শীতে ঢাকায় গ্যাস-সংকট সীমা ছাড়িয়েছে। অনেক এলাকায় ভোর হতে না হতেই গ্যাস চলে যাচ্ছে, আসছে রাতে। ফলে মধ্যরাতে চুলা জ্বলছে, রান্নাবান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। মাসের শুরুতে তিন দিন একবারের জন্যও গ্যাস আসেনি।

দুই বছর আগে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম—‘গ্যাসের চুলা না জ্বালালেও কেন মাস শেষে বিল’। সেই চিত্রের বদল হয়নি। ফলে মাস শেষে গ্যাসের বিল যেমন দিতে হচ্ছে, আবার ইনডাকশন চুলা, রাইস কুকারে রান্নার কারণে বাড়তি বিদ্যুৎ বিল দিতে হচ্ছে কিংবা সিলিন্ডার কেনার কারণে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।

এই যে বাড়তি খরচের বোঝা, এর কোনো দায় সাধারণ মানুষের নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া শেখ হাসিনা সরকারসহ পূর্ববর্তী সরকারগুলোর ভুল জ্বালানি নীতির ফলাফল এটা।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে অলিগার্কদের শাসনে যে স্বজনতোষী অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, সেখানে লুটপাটের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে, এর অন্যতম উৎস ছিল এ খাত। ফলে লোকসানের বিরাট বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নাগরিকদের ঘাড়ে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ আর জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস আর জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার নামে যে দাম বাড়ানো হয়েছে, সেটাই হয়নি। এটা ছিল প্রতারণা করে, ছল করে নাগরিকের পকেট থেকে টাকা বের করে নেওয়ার ফন্দি।

ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ-আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে যে অলিগার্কি কাঠামো ছিল, তারা রাজস্ব বাড়ানোর খুব সহজ সমাধান হিসেবে কর, ভ্যাট, শুল্ক ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছিল। ফলে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রই গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার এমন এক যন্ত্র হয়ে উঠেছিল, যাদের ভাবনায় জনগণ হলো হাতেম তাই কিংবা গৌরী সেন।

কোভিড মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের বয়ানটাকে নগ্ন করে দিয়েছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দেশের সিংহভাগ মানুষ কীভাবে কায়দা করে টিকে আছে, সেটা সত্যিই অর্থনীতিবিদদের একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। আজ ওষুধের খরচ, কাল ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, পরশু পাত থেকে ডিমের খরচ, দুধের খরচ ছেঁটে ফেলে মানুষ প্রতিনিয়ত তার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ছুটন্ত ঘোড়াটার সঙ্গে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু সবারই সহ্যের একটা সীমা থাকে।

জীবনযাপনের এই সর্বব্যাপী সংকট থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই-আগস্টে সর্বস্তরের মানুষ ছাত্রদের ডাকে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। রক্ত আর অসাধারণ আত্মত্যাগে তাঁরা রচনা করেন অনন্য এক ইতিহাস। কিন্তু জনগণের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সমাধানবৃত্ত থেকে কতটা বের হওয়া গেল?

এটা অস্বীকারের জো নেই, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ভেঙে পড়েছিল, অর্থনীতি যেভাবে খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে দেশকে ঠিক রাস্তায় তোলাটা বিশাল এক কঠিন কাজ। পাঁচ মাসে সেটা প্রত্যাশা করাও বোকামি। কিন্তু এটাও বাস্তবতা যে মানুষ আর পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরতে চান না। তাঁরা চান না, সরকার ব্যয়ের ভারটা তাদের ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া কাঁধে চাপিয়ে দিক। পুরোনো ব্যবস্থার সঙ্গে তাঁরা সুস্পষ্ট একটা ছেদবিন্দু দেখতে চান।

প্রশ্ন জাগছে, সরকার কেন একদিকে শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি মানুষের পকেট থেকে বের করতে চাইছে, অন্যদিকে মহার্ঘ ভাতায় সাত হাজার কোটি ব্যয় করার কথা চিন্তা করছে। অর্থনীতিবিদ ড.

জাহিদ হোসেন প্রশ্ন করেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা কি আছে?

