শীতে ঢাকায় গ্যাস-সংকট সীমা ছাড়িয়েছে। অনেক এলাকায় ভোর হতে না হতেই গ্যাস চলে যাচ্ছে, আসছে রাতে। ফলে মধ্যরাতে চুলা জ্বলছে, রান্নাবান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। মাসের শুরুতে তিন দিন একবারের জন্যও গ্যাস আসেনি।

দুই বছর আগে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম—‘গ্যাসের চুলা না জ্বালালেও কেন মাস শেষে বিল’। সেই চিত্রের বদল হয়নি। ফলে মাস শেষে গ্যাসের বিল যেমন দিতে হচ্ছে, আবার ইনডাকশন চুলা, রাইস কুকারে রান্নার কারণে বাড়তি বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে কিংবা সিলিন্ডার কেনার কারণে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।

এই যে বাড়তি খরচের বোঝা, এর কোনো দায় সাধারণ মানুষের নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া শেখ হাসিনা সরকারসহ পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ভুল জ্বালানি নীতির ফলাফল এটা।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে অলিগার্কদের শাসনে যে স্বজনতোষী অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, সেখানে লুটপাটের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে, এর অন্যতম উৎস ছিল এ খাত। ফলে লোকসানের বিরাট বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নাগরিকদের ঘাড়ে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ আর জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস আর জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার নামে যে দাম বাড়ানো হয়েছে, সেটাই হয়নি। এটা ছিল প্রতারণা করে, ছল করে নাগরিকের পকেট থেকে টাকা বের করে নেওয়ার ফন্দি।

ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ-আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে যে অলিগার্কি কাঠামো ছিল, তারা রাজস্ব বাড়ানোর খুব সহজ সমাধান হিসেবে কর, ভ্যাট, শুল্ক ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছিল। ফলে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার এমন এক যন্ত্র হয়ে উঠেছিল, যাদের ভাবনায় জনগণ হলো হাতেম তাই কিংবা গৌরী সেন।

কোভিড মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের বয়ানটাকে নগ্ন করে দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের সিংহভাগ মানুষ কীভাবে কায়দা করে টিকে আছে, সেটা সত্যিই অর্থনীতিবিদদের একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। আজ ওষুধের খরচ, কাল ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, পরশু পাত থেকে ডিমের খরচ, দুধের খরচ ছেঁটে ফেলে মানুষ প্রতিনিয়ত তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ছুটন্ত ঘোড়াটার সঙ্গে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু সবারই সহ্যের একটা সীমা থাকে।

জীবনযাপনের এই সর্বব্যাপী সংকট থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই-আগস্টে সর্বস্তরের মানুষ ছাত্রদের ডাকে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। রক্ত আর অসাধারণ আত্মত্যাগে তাঁরা রচনা করেন অনন্য এক ইতিহাস। কিন্তু জনগণের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সমাধানবৃত্ত থেকে কতটা বের হওয়া গেল?

এটা অস্বীকারের জো নেই, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ভেঙে পড়েছিল, অর্থনীতি যেভাবে খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে দেশকে ঠিক রাস্তায় তোলাটা বিশাল এক কঠিন কাজ। পাঁচ মাসে সেটা প্রত্যাশা করাও বোকামি। কিন্তু এটাও বাস্তবতা যে মানুষ আর পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরতে চান না। তাঁরা চান না, সরকার ব্যয়ের ভারটা তাদের ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া কাঁধে চাপিয়ে দিক। পুরোনো ব্যবস্থার সঙ্গে তাঁরা সুস্পষ্ট একটা ছেদবিন্দু দেখতে চান।

প্রশ্ন জাগছে, সরকার কেন একদিকে শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি মানুষের পকেট থেকে বের করতে চাইছে, অন্যদিকে মহার্ঘ ভাতায় সাত হাজার কোটি ব্যয় করার কথা চিন্তা করছে। অর্থনীতিবিদ ড.

জাহিদ হোসেন প্রশ্ন করেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা কি আছে?

কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টোটাই তাঁদের সামনে নিয়ে আসছে। সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম একধাপে ঘনফুটপ্রতি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ধুঁকতে থাকা শিল্প খাতে বড় একটা ধাক্কা লাগবে। এমনিতেই সরকার পতনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে শিল্প খাত ও এর শ্রমিকেরা। অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। দেশে হঠাৎ অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই কাজ হারানোর বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে কি? গ্যাসের দাম বাড়লে পাটিগণিতের ঐকিক নিয়মের সূত্রেই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

নতুন বছর মানেই বাংলাদেশের মানুষের সামনে নতুন নতুন ব্যয়ের বোঝা যুক্ত হওয়া। রংপুর থেকে আমার এক বন্ধু তাঁর সন্তানের স্কুলে ভর্তির ফি জোগাড়ের জন্য ফোন দিয়েছেন। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ২০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে। মানে যাঁদের ছেলেমেয়ে বেসরকারি স্কুল-কলেজে পড়ে, তাঁদের অনেকের জন্য বছরের শুরুটা হয় এ রকম রূঢ় বাস্তবতা দিয়ে। প্রাইভেট স্কুলগুলো নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে, প্রতিবছর ভর্তি ফি দিতে হবে। এই যে এক দেশে সাত-আটটা শিক্ষাব্যবস্থা, এর চেয়ে বড় বৈষম্য আর কী হতে পারে!

নতুন বছর মানে, যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকেন, তাঁদের বাসাভাড়া বাড়া। যাঁরা বাড়তি খরচের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেন না, তাঁদের চলে যেতে হয় শহরের আরেক প্রান্তে, কম ভাড়ার বাসায়। ওই যে ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক সিনেমার শেষ দৃশ্যটা এই শহরের একটা রূঢ় বাস্তবতা।

দুই.
নতুন বছরে ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব—সবার খরচ বাড়ছে। এখানে সরকারের নীতিটা সাম্যবাদী। কারণ, সরকার ১০০-এর বেশি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়েছে। ভ্যাট হলো পরোক্ষ কর। পোশাক কিনতে, ওষুধ কিনতে, বেড়াতে গেলে খরচ বাড়বে। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খরচ বাড়বে। বিদেশি ফল খেতে গেলে খরচ বাড়বে।

মুঠোফোনে কথা বলতে গেলে খরচ বাড়বে। খরচ বাড়বে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গেলে। অর্থ উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, এই বর্ধিত ভ্যাটে মূল্যস্ফীতি হবে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ছোট, মাঝারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। ব্যয়ের মানুষ ভোগ কমিয়ে দিলে তাতে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির বারোটা বাজবে।

প্রথম আলোর খবর বলছে, রাজস্ব আদায় কম, আইএমএফ চাপ দিচ্ছে, বিদেশি ঋণ আসছে না। তাই বাজেটঘাটতি মেটাতে শুল্ক-কর ও ভ্যাট বাড়ানোর সহজ রাস্তা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে মানুষের পকেট থেকে সরকারের কাছে যাবে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ রকম সিদ্ধান্তে মানুষ যে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই আঁচ করা যায়। বিএনপি, নাগরিক কমিটিসহ সব ধারার রাজনৈতিক দল সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ট্রল করে এটিকে বলছেন ‘ভ্যাট্যাভ্যুত্থান’। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে চলমান যখন, তখন জনগণের ওপর ১২ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর বসানোর যুক্তি কী?

তিন.
আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মোটা চালের দামও বেড়েছে। এটি আমাদের ২০০৭-০৮ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়। বন্যা, সিডরের কারণে ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় সে সময়ে এক লাফে চালের দাম বেড়ে গিয়েছিল। বন্যার কারণে এবার আমনের উৎপাদন কিছুটা কম হবে, সেটা আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। আগেভাগেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে আমদানি হয়েছে অনেক কম।

গরিব মানুষের খাবার খরচের সিংহভাগ ব্যয় হয় চালের পেছনে। চালের দাম বেড়ে গেলে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েন তাঁরা। টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের লম্বা লাইনই বলে দিচ্ছিল সংকটটা কতটা প্রকট। বাজারের থেকে কম দামে চাল, তেল ও ডাল কেনার লাইনে দাঁড়িয়েও অনেককে শূন্য হাতে ফেরত যেতে হতো। কিন্তু হঠাৎই ট্রাক সেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগে ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড বাতিল করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৪৩ লাখ পরিবার সচ্ছল নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের কার্ড বাতিল করা হয়েছে?

দাম না পাওয়ায় তাঁরা সেসব সবজি গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ধাক্কা, সেটা কাটিয়ে উঠতে কত দিন লেগে যাবে কৃষকদের?

