ইসরায়েলের ট্যাংকের পিছু হটা কিংবা যুদ্ধবিমানের আওয়াজ নীরব হয়ে যাওয়ার মানেই গাজা যুদ্ধের অবসান নয়। ইসরায়েলি আগ্রাসনে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, লাখো বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, প্রায় ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।

কিন্তু গাজার বাসিন্দাদের সবচেয়ে বড় বিপদ হয়তো সামনে অপেক্ষা করছে। কারণ, ইসরায়েল এমন আরেকটি রূপে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়, যেখানে সরাসরি সেনা উপস্থিতির দরকার নেই। 

ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ যে শূন্যস্থান তৈরি করেছে, সেখানে ভয়ংকর এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। ভেঙে পড়া সামাজিক আর মানুষের তীব্র দুর্ভোগকে পুঁজি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আবির্ভূত হচ্ছে।

এই দলগুলো একসময় দখলদারদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের’ বাহিনী হিসেবে নিজেদের দাবি করত। কিন্তু এখন তারা ক্রমে নিজেদের মানুষদের দিকেই অস্ত্র তাক করছে। মাতৃভূমির প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসার বদলে তারা সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণাকে তারা গোষ্ঠীতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির মুদ্রায় পরিণত করছে। 

আরও পড়ুনগাজা যুদ্ধে কে ‘জয়ী’ হলো, কে ‘বিজয়ী’ হলো?১৫ অক্টোবর ২০২৫

গাজা দীর্ঘদিন ইসরায়েলি বাহিনীর দখলে ছিল। এখানকার বাসিন্দাদের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এক দমবন্ধ জীবন যাপন করতে হয়েছে। তবু নিজেদের দেয়ালের মধ্যে তাঁরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিলেন।

গাজার লোকেরা ইসরায়েলি বিমান হামলায় ভয় পেতেন, অপরাধী গোষ্ঠী বা প্রতিবেশীর বন্দুকের ভয় তাঁদের ছিল না। আজ তঁাদের ভয় বহুগুণ বেড়েছে। সেটা দখলদারির দিক থেকে যেমন, আবার নিজেদের লোকদের দিক থেকেও। 

গাজা সিটির সাবরা এলাকায় সাংবাদিক সালেহ আলজাফারাউইয়ের হত্যাকাণ্ড এই নতুন পর্যায়ের অন্যতম অশুভ লক্ষণ। ২৮ বছর বয়সী এই প্রতিবেদক দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতার দলিল তৈরি করেছিলেন।

তিনি তাঁর কাজের জন্য বারবার মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন। শান্তিচুক্তির কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নিহত হলেন। ইসরায়েলি সেনার গুলি কিংবা ড্রোন হামলায় নয়, তিনি নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীদের হাতে। 

আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধবিরতিতে কে জিতল—ইসরায়েল নাকি হামাস?১০ অক্টোবর ২০২৫

এই হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দিল যুদ্ধ এখনো অন্য রূপে চলছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের একে অপরের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে, ভয় ও রক্তপাতের এক চক্র তৈরি করেছে। এটি সৈন্যদের উপস্থিতি ছাড়াই ইসরায়েলি স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে। 

এখানে ইসরায়েলের যুক্তি স্পষ্ট। দীর্ঘদিন ধরেই তারা একটি পুরোনো ঔপনিবেশিক কৌশল ‘ভাগ করে শাসন করার’ ওপর নির্ভর করছে। একটি সমাজ যদি অভ্যন্তরীণ সহিংসতার বৃত্তে ঢুকে পড়ে, সেই সমাজ আর দখলদারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থানকে নিজেদের হীনস্বার্থে উৎসাহিত করে, ইসরায়েল দুটি লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এক.