কিন্তু বাস্তবতা ঠিক উল্টোটাই তাঁদের সামনে নিয়ে আসছে। সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম একধাপে ঘনফুটপ্রতি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে ধুঁকতে থাকা শিল্প খাতে বড় একটা ধাক্কা লাগবে। এমনিতেই সরকার পতনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে শিল্প খাত ও এর শ্রমিকেরা। অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। দেশে হঠাৎ অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই কাজ হারানোর বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে কি? গ্যাসের দাম বাড়লে পাটিগণিতের ঐকিক নিয়মের সূত্রেই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

নতুন বছর মানেই বাংলাদেশের মানুষের সামনে নতুন নতুন ব্যয়ের বোঝা যুক্ত হওয়া। রংপুর থেকে আমার এক বন্ধু তাঁর সন্তানের স্কুলে ভর্তির ফি জোগাড়ের জন্য ফোন দিয়েছেন। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ২০ হাজার টাকা ফি দিতে হবে। মানে যাঁদের ছেলেমেয়ে বেসরকারি স্কুল-কলেজে পড়ে, তাঁদের অনেকের জন্য বছরের শুরুটা হয় এ রকম রূঢ় বাস্তবতা দিয়ে। প্রাইভেট স্কুলগুলো নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে, প্রতিবছর ভর্তি ফি দিতে হবে। এই যে এক দেশে সাত-আটটা শিক্ষাব্যবস্থা, এর চেয়ে বড় বৈষম্য আর কী হতে পারে!

নতুন বছর মানে, যাঁরা ভাড়া বাসায় থাকেন, তাঁদের বাসাভাড়া বাড়া। যাঁরা বাড়তি খরচের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেন না, তাঁদের চলে যেতে হয় শহরের আরেক প্রান্তে, কম ভাড়ার বাসায়। ওই যে ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক সিনেমার শেষ দৃশ্যটা এই শহরের একটা রূঢ় বাস্তবতা।

দুই.
নতুন বছরে ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব—সবার খরচ বাড়ছে। এখানে সরকারের নীতিটা সাম্যবাদী। কারণ, সরকার ১০০-এর বেশি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়েছে। ভ্যাট হলো পরোক্ষ কর। পোশাক কিনতে, ওষুধ কিনতে, বেড়াতে গেলে খরচ বাড়বে। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খরচ বাড়বে। বিদেশি ফল খেতে গেলে খরচ বাড়বে।

মুঠোফোনে কথা বলতে গেলে খরচ বাড়বে। খরচ বাড়বে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গেলে। অর্থ উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, এই বর্ধিত ভ্যাটে মূল্যস্ফীতি হবে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ছোট, মাঝারি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। ব্যয়ের মানুষ ভোগ কমিয়ে দিলে তাতে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির বারোটা বাজবে।

প্রথম আলোর খবর বলছে, রাজস্ব আদায় কম, আইএমএফ চাপ দিচ্ছে, বিদেশি ঋণ আসছে না। তাই বাজেটঘাটতি মেটাতে শুল্ক-কর ও ভ্যাট বাড়ানোর সহজ রাস্তা নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে মানুষের পকেট থেকে সরকারের কাছে যাবে ১২ হাজার কোটি টাকা। এ রকম সিদ্ধান্তে মানুষ যে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই আঁচ করা যায়। বিএনপি, নাগরিক কমিটিসহ সব ধারার রাজনৈতিক দল সরকারকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ট্রল করে এটিকে বলছেন ‘ভ্যাট্যাভ্যুত্থান’। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে চলমান যখন, তখন জনগণের ওপর ১২ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর বসানোর যুক্তি কী?

তিন.
আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, মোটা চালের দামও বেড়েছে। এটি আমাদের ২০০৭-০৮ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়। বন্যা, সিডরের কারণে ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় সে সময়ে এক লাফে চালের দাম বেড়ে গিয়েছিল। বন্যার কারণে এবার আমনের উৎপাদন কিছুটা কম হবে, সেটা আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। আগেভাগেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবে আমদানি হয়েছে অনেক কম।

গরিব মানুষের খাবার খরচের সিংহভাগ ব্যয় হয় চালের পেছনে। চালের দাম বেড়ে গেলে সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েন তাঁরা। টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের লম্বা লাইনই বলে দিচ্ছিল সংকটটা কতটা প্রকট। বাজারের থেকে কম দামে চাল, তেল ও ডাল কেনার লাইনে দাঁড়িয়েও অনেককে শূন্য হাতে ফেরত যেতে হতো। কিন্তু হঠাৎই ট্রাক সেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিপণ্য বিক্রিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগে ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড বাতিল করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৪৩ লাখ পরিবার সচ্ছল নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের কার্ড বাতিল করা হয়েছে?

দাম না পাওয়ায় তাঁরা সেসব সবজি গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ধাক্কা, সেটা কাটিয়ে উঠতে কত দিন লেগে যাবে কৃষকদের?

