ব্যবসা শুধু লাভের খেলা নয়, এটি সততা ও বিশ্বাসের একটি পবিত্র দায়িত্ব। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনে দেখিয়েছেন কীভাবে সততার সুন্নাহ ব্যবসায়কে শুধু সফলই নয়, আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ করে দেয়।

তিনি বলেছেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১২০৯)। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কীভাবে ব্যবসায় সাফল্য ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি, তা-ই আজ আলোচ্য।

 শৈশব থেকে সততার শিক্ষা

মহানবী (সা.

)-এর জীবন ছিল কষ্টে গড়া। জন্মের আগেই পিতৃহীন, ছয় বছর বয়সে মাতৃহীন। দাদার মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিবের কাছে আশ্রয় নেন। কৈশোর পার করতেই তিনি ব্যবসায় নামেন। তাঁর সততা ও বিশ্বস্ততা তাঁকে মক্কার মানুষের কাছে ‘আল-আমিন’ (বিশ্বস্ত) উপাধি এনে দেয়।

সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১২০৯

মানুষ তাঁর কাছে মূল্যবান সম্পদ জমা রাখত, এমনকি যারা তাঁর বিরোধিতা করত, তারাও। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন যে তোমরা আমানত তাদের হাতে ফিরিয়ে দাও, যাদের তা দেওয়ার অধিকার’ (সুরা নিসা: ৫৮)। নবীজি (সা.) এই নির্দেশের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিশ্বস্ততা মক্কা থেকে মদিনা

মক্কার কাফিররা যখন নবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, তখনো তাঁর কাছে তাদের আমানত জমা ছিল। মদিনায় হিজরতের আগে তিনি আলী (রা.)-কে নির্দেশ দেন, ‘এই সমস্ত আমানত তাদের মালিকদের ফিরিয়ে দাও’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃ. ২২৫)। এমনকি যারা তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল, তাদের সম্পদও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এই সততা শুধু তাঁর চরিত্রের গভীরতাই নয়, ব্যবসায়ের জন্যও একটি শাশ্বত শিক্ষা।

আরও পড়ুনকঠিন সময়ে মহানবী (সা.)-এর জয়ের কৌশল১১ মে ২০২৫

ব্যবসায় ‘ইহসান’

নবীজি (সা.) ব্যবসায় ইহসানের নীতি পালন করতেন। ইহসান হলো, ‘তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ, আর যদি না দেখতে পাও, তিনি তোমাকে দেখছেন’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮)।

তিনি কখনো লেনদেনে প্রতারণা করেননি। আল-আদ্দা ইবনে খালিদ (রা.)-এর সঙ্গে একটি লেনদেনে তিনি লিখে দিয়েছিলেন, ‘এটি মুহাম্মদ, আল্লাহর রাসুল এবং আল-আদ্দা ইবনে খালিদের মধ্যে একটি বিক্রয়, যাতে কোনো গোপন ত্রুটি, দুর্নীতি বা অপরাধ নেই’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,১১৭)।

ইতিহাসবিদ অ্যান্টনি রিড লিখেছেন, ‘১৫০০ সালের দিকে সুমাত্রা, জাভা এবং মালয়েশিয়ার বন্দরগুলোয় মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রভাব ছিল। তারা শুধু বাণিজ্যই করেনি, ইসলামের শিক্ষাও ছড়িয়েছে।’

ব্যবসায়ীরা ইসলামের দূত

ইসলামের প্রাথমিক যুগে ব্যবসায়ীরা ছিলেন ধর্মপ্রচারক। পশ্চিম আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম ছড়িয়েছে মুসলিম ব্যবসায়ীদের সততা ও নৈতিকতার মাধ্যমে।

ইতিহাসবিদ অ্যান্টনি রিড লিখেছেন, ‘১৫০০ সালের দিকে সুমাত্রা, জাভা এবং মালয়েশিয়ার বন্দরগুলোয় মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রভাব ছিল। তারা শুধু বাণিজ্যই করেনি, ইসলামের শিক্ষাও ছড়িয়েছে’ (অ্যান্টনি রিড, ইসলাম ফ্রম দ্য বিগিনিং টু ১৩০০, ২০০২)। তাদের সততা মানুষের হৃদয় জয় করেছিল, যা ইসলামের শান্তিপূর্ণ প্রসারে সহায়ক হয়।

আজকের ব্যবসায়ীদের জন্য

আধুনিক ব্যবসার দৌড়ে সততা প্রায়ই হারিয়ে যায়। কিন্তু নবীজি (সা.)-এর সুন্নাহ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সততা শুধু দুনিয়ার সাফল্য নয়, আখিরাতের পুরস্কারও নিয়ে আসে।

একটি সৎ লেনদেন, একটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা বা একটি আমানত ফিরিয়ে দেওয়া—এই ছোট কাজগুলো ব্যবসায় আপনাকে আল-আমিনের মতো করে তুলবে। আপনার গ্রাহকের হৃদয় জয় করুন, তাদের বিশ্বাস অর্জন করুন। এটিই সত্যিকারের সাফল্য।

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা পরিমাপে ও ওজনে কম দেবে না’ (সুরা আর-রাহমান: ৯)। এই নীতি ব্যবসায়ীর জন্য একটি পথনির্দেশ।

 (ডিসকভারিং ইসলাম আর্কাইভ থেকে)

আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন০৯ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব শ বস ত ম ব যবস ব যবস য ইসল ম র আল ল হ

এছাড়াও পড়ুন:

কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 

বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না।  মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন  করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও  এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?

ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো।  বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে। 

আরো পড়ুন:

রাশিয়ার ‍বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ

রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা 

রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে। 
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত। 

জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। 

বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই। 

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।  

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের কাজ কি শুধু ভাইভা নেওয়া
  • কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-গ্রামবাসীতে বিদ্বেষ কেন
  • চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি দাঙ্গা–ফ্যাসাদকেই নীতি হিসেবে নিয়েছেন