সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে সমকাল মানবাধিকারকর্মী ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির এর সঙ্গে কথা বলেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।

সমকাল: নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন কেমন হলো?

খুশী কবির: নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তারা বিভিন্ন অংশীজনের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অনেক বছর ধরে আমরা নারীদের আন্দোলন দেখছি। বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘদিনের যে দাবি, তার প্রতিফলন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি। সরকার অন্য যেসব কমিশন গঠন করেছিল, সেখানে নারীর প্রতিনিধিত্ব খুবই কম ছিল। এ কারণে সেসব কমিশনে নারীদের পক্ষে প্রত্যাশিত সুপারিশ আসেনি।

সমকাল: কিন্তু নারীবিষয়ক কমিশনের সবাই নারী।

খুশী কবির: হ্যাঁ, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে নারীরা কাজ করেছেন। তারা নির্ভয়ে সুপারিশমালা জমা দিয়েছেন। সে জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে যে ধরনের সুপারিশ করা উচিত, তারা সেভাবেই করেছেন। তারা অন্যান্য দেশের বিষয়াদিও পর্যালোচনা করেছেন। আমরা দেখছি, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলা আছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বলেছে, ‘যেহেতু রাষ্ট্র একটি ইহজাগতিক সত্তা, সেহেতু কোনো ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করে সংবিধান শুরু হওয়া উচিত নয়। তা ছাড়া এটি প্রাধান্যপ্রাপ্ত ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই অনুচ্ছেদটি বাতিল করা প্রয়োজন।’

সমকাল: এর পেছনে যুক্তি কী?

খুশী কবির: রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব নাগরিককে সমানভাবে সুযোগ দেওয়া। সব নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার অধিকার নিশ্চত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমার মনে হয়, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন এই আঙ্গিকেই সুপারিশ করেছে। 

সমকাল: অন্য সুপারিশমালা কেমন দেখেছেন?

খুশী কবির: নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন অনেক বিষয়ে সুপারিশ করেছে। একেবারে সব এসেছে, তাও নয়। তবে সমাজে যেসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে, সেসব বিষয় তারা প্রস্তাব করেছে। গভীর ও ব্যাপকভাবে তারা সুপারিশগুলো আনার চেষ্টা করেছে। এসব প্রস্তাব নিশ্চয় সবার সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত করা হবে। সেটা অবশ্য এখন সরকারের দায়িত্ব।  

সমকাল: আমরা দেখছি, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের এ প্রতিবেদনের অনেক সুপারিশে বিরোধিতা করেছেন অনেকে। বিশেষ করে ধর্মীয় দলগুলোর বিরোধিতা স্পষ্ট।

খুশী কবির: যে কোনো সুপারিশ বা প্রস্তাবের বিরোধিতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এটা সত্য, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান। তার অর্থ এই নয়– অন্য নাগরিকদের আমরা উপেক্ষা করব। তারপরও সবাই যে এর বিপক্ষে কথা বলেছে, তা নয়। আমরা দু-তিনটি গ্রুপের বিরোধিতা দেখেছি। এক গ্রুপ এই কমিশনের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে পুরোপুরি বাতিল করার কথা বলেছে। আরেক গ্রুপ বলেছে, এই কমিশনের প্রতিবেদনে কিছু ভালো দিক আছে, আর কিছু দিক সংশোধন করতে হবে। সরকার এই কমিশন গঠন করেছে। সরকারই তাদের দায়িত্ব দিয়েছে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে যারা আছেন, তাদের সবাই চেনে। সরকার যেমন চেনে, তেমনি যারা বিরোধিতা করছেন তারাও চেনেন। এ কমিশন গঠনের সময় তো তারা বিরোধিতা করেননি। কেন তাদের নেওয়া 
হচ্ছে– সে ধরনের কিছু তখন বলেননি। এটি একটা বিষয়। 

সমকাল: আর কোন বিষয়ের কথা বলছেন?

খুশী কবির: আরেকটি বিষয়। একটি গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে তারটাই প্রাধান্য পাবে, অন্যদের উপেক্ষা করতে হবে– সেটা তো হতে পারে না। 

সমকাল: যৌনকর্মীদের স্বীকৃতির বিষয়ে বিরোধিতা নিশ্চয়ই আপনি দেখছেন।

খুশী কবির: আমার মত, যারা যৌনকর্মীদের কাছে যায়, তাদের তো হয়রানি করা হয় না। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। এর চাহিদা আছে বলেই যৌনবৃত্তি টিকে আছে। শুধু যারা সাপ্লাই করছে, তাদেরকেই কেন ক্রিমিনালাইজ করা? এই দ্বিচারিতা কেন? এখানে সবারই তো সমান মর্যাদা পাওয়ার কথা। 

খুশী কবির: অভিন্ন পারবারিক আইনের সুপারিশ করেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? 

