নাম পাল্টানো বাঙালির একটি প্রিয় খেলা
Published: 29th, May 2025 GMT
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা খবর দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। পাবনায় এডওয়ার্ড কলেজ নামে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে সুচিত্রা সেনের নামে মেয়েদের একটা হোস্টেল ছিল। সেটির নাম বদলে নাকি জুলাই শহীদদের নামে করা হয়েছে। শহীদদের নামে নতুন নতুন স্থাপনা করা যায়। যেটি আগে হয়েছে এবং পরিচিতি পেয়েছে, সেটি হঠাৎ করে বদলে ফেলার কোনো যুক্তি দেখি না।
এখন সব জায়গায় নাম বদলের হিড়িক পড়ে গেছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর এ রকম হয়েছিল। বাঙালির আদিখ্যেতা একটু বেশি। সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধু লাগাতে হবে। তো নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারে সাইনবোর্ড উঠল—বঙ্গবন্ধু মুরগি মার্কেট। কারওয়ান বাজারে দেখা মিলল বঙ্গবন্ধু মৎস্য মার্কেটের। বাজারে চলে এল বঙ্গবন্ধু ব্লেড, বঙ্গবন্ধু সিগারেট। এখন জুলাই শহীদদের নিয়ে একই রকম টানাহেঁচড়া চলছে। মাঝে কিছুদিন পীর-আউলিয়া নিয়ে মাতামাতি ছিল। এর ফলে দুটি বিমানবন্দরের নাম বদলে যায়। পীর-আউলিয়ার নামে স্থাপনা হলে কার সাধ্য সেটি পাল্টায়?
বেশ কিছুদিন সাত কলেজ ছিল সংবাদ শিরোনাম। দুই ভিসির রশি–টানাটানির কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছিনতাই হয়ে সাত কলেজ ঢুকেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানেও তার মর্যাদা ছিল না। স্ট্যাটাস ছিল দ্বিতীয় পক্ষের মতো। তো তারা মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করল। লড়াই মানে রাস্তা আটকে মানুষকে যত বেশি কষ্ট দেওয়া যায়। এটি করতে পয়সা খরচ হয় না। ওই সময় তিতুমীর কলেজের ছাত্ররা তাঁদের কলেজে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঘোষণা দিয়ে দিলেন—তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, একাত্তরের আগে এই কলেজের নাম ছিল জিন্নাহ কলেজ। যাহোক, পরে অনেক আলোচনা-সংগ্রামের পর ঠিক হলো সাত কলেজ নিয়ে আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে। তার নাম নিয়েও মতভেদ দেখা দিল।
সাম্প্রতিক খবর হলো, সাত কলেজের এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন অন্তর্বর্তী প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁর সদর দপ্তর হবে ঢাকা কলেজে। প্রশাসকের দপ্তর কোথায় হবে, এ নিয়ে এখনো কলেজ জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি বলে স্বস্তি পাচ্ছি।
ফিরে আসি সুচিত্রা সেন প্রসঙ্গে। সুচিত্রা আমাদের তিন জেনারেশনের ক্রাশ। এ দেশের বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকের কাছে তাঁর মতো জনপ্রিয় নায়িকা আর কেউ হয়েছেন বলে জানি না। কী কারণে তাঁকে ছেঁটে ফেলা হলো, এর কারণ বোঝার চেষ্টা করছি। তিনি তো আওয়ামী লীগ করতেন না। স্বৈরাচারের দোসরও ছিলেন না। তবে তাঁর দুটো মস্ত অপরাধ, যা কারও কারও কাছে ক্ষমার অযোগ্য। প্রথমত, তিনি হিন্দু। দ্বিতীয়ত, তিনি ভারতীয়। অবশ্য জন্মসূত্রে ‘বাংলাদেশি’ হলেও মাফ পেতেন না। যেমন পাননি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কিংবা জগদীশচন্দ্র বসু। যাঁরা নাম পাল্টেছেন, তাঁরা হয়তো এই দুজনের নামই শোনেননি।
