নতুন দর্শক-শ্রোতার সামনে হারিয়ে যাওয়া গাজীর গান
Published: 1st, May 2025 GMT
বিভিন্ন নাচের দল একের পর এক মঞ্চ মাতিয়ে গেছে। শেষে পরিবেশিত হয় লোকনৃত্য ‘ধামাইল’। এরপরই ছিল ভিন্ন আয়োজন, ভিন্ন এক পরিবেশ। রঙিন আলখাল্লায় মঞ্চে আসেন ‘গাজীর খলিফা’। একে একে তাঁর সঙ্গে সবাই মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। ঢোলে বাড়ি পড়তেই চাঙা হয়ে ওঠে গানের আসরটি। নতুন কিছুর অপেক্ষায় দর্শক-শ্রোতা নড়েচড়ে বসলেন।
ধীরে ধীরে বন্দনা শেষে গাজীর খলিফা শুরু করেন পুঁথির বয়ান। প্রায় হারিয়ে যাওয়া লোকজ ঐতিহ্যের ‘গাজীর গান’ যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে জেগে ওঠে নতুন প্রজন্মের সামনে। গত ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার পৌরসভা প্রাঙ্গণে মেয়র চত্বরের খোলা মঞ্চে ছিল এই আয়োজন। বৈশাখী লোকনাট্য উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ এ আয়োজন করে। ব্যবস্থাপনায় ছিল শিল্পকলা একাডেমি মৌলভীবাজার জেলা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই গাজীর গানের আসর শুরু হয়। গায়েন আর বায়েন জমিয়ে তুলেন সরল কথা ও সুরের আসর। রঙিন আলখাল্লায় মোড়া গাজীর খলিফার ভূমিকায় ছিলেন মো.
সামনে বসা দর্শক-শ্রোতা যেমন তালে তালে দুলে ওঠেন, তেমনি চত্বরের সীমানার বাইরে সড়কের ওপর রিকশার সারি জমে যায়। রিকশাওয়ালা যাত্রী বহন বাদ দিয়ে রিকশার আসনে বসে কিংবা রিকশায় হেলান দিয়ে শোনেন গাজীর গান। শহুরে শ্রোতা-দর্শকের কাছে এ এক নতুন পাঠ, নতুন কিছু। এর আগে অনেকে গাজীর গানের নাম শুনে থাকলেও, এমন করে গাজীর গানের সঙ্গে অনেকেরই নতুন পরিচয়, নতুন মুগ্ধতা।
চতুর্দিকে বন্দনা শেষ হলে ‘খলিফা’ বা ‘গায়েন’ আসেন মূল পুঁথির কাহিনি নিয়ে। গান ও কথায় মধ্যযুগের এক প্রেমকাহিনি ‘গাজী কালু চম্পাবতী’র বয়ান চলতে থাকে। পুঁথির পরতে পরতে চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা, পঙ্ক্তি, যা নির্মল আনন্দকে ধারণ করে আছে। ‘দারুণ বিধিরে না জানি কী ঘটল তামশা আমার কপালে’ কিংবা ‘হায়রে পিরিতের মরা মরছেরে মঙ্গলবারে’ এ ধরনের অনেক পঙ্ক্তি একদম সরল অনুভূতির প্রকাশ হয়ে বাতাসে বাতাসে ঘুরতে থাকে। পুঁথির কাহিনি গায়েন নানা অঙ্গভঙ্গি করে, মঞ্চে ঘুরে ঘুরে বলতে থাকেন। বায়েনরা সুরে সুরে সেই কথারই রেশ ধরে টানেন। এভাবে ঘণ্টাখানেক ধরে কথা ও গানে ‘গাজী–কালু চম্পাবতী’র কাহিনি বর্ণনা চলে। তাঁদের দলে গায়েনসহ ছিলেন পাঁচজন।
লোক-গবেষক ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, একসময় গ্রামীণ জনপদে আনন্দ-বিনোদনের অন্যান্য লোকজ উপাদানের সঙ্গে এই গাজীর গানটিও ছিল। নানা উৎসব-পার্বণ, নানা দিবসে গাজীর গান গাওয়া হতো। প্রায় এলাকাতেই গাজীর খলিফা ছিলেন, ছিল তাঁর দলবল। তাঁরা ঘুরে ঘুরে এগ্রাম-ওগ্রাম হয়ে দূরদূরান্তেও গাইতে যেতেন। কারও বাড়ির উঠান, কোনো খোলা জায়গায় আসর বসেছে। সারা রাত ধরে গাজীর গান চলেছে। নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ, নানা বয়স ও শ্রেণির মানুষ মিলেমিশে একসঙ্গে চাটাই পেতে আসর জমিয়ে রেখেছেন।
বিনোদনের বিভিন্ন আধুনিক মাধ্যম সহজ হওয়ার পর এই লোকজ উপাদানগুলো ক্রমশ লুপ্ত হতে থাকে। অনেকেই গাজীর গানসহ লোকজ সংস্কৃতি ভুলতে বসেছেন। হারিয়ে গেছেন গায়েন ও বায়েন। তবু কিছু এলাকায় এখনো কিছু গায়েন দলবল নিয়ে গাজীর গানকে আঁকড়ে আছেন। আবদুস শহীদ এ রকমই একজন ‘গাজীর খলিফা’। তিনি এখনো ধরে রেখেছেন ১২-১৩ জনের একটি দলকে।