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

আমার জন্মঋতু

আমি বন্ধনহীন মৌসুমী বায়ু—, ভ্রমি দেশে দেশে দেশে

শেষে পৌঁছেছি এনে আমার প্রিয় বাংলাদেশে।

তোমার স্পর্শ পেয়ে পেয়ে আমাকে ঝরতে হবে জানি।

তোমার প্রতিটি নদী-নালা, পথ-ঘাট, পুকুর-প্রান্তর,

খাল-বিল, গুহা-গিরি আমাকে করতে হবে জানি।

শরৎ আসার পরে আমাকে মরতে হবে জানি।

(বর্ষার মতো প্রেমিক)

প্রতিটি বর্ষায় আমি কিছু না কিছু কবিতা লিখি। আমাদের পত্রিকাগুলো বর্ষার ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ওই সব পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে বর্ষার ওপর রচিত নতুন কবিতা চান। আমি পারতপক্ষে তাদের নিরাশ করি না। বিষয়ভিত্তিক কবিতা রচনায় আমার মন আজকাল আগের মতো সাড়া দেয় না। তবে বর্ষার কথা ভিন্ন। বর্ষার আগমনে আমার কবিচিত্ত মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা ব্যাঙের মতোই মহানন্দে আত্মপ্রকাশ করে তার প্রিয় সঙ্গমসঙ্গিনীকে খুঁজে বেড়ায়। ফলে প্রতিটি বর্ষায়, তা কোনো পত্রিকা আমার কাছে বর্ষার ওপর কবিতা চান বা না চান, আমি লিখি।

না লিখে পারি না আমার কবিতার সতর্ক পাঠক যদি থেকে থাকেন, তো মানলেন যে, আমার কবিতায় যে ঋতুটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে, বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে, তার নাম বর্ষা। আমার আরেক প্রিয় ঋতু হলো বসন্ত। বাংলার অন্য সকল কবির মতোই বসন্তেও আমি কম উন্মাদ হই না। তবে বর্ষার তুলনায় কম। এর কারণ, নিশ্চিত জানি আমার জন্মের মধ্যে নিহিত। বর্ষা আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ঋতু। আষাঢ় মাসের সপ্তম দিনের এক বৃষ্টিঝরা সকালে আমার জন্য হয়েছিল। এ শুধুই আমার শোনা কথা নয়, আমার স্মৃতিকথাও। আমি কান পাতলেই আমার জন্মগ্রামের আকাশ কালো করে নামা সেই আষাঢ়ীবর্ষণের মার্গসংগীতধ্বনি এখনো স্পষ্ট শুনতে পাই।

বর্ষার ওপর রচিত আমার কবিতাসমূহের একটি পৃথক কাব্যসংকলন আমি প্রকাশ করেছি। বসন্তের ওপরও একটি কাব্যসংকলন আছে। তবে বর্ষার ওপর লেখা আমার কবিতার সংখ্যা যেমন বেশি, মান বিচারেও তারা অধিক গুণী। যে কবিতাটি ওপরে উদ্ধৃত করেছি, কোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতার চাহিদা পূরণের জন্য নয়, বর্ষাসিক্ত কবিচিত্তের অন্তর্গত চাহিদা মেটাতেই সেটি সম্প্রতি রচিত হয়েছে। কবিতাটিতে বাংলাদেশকে কল্পনা করা হয়েছে গ্রীষ্মতপ্ত প্রেয়সীরূপে, কবি যেন বিরহী যক্ষ। মৌসুমি বায়ুরূপে বিশ্বভ্রমণ শেষে সে ফিরে এসেছে তার প্রেয়সীর দেহসীমায়। যক্ষপ্রিয়ার দেহের সকল তৃষিত অঞ্চলে সে ঢালবে তার সঙ্গে করে নিয়ে আসা মেঘজলধারা। আকাশ কাঁপিয়ে, শুকনো মাটি ভিজিয়ে নামবে বৃষ্টি। অবিচ্ছিন্ন লয়ে বাংলার তপ্তশুষ্ক মাটি আর মেঘভারেনত আকাশকে সে বেঁধে দেবে অন্তহীন অঝোর বর্ষণে।

এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, যা হয়েছিল নূহের প্লাবনের সময়; এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, মানবমনের ভেতরের সুপ্ত কাম ও বিরহবোধকে যে জাগ্রত করে, ববীন্দ্রনাথের মতো নমিতকামের কবিও তখন বিশ্বাস করেন—এমন দিনেই তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়, এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, পবিত্র বেদে যাকে কল্পনা করা হয়েছে মহান মৃত্যুর সঙ্গে। এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, কবি শহীদ কাদরী যাকে তুলনা করেছেন সন্ত্রাসের সঙ্গে।