কিছুদিন আগে জুলাই শহীদ রিয়া গোপের নামে ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের নামকরণ হলো। শিশু রিয়া গোপ ফ্যাসিবাদের বলি। তার নামে একটি স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান হলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু অনেকেই বলেন, আমরা গুণের ও গুণীর কদর করতে জানি না। আমরা এমন জাতি, যারা দুধ বেচে তামাক কেনে, মাছ পাচার করে শুঁটকি আনে।
নতুন ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প ছিল ধানমন্ডি। ১ থেকে ৩২ পর্যন্ত ৩২টি রাস্তার ছিল এর বুক চিরে আর চারদিক ঘিরে। রাস্তার নম্বর দেখেই মানুষ বাড়ি খুঁজে পেত। দেশে যখন প্রথমবার সামরিক শাসন এল, তখন রাস্তার নম্বর বদলে গেল। ধানমন্ডি লেকের পুব পাশের রাস্তার নম্বর হলো ৩ থেকে ১৫ আর পশ্চিমের রাস্তাগুলো হলো ২/এ থেকে ১৫/এ। অর্থাৎ সাতমসজিদ রোডে যেসব রাস্তার মোহনা, সেগুলোর নম্বরের পাশে যুক্ত হলো ‘এ’। ১ আর ২ আগের মতোই থাকল। হিসাব মেলাতে ২৭ নম্বর হলো ১৬ নম্বর।
সাদেক হোসেন খোকা মেয়র হয়ে ভাবলেন, জাতির বিশিষ্ট সন্তানদের নামে রাস্তার নাম থাকা উচিত। তবে তিনি নতুন রাস্তা বানানোর দিকে মন না দিয়ে পুরোনোগুলো নিয়েই নাড়াচাড়া করলেন। এভাবেই আমরা পেয়ে গেলাম ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন সড়ক, ভাষাসৈনিক বিচারপতি আবদুর রহমান সড়ক, কমরেড ফরহাদ সড়ক ইত্যাদি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্য সব সেক্টর কমান্ডারের নামে সড়কের নামকরণ করলেও দৃষ্টিকটুভাবে বাদ থাকলেন মেজর জলিল আর কর্নেল তাহের। কারণটি সহজেই অনুমান করা যায়। এই দুজন মেয়র খোকার দলের ‘শত্রুপক্ষের’ লোক।
এর সঙ্গে মিলে যায় আইয়ুব–জমানার একটি ঘটনার কথা। ওই সময় মোহাম্মদপুর নামে একটি নতুন আবাসন প্রকল্প হয়েছিল ভারত থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন অবাঙালি। তো মোহাম্মদপুরে সুলতানি আর মোগল আমলের সব রাজা-বাদশাহর নামে সড়ক থাকলেও বাদ পড়েছিলেন আকবর আর জাহাঙ্গীর। হয়তো তাঁদের খাঁটি মুসলমান মনে করা হতো না। তবে জাহাঙ্গীরের বেগম নূরজাহানের নামে মোহাম্মদপুরে একটি রাস্তা আছে।
শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসে ধানমন্ডিতে দুটি সড়কের নাম বদলান। জিয়াউর রহমানের আমলে ৩২ নম্বর সড়ক হয়েছিল ১১ নম্বর। হাসিনা সেটি আবার ৩২ করলেন। ২৭ নম্বরকে ১৬ নম্বর করা হয়েছিল। হাসিনা সেটার নাম দিলেন শেখ কামাল সরণি।
আমি ওই এলাকার বাসিন্দা। গাড়ি নেই। সচরাচর রিকশায় যাতায়াত করি। তো রিকশাচালককে যদি বলি ১৫ নম্বরে যাব, সে আমাকে নিয়ে যায় মাদানির আমলের ১৫ নম্বরে। কমরেড ফরহাদ সড়ক কিংবা শেখ কামাল সরণিতে যাব বললে সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, বাংলায় বলুন। রিকশাওয়ালার কোনো দোষ নেই। রাস্তা যে নামে পরিচিতি পেয়েছে, সেটির নাম কাগজে বদলালেও মানুষের মনে কিন্তু পুরোনোটিই গেঁথে আছে। তারপরও লোকে সড়ক বা প্রতিষ্ঠানের নাম বদলায় কেন? বদলায় এ জন্য যে তার হাতে বদলানোর ক্ষমতা আছে এবং সে তার পছন্দ বা ইগো দিয়ে যা খুশি করতে পারে।
জিপিওর সামনে থেকে গুলিস্তানের দিকে যে রাস্তা, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে শহীদ আবরার সড়ক। যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বানানো হয়, তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল জিন্নাহ অ্যাভিনিউ। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের জাতির পিতা। ১৯৭১ সালে আমরা পেলাম নতুন জাতির পিতা। তাঁর নামে এটি হয়ে গেল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। এখন সেখানে এসেছে শহীদ আবরার।