মেয়র চত্বরের মঞ্চে ওঠার প্রস্তুতির সময় কথা হয় আবদুস শহীদের সঙ্গে। তিনি বললেন, তাঁর বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার নছরতপুরে। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি গাজীর গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। শুরুতে একই উপজেলার (কমলগঞ্জ) বড়গাছের ওস্তাদ আবদুল বারীর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে বায়েন হয়ে যেতেন। একটা পর্যায়ে তিনি ওস্তাদের সম্মতিতে খলিফার ভূমিকায় উন্নীত হন। গাজীর গানের দল নিয়ে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন গ্রামে গান গেয়ে থাকেন। সিলেট, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি দল নিয়ে গেছেন। তাঁর ভাষ্য, গাজীর গান আগের থেকে কমেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে গাজীর গানের আবেদন এখনো আছে। তিনি বছরে ৮-১০টা আসরে গানের ডাক পান। কখনো কোনো পালা-অনুষ্ঠানে, কখনো পারিবারিক আয়োজনে। অনেকে মানত করেও গাজীর গানের আয়োজন করে থাকেন।
স্ত্রী, দুই ছেলে নিয়ে আবদুস শহীদের সংসার। আগে পরিবহনশ্রমিক ছিলেন। এখন একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাস্ট্যান্ডে ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনের ফাঁকেই গাজীর গানের ডাক আসে, এখানে-ওখানে ছুটে যান। প্রতিবছর ১০ ফাল্গুন বাড়িতে গাজীর গানের আয়োজন করেন তিনি। স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূরদূরান্তের মানুষ গাজীর গানের ভক্তরা তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন। আবদুস শহীদ বলেন, ‘গাজীর গান আমারে নতুন জীবন দিছে। যত দিন বাঁচিয়া আছি, গাজীর গান গাইমু।’
লোক-গবেষক আহমদ সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, আগে জারি–সারি গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছিল। এখন তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। আধুনিক বিনোদনের প্রবাহে সংস্কৃতির এই লোকজ উপাদান হারিয়ে যেতে বসছে। তবে মানুষের মধ্যে এখনো এসবের আবেদন আছে, আগ্রহ আছে। চতুর্দশ শতাব্দীতে এই গাজীর গানের উৎপত্তি। সারা দেশেই কমবেশি গাজীর গান প্রচলিত ছিল। ‘গাজী কালু-চম্পাবতী’ মধ্যযুগের একটি অসাম্প্রদায়িক, অপরূপ প্রেমকাহিনির পুঁথি। লোকজ এই ধারা টিকিয়ে রাখা দরকার। এগুলো হচ্ছে একটি সমন্বিত সংস্কৃতি, সব ধরনের মানুষকে টানে।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অক্সিডেন্টাল টাকা নিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি স্থানীয়রা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ২৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ শনিবার। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে মাগুরছড়ার ফুলবাড়ী চা বাগানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ১ নম্বর গ্যাস অনুসন্ধান কূপে খননকালে ভয়াবহ ওই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আগুনের লেলিহান শিখা ৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠে যায়। পুড়ে কয়লা হয়ে যায় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের আশপাশের গাছপালা, মারা যায় বহু পশুপাখি। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় চা বাগান, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, রিজার্ভ গ্যাস, পরিবেশ প্রতিবেশ ও ভূমিস্থ পানিসম্পদ। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য আজও ভাসে মৌলভীবাজার জেলাবাসীর মনে। অথচ সেই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কূপ খননকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টালের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি সরকার। উল্টো নিজেদের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার বীমার টাকা তুলে ভেগেছে অক্সিডেন্টাল।
