‘ওরা আমাদের কবরের ওপর বুট পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে’, শ্রীলঙ্কার ভিসুভামাডুতে একটি পুরোনো কবরস্থানের জায়গায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তামিল নারী কাবিতা। তাঁর সঙ্গে যখন আমি কথা বলছিলাম, তখন বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ছিল। সেই ঝাপটা তাঁর চোখের পানি ধুয়ে দিচ্ছিল।

শ্রীলঙ্কার তামিলদের মুক্তি চেয়ে লড়াই করা সশস্ত্র গোষ্ঠী লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম বা এলটিটিইর নিহত যোদ্ধাদের এই কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল। সেখানে কাবিতার ভাইয়েরও কবর আছে। কিন্তু রাজাপক্ষে সরকার সে কবরগুলোর ওপর সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছে। সরকারের এই কাজে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন কাবিতা।

এলটিটিই শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে প্রভাবশালী ছিল। তারা প্রায় তিন দশক ধরে একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিল। তবে ২০০৯ সালে তারা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং শ্রীলঙ্কার সে সময়কার সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধের সময় সরকার এই কবরস্থানের মতো এলটিটিই নিয়ন্ত্রিত অনেক স্থাপনাকে ধ্বংস করেছিল বা অন্য কাজে ব্যবহার করেছিল।

গত নভেম্বরের শেষ দিকে কাবিতাসহ হাজারো মানুষ এলটিটিইর পুরোনো কবরস্থানে জড়ো হয়েছিলেন ‘মাভিরার নাল’ পালনের জন্য। এটি একটি বিশেষ দিন। দীর্ঘ যুদ্ধে মারা যাওয়া এলটিটিই যোদ্ধাদের এই দিনে স্মরণ করা হয়। এটি কোনো একক বা ছোটখাটো স্মরণানুষ্ঠান নয়।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভিসুভামাডু ছাড়াও শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বে আরও দুই শর বেশি জায়গায় (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, উপাসনালয় ও পুরোনো কবরস্থানে) এই অনুষ্ঠান পালিত হয়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।

২০২৪ সালের মাভিরার নাল পালনের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ শ্রীলঙ্কাবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে, যাঁরা ভাবছিলেন, তামিল জাতীয়তাবাদ শেষ হয়ে গেছে, তাঁরা আসলে ভুল। এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ১৪ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার জাতীয় নির্বাচনের ফল দেখে অনেকেই এমনটা ধারণা করেছিলেন।

ওই নির্বাচনে বামপন্থী সিংহলি দল ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) বিশাল জয় পেয়েছে। তারা আগের সব রেকর্ড ভেঙে পার্লামেন্টে ১৫৯টি আসন জিতেছে। এ ছাড়া তারা উত্তর-পূর্বের তামিল-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর প্রায় সব কটিতে জয় পেয়েছে। তামিল জাতীয়তাবাদী দল তেমন ভোট পায়নি।

এই কারণে অনেকে মনে করেছিলেন, তামিলরা তাদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন বাদ দিয়েছে।

কিন্তু তামিলদের নিজস্ব ভূমির দাবি ও তাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক জটিল। আদতে দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সমস্যা এবং দুর্নীতির কারণে রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে ক্ষোভ জন্মেছিল, সেই ক্ষোভের কারণেই মূলত এনপিপি ক্ষমতায় এসেছে।

২০০৫ সাল থেকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাবশালী অবস্থানে থাকা রাজাপক্ষে পরিবারের পতন খুবই চমকপ্রদ ছিল। এই পরিবারকে তামিলরা কখনোই সমর্থন করেনি। কারণ, তামিলরা মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর ভাই গোতাবায়ে রাজাপক্ষকে গণহত্যার জন্য দায়ী করে। তবে দক্ষিণের সিংহলি–অধ্যুষিত এলাকায় রাজপক্ষে পরিবারকে বীর হিসেবে দেখা হতো, কারণ তারা এলটিটিইকে দমন করেছিল।

২০১৯ সালে গোতাবায়ে রাজাপক্ষে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে ২০২২ সালে সিংহলি দক্ষিণে গণ-আন্দোলনে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর রাজাপক্ষে পরিবার দ্রুত তাদের সব রাজনৈতিক ক্ষমতা হারায়। ২০২৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাদের দল মাত্র তিনটি আসন জিততে পেরেছে।

এনপিপি নভেম্বরের ভোটে এমন এক বিজয় অর্জন করেছে, যা দেশের দীর্ঘদিনের জাতিগত বিভাজনকে ছাপিয়ে গেছে। এমনকি তারা তামিল জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি জাফনাতেও জিতেছে।

নতুন সরকার চাইলে তামিলদের স্বায়ত্তশাসনসহ কিছু দাবি মেটাতে পারে। এর জন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিল, সামরিক বাহিনীর দখলে থাকা জমি ফেরানো এবং উত্তর-পূর্বে ভূমি দখল ও সিংহলি বসতি স্থাপন বন্ধ করা জরুরি। নতুন সরকার যদি এসব দাবি না মানে, তাহলে শ্রীলঙ্কার বিভাজন একই রকম থেকে যাবে।

এটি অনেককে, বিশেষ করে যাঁরা বাইরে থেকে তামিল রাজনীতি পর্যবেক্ষক করে থাকেন, তাঁদের অবাক করেছে। কেউ কেউ এই ভোটের ফলকে তামিল জাতীয়তাবাদের ‘শেষের শুরু’ বলেও ভেবেছেন। এমনকি এনপিপির কিছু নেতা বলেছিলেন, জাফনায় তাদের জয়ের অর্থ হলো তামিলরা ‘বর্ণবাদ’ ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু উত্তর-পূর্বে এনপিপির জয় মানে তামিল জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করা—এই ধারণা সর্বাংশে ভুল।