ফিলিস্তিনিদের ঐক্য দুর্বল করা। দুই. নিজেদের সেনাবাহিনীর ওপর বোঝা কমানো। এই কৌশল সরাসরি ব্যয় ও আন্তর্জাতিক নজরদারি এড়ায়, কিন্তু গাজা সেই একইভাবে রক্তাক্ত হতে থাকবে। 

গাজায় বর্তমানে যেসব সশস্ত্র গ্যাং ভীতি ছড়াচ্ছে, তারা জন্মভূমির প্রতিরোধযোদ্ধা নয়, বরং ইসরায়েলের রাজাকার গোষ্ঠী। তারা ভিন্ন নামে ইসরায়েলের দখলকে সহায়তা করছে। যুদ্ধের সময় তাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সেই সব জায়গায় কাজ করার জন্য, যেখানে ইসরায়েল সব সময় প্রকাশ্যে কাজ করতে পারত না। 

ইসরায়েলের স্বার্থে যেসব ফিলিস্তিনি কাজ করে, তাদের নিয়ে ইসরায়েলিদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ব্যবহার করার পর ছুড়ে ফেলা। উদ্দেশ্য সিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজাকারদের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা। 

আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধবিরতির পর নেতানিয়াহুর সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ১১ অক্টোবর ২০২৫

যে লোকটা এখন নিজেদের মানুষের বুকে বন্দুক তাক করছেন, তিনি নিজেকে শক্তিশালী বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু তার পরিণতি সব সময়ের জন্য এক। নিজের দেশের জনগণ ও দখলদার—সবাই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। 

ফিলিস্তিনিদের জন্য এর পরিণতি কোনোভাবেই বিপর্যয়ের চেয়ে কম কিছু নয়। ভয়ের পরিবেশে মুক্তি নির্মাণ করা যায় না। প্রতিরোধ যখন নৈতিক স্বচ্ছতা হারায়, যখন এটিকে নিপীড়কদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আলাদা করা যায় না, তখন এটি তার বৈধতা হারায়। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম কখনো শুধু খেয়ে–পরে বেঁচে থাকার জন্য ছিল না; এটি সব সময় মর্যাদা, ন্যায় ও স্বাধীনতার জন্য ছিল। 

ইসরায়েল হয়তো আশা করছে যে তারা প্রক্সিদের দিয়ে যুদ্ধ জারি রাখবে। তারা এমন এক গাজার কথা কল্পনা করছে, যেখানে ফিলিস্তিনিরা দখলদারদের বিরুদ্ধে না লড়ে নিজেদের মধ্যে লড়বে। ফিলিস্তিনিদের এখনো তাদের পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে। তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পথকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবং ফিলিস্তিনি সংগ্রাম যেকোনো গোষ্ঠীর চেয়ে বড়, সেটা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। 

আমাল আবু সিফ ফিলিস্তিনি লেখক ও গবেষক

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

[লেখাটি ১৮ অক্টোবর ২০২৫ প্রথম আলো ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়। আজ ২০ অক্টোবর ২০২৫ অনলাইনেও প্রকাশিত হলো।]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র সশস ত র গ দখলদ র র জন য ক জ কর

এছাড়াও পড়ুন:

‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেছেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল গাজা ইস্যুতে সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা সন্ত্রাসী এবং বিখ্যাত আইন লঙ্ঘনকারী ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গাজা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক আইন প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা গাজায় ইসরায়েলের ব্যাপক ও অবিশ্বাস্যভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার  আইন (আইএইচএল) লঙ্ঘন, পরবর্তী দিনগুলোতে এর প্রয়োগ ও অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলে।”

শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) তুরস্কের চাংকিরি কারাতেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্স হলের রেক্টরেট ভবনে ‘গাজা কনফ্লিক্ট: এ ডাইং ডিক্লারেশন অফ ইন্টারন্যাশনাল ল’ (গাজা সংঘাত: আন্তর্জাতিক আইনের মৃত্যুকালীন জবানবন্দী) শীর্ষক শিরোনামে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। 

আরো পড়ুন:

‘সাজিদ হত্যার ৯০তম দিন, এরপর কি আমি?’