আমার জীবনের প্রথম ষোল বছর প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার জন্মগ্রামে কাটিয়েছি। শহরে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের জন্মকে সামান্যতম খাটো না করেও বলি, গ্রামে জন্মগ্রহণ করার জন্য আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, তাকে যে আমি খুব কাছের করে চিনেছি, আপন বলে জেনেছি, সেটা সম্ভব হয়েছে অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার শৈশব-কৈশোর গ্রামের বন-জঙ্গলে কাটাতে পেরেছি বলেই। বাংলার ষড়ঋতুর রূপবৈচিত্র্যকে আমি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার যে সুযোগ পেয়েছি, তাকে আমি যে আমার কবিতায় সেভাবে ধরতে পারিনি, তার জন্য দায়ী আমার প্রয়োজনীয় কারাশক্তির অভাব। সে কারণে আমার আত্মগ্লানি আছে বটে, কিন্তু তার নিবিড় সান্নিধ্যলাভের স্মৃতি আমার চির গৌরবের ধন। প্রকৃতিকে আমি কখনো পেয়েছি প্রেয়সীরূপে, কখনো দেখেছি জননীরূপে। আমি বুঝেছি, তার সঙ্গে আমার অস্তিত্ব এক অন্তহীন লীলায় জড়ানো। ফলে বলা যায় একেবারে খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বর্ষার আগমন, অবতরণ ও তার প্রত্যাগমনকে দেহেমনে মিলিয়ে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। গুনেছি আকাশে আকাশে মেয়ের গুরুগুরু ডাক। বুঝেছি, গ্রীষ্ম-অবসানে আসছে আমার। জন্মসহোদর, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষা। আসছে আষাঢ়। আমার বেসুরো কণ্ঠেও লতিয়ে উঠেছে গান— 'আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।' আহ, কী চমৎকার।

বর্ষা আমাকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার সঙ্গে করে। দু কূল প্লাবিত করা নদীর আনন্দে, মাঠে-ঘাটে, ঝালে-বিলে, পুকুরে প্রান্তরে আমি বর্ষাকে তার জলজগৎ বিস্তার করতে দেখেছি। সে আমার কানে কানে বলেছে, আমি কীভাবে আমার দেশপ্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গম করি দেখো। আমি দেখেছি। প্রাণ ভরে

দেখেছি বর্ষার রূপ।

আমি যখন এই বর্ষাবন্দনা লিখছি, তখন আষাঢ় গত হয়েছে। চলছে শ্রাবণ। শ্রাবণের পুরোটাই সামনে পড়ে আছে। বলা যায় এখন বর্ষার ভরা যৌবন। ঢাকায় বসে তার রূপ দেখছি টিভির পর্দা আর পত্রিকার পাতায়। তার প্রকৃত চেহারাটা দেখতে পাচ্ছিনে এখানে। এই নিয়ে কবিতাও লিখেছি। গ্রামে ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, বর্ষা, কতটা জাঁকিয়ে বসেছে সেখানে। সে জানিয়েছে, যদি বর্ষা বিষয়ে নতুন করে কিছু লিখতেই চাও তো গ্রামে চলে এসো। বর্ষা দেখে যাও। আজ তিন দিন হলো দিন-রাত বৃষ্টি। নদী-নালা, মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ডুবিয়ে সে মেলে ধরেছে তার চোখজুড়ানো রূপ। আমি চোখ বন্ধ করে, কল্পনায় তার রূপ দেখলাম। মনে পড়ল, কত অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী।

বাংলার কবির কাছে, কবির চোখে বর্ষার কি আলাদা কোনো রূপ আছে? এর উত্তর সহজ নয়। জীবনানন্দ বলেছেন—সকলেই পবি নয়, কেউ কেউ করি। তার এই স্মরণীয় উক্তিটি ছোট কবিদের ভিড় থেকে বড় কবিদের পৃথক করার প্রয়োজন মেটায়। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে সব মানুষই যে কমবেশি করি, আমার এই উপলব্ধিকে বাতিল করে না। বাংলার লোককবিদের রচিত কাব্যে, গানে তারই পরিচয় দেখতে পাই। অন্য কবিদের জন্মকথা বলতে পারিনে, তবে আমার কবিজন্ম যে বর্ষামায়ের গর্ভে, সে কথা না বললে নিশ্চিত জানি, স্বর্ণে বসে চিত্রগুপ্ত অকৃতজ্ঞের তালিকায় আমার নামটিও লিপিবদ্ধ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