সমকাল: এ বিষয়ে আমরা আশির দশক থেকেই কাজ করে আসছি। আমরা প্রতিবছর এর সপক্ষে দাবি তুলে আসছি। আমরা এ ব্যাপারে অনেক দূর অগ্রসরও হয়েছিলাম। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন স্পষ্টভাবেই লিখেছে– তারা মনে করে, বিদ্যমান কিংবা ধর্মীয় পারবারিক ব্যবস্থাও থাকবে। কিন্তু যারা মনে করে, সেখানে তারা বঞ্চিত হচ্ছে, তারা চাইলে অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহণ করতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ব্যবস্থা থাকা উচিত। আদিবাসী নারীদের দুর্দশা আমরা দেখেছি।

সমকাল: আদিবাসী নারীদের দুর্দশা নিয়ে কিছু বলবেন?

খুশী কবির: অনেক আদিবাসী নারী আছেন, যারা মনে করেন, তাদের আইনে বঞ্চিত হচ্ছেন। সুতরাং তাদের কেউ চাইলে অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহণ করতে পারেন। আবার তাদের নিজস্ব আদিবাসী আইনও থাকল; কেউ চাইলে সেটাই অনুসরণ করবেন। পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের একচ্ছত্র অধিকার নেই। ভারতের হিন্দু নারীর অধিকার আছে। বাংলাদেশে তারা তেমন অধিকার পান না। এখন কোনো হিন্দু নারী যদি মনে করেন, তাঁর নিজ ধর্মের পারিবারিক আইন মানবেন; আবার কেউ চাইলে অভিন্ন পারিবারিক আইনও মানতে পারেন। এ উপায়গুলো থাকা দরকার, যাতে তিনি অধিকার পেতে পারেন। এটি শুধু উত্তরাধিকার সম্পত্তির বিষয় নয়। বরং এটি হলো সবাইকে সমানভাবে দেখার বিষয়। আমাদের অন্যান্য আইন কি শরিয়াহ আইন দ্বারা পরিচালিত? যেমন ফৌজদারি আইন, সিভিল ল কি শরিয়াহ আইন মেনে চলে? তাহলে পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রেও অভিন্ন আইন থাকতে পারে। যার ইচ্ছা সে গ্রহণ করবে।

সমকাল: সংসদে ৬০০ আসন করে সেখানে ৩০০ আসনে নারীদের সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়েছে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

খুশী কবির: পুরো ৩০০ আসনই হতে হবে– এমন নয়। তবে আমি এ ব্যাপারে একমত, নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতেই হবে। নারীদের দয়াদাক্ষিণ্যের মাধ্যমে আসতে হবে, তা নয়। বরং তারাও যেন সরাসরি ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সে সুযোগ দিতে হবে। নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো এবং সরাসরি নির্বাচনে নারীকে এগিয়ে রাখা দরকার। এখন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার মনে হয়, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের মূল বার্তা এটাই– নারীদের প্রতিনিধিত্ব যেন বাড়ে। সে ব্যাপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প র ব র ক আইন স প র শ কর প রস ত ব কর ছ ন সরক র সমক ল গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

নোবিপ্রবির আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা স্থায়ী বহিষ্কার 

আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী পরিচালক জিয়াউর রহমান ভূঁইয়াকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অশ্লীল ও শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্য করায় স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আরো পড়ুন:

জুলাই বিরোধিতা: ইবির ৩০ শিক্ষক-কর্মচারী ও ৩৩ ছাত্রলীগ নেতার ‘শাস্তি’

আ.লীগে যোগ দেওয়া মুবিনকে আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার 

সোমবার (৩ নভেম্বর) নোবিপ্রবির রেজিষ্টার (ভারপ্রাপ্ত) মো. তামজীদ হোসাইন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক নোটিশে এ বিষয়ে জানানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের  রিজেন্ট বোর্ডের ৬৭তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।  

নোটিশে বলা হয়েছে, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী পরিচালক জিয়াউর রহমান ভূঁইয়া অননুমোদিতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত বিদেশে গমন করেন, যা সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল ) বিধিমালা ২০১৮ এর ধারা ২(চ) অনুযায়ী ‘পলায়ন’ ।

এছাড়া একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশ করায় ‘নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ,২০০১’ এর ধারা ৪৭(৫) এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। 

নোটিশে আরো বলা হয়েছে, গত ২৮ মে  আপনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হলে সেটির জবাব যথাযথ হয়নি। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি আপনাকে পুনরায় ৭ জুলাই বিজ্ঞ আইনজীবীর মতামত এবং ৩১ জুলাই প্রেরিত নোটিশের জবাব না দেয়ায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর নোবিপ্রবি রিজেন্ট বোর্ডের ৬৭ তম সভার আলোচ্যসূচি-১৮ এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০১ এর ৪৭(৮) ধারা অনুযায়ী এবং সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল ) বিধিমালা ২০১৮ এর বিধি ৩ (খ) ও (গ) অনুযায়ী নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর সহকারী পরিচালক (সামরিক বরখাস্ত) পদ থেকে চূড়ান্ত বা স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কোনো লেনদেন থাকলে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও বিধি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে জিয়াউর রহমান ভূঁইয়া আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী রাজনীতির বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে থাকেন এই কর্মকর্তা।

ঢাকা/শফিউল্লাহ/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