ইবি শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ, রেহায় পায়নি রোগীরা

তিনি অক্টোবরে গাজার সীমান্ত এলাকায় হামাসের আক্রমণের বৈধতা, গাজার উপর ইসরায়েলের আক্রমণ এবং এর বৈশিষ্ট্য, ইসরায়েলের আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ইসরায়েলের আচরণ নিয়ে আলোচনা করেন। 

উপাচার্য বলেন, “১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের একটি চক্রান্তের ফলে ইসরায়েল অবৈধভাবে জন্মগ্রহণকারী একটি রাষ্ট্র। গাজা সংঘাতে ইসরায়েলের আচরণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের অভূতপূর্ব লঙ্ঘন। ২০২৩ সাল থেকে গাজা সংঘাতে ইসরায়েলের আচরণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছে।”

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও ফৌজদারি আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণকে বৈধ দাবি করে তিনি বলেন, “গাজা উপত্যকা একটি দখলকৃত অঞ্চল এবং এর জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অধিকারী (বিখ্যাত ফিলিস্তিনের প্রাচীর মামলায় আইসিজে-র উপদেষ্টা মতামত)। হামাসের আক্রমণ দখলদার ইসরাইলের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ছিল এবং তাই জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের অধীনে ‘আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে’ বলা যেতে পারে। স্থায়ী দখলদারিত্ব আত্মরক্ষার অধিকারের চিরস্থায়ী চরিত্রের জন্ম দেয়।”

এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের আচরণ মূল্যায়নে তিনি বলেন, “গাজার উপর ইসরাইলের আক্রমণ আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে পাল্টা আক্রমণ বা আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হয় না। কারণ ইসরাইল দখলদার শক্তি। আইসিজের মতামত হল- আন্তর্জাতিক আইনে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার ৫১ অনুচ্ছেদের অধিকার নেই। এটি জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ২(৪) লঙ্ঘন করে একটি নতুন আক্রমণ।”

উপাচার্য বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (আইএইচএল) অনুসারে ইসরায়েলের আক্রমণ নিষিদ্ধ শ্রেণীর কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে। এতে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণ, নির্বিচারে আক্রমণ, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর (বাসস্থান, বাজার, দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য) বিরুদ্ধে আক্রমণ, মানবিক সাহায্যের উপর স্বেচ্ছাচারী বিধিনিষেধের মাধ্যমে অনাহারকে যুদ্ধের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য জিনিসপত্র ধ্বংস করা, মানবাধিকার কর্মীদের উপর আক্রমণ, সুরক্ষিত ব্যক্তিদের, সাংবাদিকদের হত্যা, নির্যাতন, নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা, বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধ, সম্মিলিত শাস্তি, যুদ্ধবন্দীদের হত্যা, ঘোড়া-বিধ্বংসী যুদ্ধ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও যুদ্ধে সন্ত্রাস ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন (আইএইচএল) লঙ্ঘনের শামিল।”

অনুষ্ঠান শেষে সফরের বিষয়ে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি খুবই অবাক হয়েছি যে বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৭ সালে শুরু হয়েছিল। এত অল্প সময়ের মধ্যেই এটি আশ্চর্যজনকভাবে এগিয়েছে। বিশাল ও অটল প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কতদূর এগিয়ে যেতে পারে। এটিই তার বাস্তব উদাহরণ। এটি বেশ আশ্চর্যজনক যে, এই সময়ের মধ্যে আপনি আপনার শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করেছেন এবং আপনার দেশের বাইরে থেকে অনেক শিক্ষার্থীকে আকৃষ্ট করেছেন।”

ইবি উপাচার্য তুরস্কের চাংকিরি কারাতেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরাসমাস+ কেএ১৭১ আন্তর্জাতিক ক্রেডিট মবিলিটি প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণভিত্তিক ভ্রমণে অংশ নেন। ইরাসমাস সমন্বয় অফিস থেকে পাঠানো আমন্ত্রণপত্রে উপাচার্যকে আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ভ্রমণে অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

ঢাকা/তানিম/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৮ দিনে ৪৭বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল
  • ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ’
  • মারওয়ান বারঘুতিকে মুক্তি দিতে ইসরায়েল কেন ভয় পায়