জুলাই আন্দোলনের শহীদ জসিম হাওলাদার। বাবার মৃত্যুশোকে কাতর ছিল কলেজপড়ুয়া লামিয়া আক্তার (১৭)। এর মধ্যেই গত ১৮ মার্চ পটুয়াখালীর দুমকীতে বাবার কবর থেকে বাসায় ফেরার পথে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। বাবার মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। এতদিন ঘরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশীর কেউ কেউ লামিয়াকে কটু কথা শোনাত।
এ কারণে মেয়ের দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হলেই তাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন মা রুনা বেগম। সেই সুযোগ পেলেন না তিনি। এর আগেই আত্মহননের পথ বেছে নিল লামিয়া। মেয়ের মৃত্যুতে পাগলপ্রায় মা। তিনি বলেন, ‘দুর্বিষহ ঘটনার পর মেয়েকে একলা ছাড়িনি। এতদিন লগে লগে রাখছি। জামাই গেল, মাইয়ারেও বাঁচাইতে পারলাম না।’
লামিয়া গত শনিবার রাতে রাজধানীর আদাবরের শেখেরটেকের ভাড়া বাসায় ফ্যানের সঙ্গে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জুলাই ফাউন্ডেশন, এনসিপি ও বিএনপি নেতারা হাসপাতালে লামিয়ার লাশ দেখতে যান। হাসপাতালে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম বলেন, ‘আজকের এই সরকার কী জবাব দেবে? তারা যদি এটুকু দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তাহলে আমরা বলব দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্বটা ছেড়ে দিক।’
শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, ‘এই সরকারের সর্বপ্রথম দায়িত্ব ছিল জুলাই শহীদদের পরিবারের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র।’
জুলাই ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য সাবরিনা আফরোজ সেবন্তি বলেন, ‘লামিয়া ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম। সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। তার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, সেটার কারণে জীবন নিয়ে হতাশায় ছিল সে।’
সাবরিনা জানান, শনিবার সন্ধ্যায় তিনি শেখেরটেকে লামিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন তাকে দেখতে। তখন লামিয়া চুপচাপ বসে ছিল। দীর্ঘক্ষণ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা গল্পের পর তিনি যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন, তখন লামিয়া তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিল, ‘ওপরওয়ালা যা করে, সেটা নাকি ভালোর জন্যই করে। আমার কী ভালো করেছে বলতে পারেন? আমার সঙ্গে খালি খারাপই হয়েছে।’ জবাবে সাবরিনা তাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি পরীক্ষার প্রস্তুতি নাও। আর ওসব নিয়ে ভাববে না। আমাকে সে কথা দিল ঠিকঠাক পড়াশোনা করবে।’ বাসা থেকে বের হওয়ার আড়াই ঘণ্টা পর লামিয়ার আত্মহননের খবর পান সাবরিনা। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, লামিয়া নিজেকে শেষ করে দিতে পারে। তিনি জানান, আনুমানিক দুই সপ্তাহ আগে লামিয়া ঢাকার বাসায় আসে। জুলাই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছিল।
গতকাল রোববার সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে লামিয়ার লাশের ময়নাদন্ত করা হয়। মর্গে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন শহীদ পরিবারের কবরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। অনেকে পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব পরিবারের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
জুলাই ২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটির চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘অপমান সহ্য করতে না পেরে লামিয়া আত্মহত্যা করেছে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
আদাবর থানার ওসি এস এম জাকারিয়া বলেন, ‘এ ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনরা লাশ নিয়ে যান পটুয়াখালীর দুমকীর পাঙ্গাসিয়া গ্রামে। তারা জানান, সন্ধ্যার দিকে ঢাকা থেকে লামিয়ার লাশ দুমকীর দক্ষিণ পাঙ্গাসিয়ায় আনা হয়। পাঙ্গাসিয়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে বাবা জসিম হাওলাদারের কবরের পাশে লামিয়াকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