যাঁরা তামিল জনগণের মনের কথা বোঝেন, তাঁরা জানেন, এবারের ভোটে পরিবর্তনের কারণ তামিল জাতীয়তাবাদ ছেড়ে দেওয়া নয়। বরং এটি তামিল রাজনীতিবিদদের প্রতি তামিল নাগরিকদের অসন্তোষের প্রকাশ।

পাশাপাশি নির্বাচনের ফল দেখিয়েছে, তামিলরা বাস্তববাদী। তাঁরা ভোট দেওয়ার সময় তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক চাহিদা—দুটিকেই বিবেচনায় রাখে।

অনেক তামিল জাতীয়তাবাদী এনপিপিকে ভোট দিয়েছেন। কারণ তাঁরা ভেবেছেন, এনপিপি অর্থনৈতিক উন্নতি আনতে পারবে। আবার অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য স্থানীয় রাজনীতিবিদদের শাস্তি দিতে চেয়েছেন। এনপিপি নিজেদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা দল হিসেবে তুলে ধরেছিল, যা কিনা তামিল ভোটারদের তাদের দিকে টেনেছে।

কলম্বোর একটি জনপ্রিয় জায়গায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জব্দ করা বিলাসবহুল গাড়ি প্রদর্শন এনপিপির জনপ্রিয়তা বাড়ায়। এটি ধনী অভিজাতদের প্রতি একটি প্রতীকী চপেটাঘাত ছিল। তামিলদের প্রতি তাদের ইতিবাচক বার্তা, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, মাভিরার নাল পালনের অনুমতি দেওয়া এবং তামিলদের দমনে ব্যবহৃত সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি উত্তর-পূর্বে তাদের সমর্থন বাড়ায়।

কাবিতা নিজেও একজন দৃঢ় তামিল জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তিনিও এনপিপিকে ভোট দিয়েছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন, তিনি তামিল দলের (আইটিএকে) প্রতি হতাশা এবং তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য এনপিপিকে ভোট দিয়েছেন।

তবে এনপিপির প্রতি তামিলদের এই সমর্থন শর্তসাপেক্ষ এবং ইতিমধ্যে সে সমর্থনে ফাটল দেখা যাচ্ছে।

মাভিরার নাল পালনের জন্য তামিলদের গ্রেপ্তার করা এবং কবরস্থান থেকে সামরিক ঘাঁটি সরানোর প্রতিশ্রুতি পূরণ না করার কারণে সরকারের প্রতি তাদের ক্ষোভ বাড়ছে। তামিলরা মনে করছে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো শুধুই ফাঁকা বুলি ছিল।

এনপিপি আগে কখনো ক্ষমতায় ছিল না, তাই তাদের অতীত শাসকদের মতো দায় নেই। তবে তাদের প্রধান দল জেভিপি একসময় ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে নিষিদ্ধ ছিল; কারণ তাদের বিদ্রোহে হাজার হাজার সিংহলি নিহত হয়েছিলেন।

শ্রীলঙ্কার রাজনীতি সিংহলি বৌদ্ধদের প্রাধান্য দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে তামিলদের কখনো সমান নাগরিক হিসেবে দেখা হয়নি। তারা সব সময় অবহেলিত হয়েছে। এমনকি তামিল নেতারাও প্রায়ই তাঁদের দাবিগুলো থেকে সরে গিয়ে কলম্বোর ক্ষমতাবানদের সঙ্গে মিশে গেছেন।

তবে এবারের নির্বাচন দেখিয়েছে, তামিলদের রাজনৈতিক শক্তি শুধু ভোটের মাধ্যমে বোঝা যায় না। মাভিরার নাল এবং তামিল জাতীয়তাবাদী স্মরণানুষ্ঠানগুলো তামিলদের মানসিকতার গভীরে প্রোথিত। এই তামিল ইলমকেন্দ্রিক চেতনা নির্বাচনের বাইরে গিয়েও টিকে থাকবে এবং তাদের লক্ষ্যপূরণের চেষ্টা করবে।

নতুন সরকার চাইলে তামিলদের স্বায়ত্তশাসনসহ কিছু দাবি মেটাতে পারে। এর জন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি, সন্ত্রাসবিরোধী আইন বাতিল, সামরিক বাহিনীর দখলে থাকা জমি ফেরানো এবং উত্তর-পূর্বে ভূমি দখল ও সিংহলি বসতি স্থাপন বন্ধ করা জরুরি। নতুন সরকার যদি এসব দাবি না মানে, তাহলে শ্রীলঙ্কার বিভাজন একই রকম থেকে যাবে।

মারিও আরুলথাস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের এসওএএসের একজন গবেষক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর

বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।

সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।

আরো পড়ুন:

জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী

গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী

বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।

২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।

নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।

৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।

জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।

মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।

শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।

উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।

এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।

আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।

প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।

জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।

বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”

তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”

এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।

জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাজধানীর শাহজাহানপুরে মিনিবাসচাপায় নারী নিহত, চালক আটক
  • কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
  • ব্রেন ক্যানসারের যে ৭টি লক্ষণ আমরা সাধারণ ভেবে এড়িয়ে যাই