২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের জন্য জিন্নাহ দায়ী ছিলেন না। জুলাই ম্যাসাকারে শেখ মুজিবের কোনো দায় নেই। তারপরও দুজনেই ব্রাত্য। পাবলিক পারসেপশনে প্রথমজন পাকিস্তানের প্রতীক, যেটি আমরা ভেঙে দিয়েছি। দ্বিতীয়জন হাসিনা স্বৈরাচারের প্রতীক। সেটির আর জায়গা নেই। শেখ হাসিনা পালালেন। যাওয়ার সময় বাপকেও শেষ করে গেলেন।
আমার মনে হয়, নাম পাল্টানো বাঙালির একটি প্রিয় খেলা। তবে এ খেলাই শেষ খেলা নয়। এই দিন তো দিন নয়, আরও দিন আছে।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ন ম বদল স ত কল জ ধ নমন ড হয় ছ ল র জন য র একট
এছাড়াও পড়ুন:
কুমিল্লায় বাড়ছে গোমতী নদীর পানি
নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টিপাতে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বাড়ছে। তবে তা এখনও বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
শুক্রবার সন্ধ্যায় কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি সমকালকে জানান, টানা বর্ষণ এবং ভারত থেমে আসা পানিতে গোমতীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখনও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবোর বন্যা নিয়ন্ত্রন কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ১০৪ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোমতী নদীর পানির উচ্চতা ছিল ৬ দশমিক ৮১ মিটার। যদিও বিপৎসীমা নির্ধারিত আছে ১১ দশমিক ৩০ মিটার। নদীর পানির উচ্চতাসীমা এখনও বিপৎসীমার ৪.৪৯ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে নিম্নচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাতে কুমিল্লা রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে নগরীর অধিকাংশ প্রধান পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। জলাবব্ধতার সৃষ্টি হয় নগরীর বেশ কিছু এলাকায়। ফলে দুর্ভোগ বেড়েছে জনজীবনে। পানি ঢুকে পড়েছে বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও। শুক্রবার সকাল থেকে সরেজমিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কুমিল্লা সিটি কপোরেশনে সামনের সড়ক, রেইসকোর্স, বিসিক শিল্পনগরী, জিলা স্কুল সড়ক, নগরীর টমছম ব্রিজ থেকে কান্দিরপাড় সড়ক, ঠাকুরপাড়া, মুরাদপুর, ছাতিপট্টি, কান্দিরপাড়-রাণীর বাজার সড়ক, অশোকতলা, ধর্মপুর ছায়া বিতান ও শুভপুরসহ নগরীর নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। অনেকেই ড্রেনে পড়ে আহত হন।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি রোকেয়া বেগম শেফালী বলেন, নগরীতে এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই জলাবব্ধতার সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতামুক্ত নগরীর জন্য নাগরিক ও নগর কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে। পানি প্রবাহের ড্রেন ও খাল গুলি এখনই খনন করতে হবে।
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন সমকালকে বলেন, গত দুই দিনের হঠাৎ বৃষ্টিতে নগরীর বেশ কিছু সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। এতে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা পানি সরাতে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, নগরীর পানি প্রবাহের প্রধান প্রধান বড় বড় ড্রেন ও খালের মাটি অপসারণে ৯ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ঈদের পর কাজ শুরু হবে।