লামিয়ার দাদা আব্দুস সোবাহান হাওলাদার বলেন, ‘আমার নাতনি তো শ্যাষ হইয়্যাই গ্যাছে। যদি অগো উছিলায় আমার নাতনি আত্মহত্যা কইরা থাহে, তাইলে আমি অগো ফাঁসি চাই।’
স্থানীয় ইউপি মেম্বার রানা হাওলাদার বলেন, ‘ধর্ষকদের কঠিন বিচার চাই, যাতে এ ধরনের জঘন্য ঘটনা আর কোনোদিন না ঘটে।’
ধর্ষণের ঘটনায় লামিয়া বাদী হয়ে দু’জনকে আসামি করে দুমকী থানায় মামলা করে। দুই আসামির মধ্যে রয়েছে পাঙ্গাসিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি মৃত মামুন মুন্সির ছেলে শাকিব মুন্সি ও সোহাগ মুন্সির ছেলে সিফাত মুন্সি। শাকিব পাঙ্গাসিয়া এবিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং সিফাত দুমকী সরকারি জনতা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। লামিয়ার সহপাঠী ছিল সিফাত। মামলায় এজাহারভুক্ত দুই আসামি শাকিব ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা কারাগারে আছে।
পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার আনোয়ার জাহিদ জানান, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য গত শনিবার দুই আসামির নমুনা নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর আসামিদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, ঘটনার সঙ্গে আরও একজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
লামিয়ার বাবা জসিম হাওলাদার ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে গুলিবিদ্ধ হন। পরে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ জুলাই মারা যান তিনি। জসিম ঢাকায় একটি এনজিওর গাড়িচালক ছিলেন। তিনি শেখেরটেকে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বাস করতেন।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র র স বর ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনে শিকারিদের হামলায় বন কর্মকর্তা আহত
সুন্দরবনে হরিণ শিকারীদের হামলায় পূর্ব বনবিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেব আহত হয়েছেন। সোমবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ডিমেরচর এলাকায় হামলা করা হয়। পরবর্তীতে তিন শিকারিকে আটক করেছে বনরক্ষীরা।
শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদুল্লাহ জানান, হরিণ শিকারিদের আক্রমণে একজন বন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। হামলাকারীদের তিনজনকে আটক করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
হরিণ শিকারের ফাঁদে আটকা পড়ল বানর
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে ৮ ফুট লম্বা অজগর অবমুক্ত
তিনি আরো জানান, বন বিভাগের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তারা অভিযোগ দিলে এবং আসামিদের হস্তান্তর করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আটকরা হলেন, বাগেরহাট সদর উপজেলার সুগন্ধি গ্রামের রাফি হাসান (২৬), রামপাল উপজেলার সোনাতুনিয়া গ্রামের শহিদ মল্লিক (২৮) ও একই উপজেলার ঝালবাড়ি গ্রামের আল আমিন আকুঞ্জি (২৭)।
আহত সহকারী বন সংরক্ষক রানা দেব বলেন, ‘‘বন্যপ্রাণি রক্ষা ও হরিণ শিকাররোধে বনরক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে ডিমেরচর এলাকায় বনের ভেতরে হেঁটে টহল দিচ্ছিলাম। বনের মধ্যে হরিণ ধরার জন্য পেতে রাখা একাধিক ফাঁদ দেখতে পাই। সেখানে চার থেকে পাঁচজন শিকারিকেও দেখতে পাই। আমি দৌড়ে গিয়ে একজনকে ধরে ফেললে বাকি শিকারিরা ফিরে এসে আমাকে মারধর করে ধৃত শিকারিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’’
পরে বনরক্ষীরা ঘটনাস্থল থেকে ১৮টি হাঁটা ফাঁদ উদ্ধার করেন বলে জানান তিনি।
আহত রানা দেবকে তাৎক্ষণিকভাবে দুবলারচরের অস্থায়ী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। হামলার পরপরই বনরক্ষীরা অভিযান চালিয়ে তিন শিকারিকে আটক করে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী ও শরণখোলা রেঞ্জের অন্যান্য কর্মকর্তারা রাস পূজার দায়িত্ব পালনের জন্য দুবলার চরে অবস্থান করায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
ঢাকা/শহিদুল/বকুল