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

এক বছ‌রে আইন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার, যা বল‌লেন আসিফ নজরুল

দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর হয়ে গেল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। এ সরকা‌রের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হি‌সে‌বে দা‌য়িত্ব পালন কর‌ছেন শিক্ষা‌বিদ ড. আসিফ নজরুল। এই এক বছরে আইন মন্ত্রণাল‌য়ের সংস্কার কার্যক্রম নি‌য়ে বৃহস্প‌তিবার (৩১ জুলাই) স‌চিবাল‌য়ে সংবাদ সম্মেলন ক‌রেন তি‌নি।

এক বছর দা‌য়িত্ব পাল‌নে মন্ত্রণাল‌য়ের আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশন, হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসহ দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্প‌র্কে তু‌লে ধ‌রে আসিফ নজরুল ব‌লেন, “আইন সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হি‌সে‌বে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন: আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩, সংশোধন করে আইনটিকে ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হয়েছে। এই আইনে গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তের অধিকার সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ এবং বিচার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচারের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন আপিল, সাক্ষী নিরাপত্তা এবং ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়েছে।”

“সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫: এই অধ্যাদেশ জারি করে স্বতন্ত্র জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে মেধা, সুযোগের সমতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে,” ব‌লেও জানান তি‌নি।

আরো পড়ুন:

নির্বাচন নিয়ে আসিফ নজরুল: জাস্ট ওয়েট করুন, কিছু দিনের মধ্যে ঘোষণা

দাসত্বের সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি: শিক্ষা উপদেষ্টা

তিনি বলেন, “তাছাড়া দেওয়ানি কার্যবিধিতে সংশোধন: এই সংশোধন করে দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থায় যুগান্তকারী সংস্কার আনা হয়েছে। মৌখিক সাক্ষ্যগ্রহণের পরিবর্তে এফিডেভিটের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ, অনলাইনে সমনজারি এবং মূল মামলার অধীনেই রায় কার্যকর করার সুযোগ রাখা হয়েছে।”

ফৌজদারি আইন সংস্কার করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নিয়ে উপ‌দেষ্টা ব‌লেন, “ফৌজদারি আইন সংশোধনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা হয়েছে। সেই সাথে অভিযুক্তের অধিকারের নিশ্চয়তা, জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ পরিহার, তদন্ত প্রক্রিয়াকে জবাবদিহির আওতায় আনা, মিথ্যা মামলার হয়রারি রোধ করাসহ বিভিন্ন সংশোধনী আনা হয়েছে।”

মামলা-পূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার বিধান সংযোজন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “আইন সংশোধন করে নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের মামলার ক্ষেত্রে মামলা-পূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতার এবং প্রতি জেলায় একজন স্থলে ৩ জন বিচারককে লিগ্যাল এইড অফিসে পদায়নের বিধান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আদালতের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বাইরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিরোধের আপস নিষ্পত্তি সম্ভব হবে।”

আই‌ন সংস্কা‌রের ম‌ধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন করা হ‌য়ে‌ছে উল্লেখ ক‌রে আসিফ নজরুল ব‌লেন, “এই সংশোধনীর মাধ্যমে তদন্ত ও বিচার শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তদন্ত সম্পন্নে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া, সাক্ষীদের সুরক্ষা, শিশু ধর্ষণ মামলার জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং পুরুষ শিশু নিপীড়নকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন যুগোপযোগী বিধান যুক্ত করা হয়েছে।”

পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বিধিমালায় সংশোধনী আনা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “সংশোধিত বিধিমালার আলোকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না থাকলেও বাংলাদেশি বংশদ্ভূত ব্যক্তির পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড’ স্টিকার থাকলে বা জন্ম সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবেন।”

“সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে পূর্বের সাইবার নিরাপত্তা আইনের নিপীড়নমূলক ধারাগুলো এবং এসবের অধীনে দায়ের হওয়া মামলাগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে,” ব‌লেও জানান উপ‌দেষ্টা।

বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে উপ‌দেষ্টা ব‌লেন, “বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালা সংশোধন করে জেন্ডার বৈষম্যমূলক বিধান বাতিল করা হয়েছে। তাছাড়া, অনলাইনে বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন করার বিধান সংযোজন করা হয়েছে।”

আসিফ নজরুল জানান, আইন মন্ত্রণাল‌য়ের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশনের ম‌ধ্যে জুডিসিয়াল সার্ভিসের স্বাধীনতা, বি‌শেষ ক‌রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের পদসৃজনের ক্ষমতা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করে ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫’ এবং জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের সরকারের আইন ও বিচার বিভাগে পদায়নের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “বিচারপ্রার্থী জনগণের তথ্যের অধিকার নিশ্চিতকরণে দেশের সব আদালত প্রাঙ্গণে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মামলার সর্বশেষ অবস্থা, শুনানির তারিখ এবং আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানি কমেছে।”