১৯৯৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল অব বাংলাদেশ লিমিটেডের। অনুসন্ধান শুরুর পর তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ হবে এলাকা– এই ভেবে কমলগঞ্জ তথা মৌলভীবাজারের মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। তেল-গ্যাসের সন্ধানে ৩ হাজার ৭০০ মিটার কূপ খননের লক্ষ্য নিয়ে কাজও শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ৮৪০ মিটার খননের পরই ঘটে দুর্ঘটনা। টানা ১৫ দিন আগুন জ্বলার পর যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির বিশেষজ্ঞ রিচার্ড চাইল্ড রিসহ চার সদস্যের একটি দল আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে পুরো কূপের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস।
বিভিন্ন সময় তেল-গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিসিএফ গ্যাস পুড়ে যায়; যার দাম ছিল প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষতি ছিল আরও ১১ হাজার কোটি টাকার। বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে মোট ক্ষতির পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অগ্নিকাণ্ডে মাগুরছড়া ও আশপাশের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণে ২৯টি চা বাগানের ৪৬ কোটি ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩০ টাকার ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৬৯ দশমিক ৫ হেক্টর এলাকার ২৫ হাজার ৬৫০টি পূর্ণবয়স্ক গাছ পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয় প্রায় ৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার। ওই ঘটনার সরকারি তদন্তে ক্ষতি বাবদ ধরা হয় ৫০৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ ছাড়া বনাঞ্চলের সম্ভাব্য ক্ষতি হয়েছে ৪০ হেক্টর ভূমি এবং ১৫ হাজার ৪৫০টি বৃক্ষ। ধারণা করা হয়, আগুনের কারণে ১০ বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, বনাঞ্চলের মোট ক্ষতি ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। বিস্ফোরণের ফলে ২ হাজার ফুট রেলপথও ধ্বংস হয়। এতে রাজস্ব ছাড়া ক্ষতি হয়েছে ৮১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। সড়কপথের ক্ষতি ২১ কোটি টাকা। গ্যাস পাইপলাইনের ক্ষতি ১৩ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতি ১ কোটি ৩৫ লাখ ৯ হাজার ১৮৬ টাকা। মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জির অধিবাসীদের পানের বরজগুলোতে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৭৫০ টাকা হারে মোট ক্ষতি হয় ১২ লাখ টাকা।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুন বিস্ফোরণের পর জ্বলতে থাকা কূপের উৎস মুখ বন্ধ করার কাজ সম্পন্ন হয় পরের বছর ৯ জানুয়ারি। তার আগেই ১৯৯৭ সালের ২০ ডিসেম্বর অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া থেকে বিদায় নেয়। এতে দেশজুড়ে দেখা দেয় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
মাগুরছড়া তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, মাগুরছড়া অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারি যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তারা এক মাসের মধ্যেই তাদের প্রতিবেদন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন বীমা কোম্পানিতে জমা দিয়ে সেই সময়ই অক্সিডেন্টাল তাদের বীমাকৃত যন্ত্রাংশ, রিগ ইত্যাদির ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেয়। অথচ যে অক্সিডেন্টালের কারণে এত বড় ক্ষতি হলো, তাদের কাছ থেকে সরকার বা এলাকাবাসী এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠার নয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারে আগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
এদিকে মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে আজ কমলগঞ্জে মানববন্ধন করবে পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটি, কমলগঞ্জ উন্নয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। মাগুরছড়া বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও কমলগঞ্জের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগের দাবি জানিয়েছে তারা।