে দেখি।

দেশভাগ ত্রয়ীর একটি বিখ্যাত দৃশ্য অবলম্বনে অঙ্কিত। পাঠক, মনে করতে পারেন কোন চলচ্চিত্র?.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প র ববঙ গ চলচ চ ত র সময় র

এছাড়াও পড়ুন:

বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে 

বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে।

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সম্প্রতি যেসব দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, সেসব দেশে পরবর্তী এক বছরে এফডিআই উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের পর এফডিআই কমেছে ১৯.৪৯ শতাংশ, চিলিতে ২০১৯ সালের পর কমেছে ১৫.৬৮ শতাংশ, সুদানে ২০২১ সালের পর ২৭.৬০ শতাংশ, ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর ৮১.২১ শতাংশ, মিশরে ২০১১ সালের পর ১০৭.৫৫ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালের পর ১৫১.৪৯ শতাংশ কমেছে। এই ধারাবাহিক হ্রাসের মধ্যে বাংলাদেশে এফডিআইর ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধির চিত্র বিশেষভাবে নজরকাড়া।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো—শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে পুনরায় চালু করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এই পরিসংখ্যান তার দারুন একটা প্রতিফলন। সাধারণত, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, কিন্তু আমরা উল্টা দেখছি। সঠিক নীতি নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অদম্য স্পৃহা কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সব সমস্যার সমাধান হয়নি, তবে সদিচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। শিগগিই সারা বছরের একটি আমলনামা (রিপোর্ট কার্ড) প্রকাশ করা হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৮৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হয় ৯২৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, তবে ২০২৪ সালে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৭৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ধারা বজায় থাকা অত্যন্ত ইতিবাচক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা/নাজমুল/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে 
  • কুবিতে খেলার মাঠে মারামারির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন
  • খুলনায় বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল, ভোলা সদরে কার্যক্রম স্থগিত
  • জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন
  • বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা পুরস্কার এবং লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডের আবেদন করুন
  • নোবিপ্রবিসাসের বর্ষসেরা সাংবাদিক রাইজিংবিডি ডটকমের শফিউল্লাহ
  • এবারও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেই বাংলাদেশ
  • ১০০ কোটির সম্পদ, স্বামীর প্রতারণা, ৪৭ বছর বয়সেই মারা যান এই নায়িকা
  • তানজানিয়ায় ‘সহিংস’ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী সামিয়া