কেন্দ্রীয়ভাবে আদালতের কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে উপ‌দেষ্টা ব‌লেন, “একটি স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদালতে দক্ষ কর্মচারী নিয়োগের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ কার্যক্রম চালু করার জন্য নীতিমালা প্রস্তুত হয়েছে।”

“তাছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমের জন‌্য অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ এবং সংগৃহীত হিসাবের নথিসমূহ পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সাব রেজিস্ট্রারদের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য বিবরণী তৈরি করা হয়েছে,” ব‌লেও জানান তি‌নি।

আসিফ নজরুল ব‌লেন, “জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের প্রসিকিউশন কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে একটি বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। বিচার কার্যক্রম দ্রুততর করার লক্ষ্যে ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য সরকারি চাকরিজীবীদের অনলাইনে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের পত্রের আলোকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট Practice Directions জারি করেছে।বিদ্যমান আদালত ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুইটি পারিবারিক আদালতকে ই-ফ্যমেলি কোর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।”

আইন মন্ত্রণালয়ে ডিজিটালাইজেশন করা হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন, “আইন ও বিচার বিভাগের ৫০% নথি ডি-নথির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। এ মন্ত্রণালয়ের Attestation সেবাকে শতভাগ অনলাইন প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করা হয়েছে। তাছাড়া বিচারপ্রার্থী জনগণের জামিনপ্রাপ্তি সহজীকরণের লক্ষ্যে অনলাইনে বেইলবন্ড জমা দেওয়ার নিমিত্ত প্রথমবারের মতো সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হয়েছে। শিঘ্রই পরীক্ষামূলকভাবে সফটওয়্যারটি ব্যবহার শুরু হবে।”

হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার আইন মন্ত্রণাল‌য়ের এই এক বছ‌রের বড় কাজ উল্লেখ ক‌রে আসিফ নজরুল ব‌লেন, “রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বিষয়ে জেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটি এবং আইন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক এজাহার, চার্জশিটসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনার পর ১৫,০০০টিরও বেশি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। সূচারুভাবে সব ভুক্তভোগীকে এই সুযোগ চলমান রাখার লক্ষে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।”

“এছাড়া সাইবার আইনের অধীনে ৪০৮টি স্পিচ অফেন্স সংক্রান্ত মামলা, এবং জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দায়ের করা ৭৫২টি হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহারের কারণে কয়েক লাখ রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও স্বাধীন মতের মানুষ হয়রানি থেকে রেহাই পেয়েছে।”

তি‌নি ব‌লেন, “বর্তমান সরকারের কার্যকালে আইন মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমে লক্ষণীয় গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন: গত এক বছরে মন্ত্রীপর্যায়ে নিষ্পত্তিকৃত নথির সংখ্যা ১২৮৩টি, বিগত সরকারের  একই সময়ে ৮৩৪ টি নথি নিষ্পত্তি হয়েছিল। গত এক বছরে আইন মন্ত্রণালয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ অন্যান্য দপ্তরে ৩৯১টি বিষয়ে আইনি মতামত প্রদান করেছে (গত সরকারের আমলে ১৮০টি)। এ সময়ে সনদ, এফিডেভিট, দলিলসহ ৩৬ ধরনের মোট ১,৫৯,৫৪৪টি ডকুমেন্ট সত্যায়ন হয়েছে যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে রেকর্ড ১২টি অংশীজন মতবিনিময় সভা আয়োজন করেছে।”

“নতুন দায়িত্ব হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন, গুম সংক্রান্ত অপরাধ তদন্ত কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো বিধিমালা ও প্রবিধানগুলোকে কোডিফাই করার কাজ শুরু হয়েছে।”

“এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ফ্যসিষ্ট আমলে নিয়োগকৃত সব আইন কর্মকর্তা পালিয়ে যাওয়ার কারণে গত এক বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যাক আইন কর্মকর্তাকে নিয়োগ করতে হয়েছে।”

তিনি বলেন, “সারা দেশের বিভিন্ন আদালত ও ট্রাইব্যুনালে ৪৮৮৯ জন সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ২৭৪ জন অ্যাটর্নিকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে ৫ জন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগে সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে,” ব‌লেও জানান তি‌নি।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