‘বৈসাবি’ ঘিরে বেড়েছে কোমর তাঁতের ব্যস্ততা
Published: 5th, April 2025 GMT
পাহাড়ের পাড়ায় পাড়ায় ছন্দময় কোমর তাঁতের শব্দ। তৈরি করা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পোশাক। কেউ নিজের কিংবা পরিবারের সদস্যদের জন্য, কেউ আবার বিক্রির উদ্দেশ্যে কোমর তাঁতের পোশাক তৈরি করছেন। পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ ও বিদায়ের অনুষ্ঠান ঘিরেই পোশাক তৈরির এই ব্যস্ততা।
পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী পৃথকভাবে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, চাংক্রান নামে বর্ষবরণ ও বিদায়ের উৎসব পালন করে। সমতলের লোকজনের কাছে এ উৎসব ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত। ত্রিপুরাদের বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসবের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে বলা হয় ‘বৈসাবি’।
পাহাড়ের এই উৎসব ঘিরে কোমর তাঁতে পোশাক বোনার রীতি চলছে যুগ যুগ ধরে। পাহাড়ি নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কোমর তাঁতে বোনা হয়, যা চাকমাদের কাছে পিনন-হাদি আর ত্রিপুরাদের কাছে রিনাই-রিসা নামে পরিচিত। পাহাড়ের সব জনগোষ্ঠীর নারীরা এ পোশাক পরেন। সারা বছর অন্য ধরনের পোশাক পরলেও বর্ষবরণ ও বিদায়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাহাড়ি নারীদের পছন্দের তালিকার প্রথমে থাকে এই পোশাক।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার চম্পাঘাট এলাকায় এক তাঁতে দুটি রিনাই বুনছিলেন কনিকা ত্রিপুরা (৪২)। তিনি বলেন, তাঁর ও প্রতিবেশী এক ভাগনির জন্য পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী নকশা দিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে তিনি এক তাঁতে দুটি রিনাই বুনছেন। উৎসবের আগেই দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। তাই রাত–দিন কাজ করছেন।
বিক্রির উদ্দেশ্যে কোমর তাঁতে কাপড় বুনছিলেন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অনুজা চাকমা (১৮)। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি পিনন- হাদি বুনছেন। এসব পোশাক বিক্রি করে যা লাভ হয়, তাতে নিজের ছোটখাটো খরচ সামলানো যায়। এ ছাড়া কিছু টাকা মাকেও দিতে পারেন।
কোমর তাঁতে পোশাক বুননে ব্যস্ত আরেক নারী। গতকাল বিকেলে সদর উপজেলা গোমরাঘাট এলাকায়.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।