বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, সমন্বয়হীনতাসহ নানা জটিলতা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব সমস্যা দূর করতে বারবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে দেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ কম। কয়েক বছর ধরে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় এক জায়গায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে কৃষি, ওষুধ, নবায়নযোগ্য শক্তি খাতসহ ১৯টি খাতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে ‘হিটম্যাপ’ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। রোববার সংস্থাটি এটি প্রকাশ করেছে। 
বিডার কর্মকর্তারা জানান, হিটম্যাপ হলো বাংলাদেশে কীভাবে আরও বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ আনা যায়, তার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। অর্থাৎ এটি ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ প্রচেষ্টার একটি রূপরেখা। হিটম্যাপ বিনিয়োগের প্রচারে কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেবে, যা ১৯টি সম্ভাবনাময় খাতে এফডিআই আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। 

বিডার তথ্যমতে, সর্বশেষ গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৮৬টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। তারা মোট ১৯ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। এর পরিমাণ আগের তিন মাসের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা, ডলার সংকট, বছর বছর বিনিয়োগনীতির পরিবর্তন,  সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কর কাঠামোতে বারবার পরিবর্তন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট এবং ঋণের উচ্চ সুদ হারের কারণে সার্বিকভাবে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ কমছে। 
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, এফডিআই হিটম্যাপ শুধু একটি পরিকল্পনা নয়, এটি ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ প্রচেষ্টার রূপরেখাও। আগামীতে যে কোনো রোডশো, দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি বা নীতিগত সহায়তা এই তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ অনুযায়ী পরিচালনা করা হবে। বিডার ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি বলেন, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও এফডিআই বর্তমানে জিডিপির মাত্র শূন্য পাঁচ শতাংশ। যেখানে বৈশ্বিক গড় ৩ থেকে ৪ শতাংশ। হিটম্যাপ বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়াতে খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার প্রদান, বিনিয়োগকারী বাজার শনাক্তকরণ এবং জাতীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কৌশল তৈরিতে সাহায্য করবে।

১৯টি অগ্রাধিকার খাত
এফডিআই হিটম্যাপ ১৯টি খাতকে তিনটি প্রধান মানদণ্ডের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। যেমন– বাজার প্রস্তুতি ও সম্ভাবনা, ইনপুট ফ্যাক্টরের প্রাপ্যতা ও জাতীয় লক্ষ্যের (এসডিজি ও ইএসজি) সঙ্গে কৌশলগত সংযোগ। ক্যাটেগরি ‘এ’-কে বলা হয়েছে তাৎক্ষণিক লক্ষ্য। এ ক্যাটেগরি মূলত উচ্চ বাজার প্রস্তুতি, দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং অনন্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাসম্পন্ন খাত। এতে রয়েছে মৌলিক  পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যালস (এপিআই ছাড়া), কৃষি প্রক্রিয়াকরণ,    আইটি-সক্ষম সেবা, উন্নত টেক্সটাইল এবং নবায়নযোগ্য শক্তি। ক্যাটেগরি ‘বি’-কে বলা হচ্ছে– দ্রুত প্রবেশযোগ্য খাত বা মধ্যম মানের বাজার প্রস্তুতি; কিন্তু শক্তিশালী প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাসম্পন্ন খাত। এ ক্যাটেগরিতে রয়েছে অটোমোটিভ পার্টস, ফুটওয়্যার, হালকা প্রকৌশল ও চামড়া। এ ছাড়া ক্যাটেগরি ‘সি’-কে বলা হচ্ছে, কাস্টমাইজড চুক্তি। অর্থাৎ উন্নয়ন সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ইনপুট চ্যালেঞ্জ সমাধানে বিশেষ চুক্তি প্রয়োজন। এ ক্যাটেগরিতে আছে লজিস্টিকস ও ইলেকট্রনিকস ও অ্যাসেম্বলি। ক্যাটেগরি ‘ডি’-কে বলা হচ্ছে নীতি ও সক্ষমতা উন্নয়ন। এটি দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সহায়তা এবং ইকোসিস্টেম উন্নয়নের প্রয়োজনীয় খাত। এতে রয়েছে ইভি ব্যাটারি, মেডিকেল ডিভাইস, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল, খেলনা, অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস, সেমিকন্ডাক্টর ও প্লাস্টিক খাত।

বিডা জানিয়েছে, হিটম্যাপের কার্যকারিতা সফল করতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ফোরাম, রোডশো এবং নীতি উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি একটি পাবলিক-প্রাইভেট উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করে নীতিগত ঘাটতি পূরণ এবং ইকোসিস্টেম শক্তিশালীকরণের কাজ করবে। হিটম্যাপটি প্রতি বছর পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা হবে। 

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর সমন্বয় ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কার টেকসই হবে না

নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কার টেকসই হবে না। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নিয়মিত সভা করে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জোগান ও ব্যাংকের মূলধন কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। মূলধন জোগান দেওয়া ছাড়া শুধু সংকটে পড়া ব্যাংক নয়, ভালো ব্যাংকগুলোকেও ভুগতে হতে পারে।

‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থা পুনরুদ্ধার: মূলধন এখন কেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এমন অভিমত উঠে আসে। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ আজ সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, ব্যাংকার, পুঁজিবাজারের অংশীজনেরা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ।

বক্তারা বলেন, ব্যাংকে পর্যাপ্ত মূলধন হলো আর্থিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি, যা আমানতকারীদের সুরক্ষা দেয়, তারল্য বজায় রাখে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা টিকিয়ে রাখে।

এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘আমাদের জাতীয় বিনিয়োগ কৌশল নেই। ফলে বিনিয়োগ বাড়াতে যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলোর সমাধান হচ্ছে না। বিনিয়োগ বাড়াতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোও বিভিন্ন বাধা তৈরি করে রেখেছে। এসব দূর করা জরুরি। ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বন্ধ করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তুলতে হবে। ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী নতুন পথের সন্ধান করতে হবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য মূলধন বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল পরিচালন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি বেড়ে গেছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে। আগে যে ভুল হয়েছে, তা শোধরাতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় খুবই জরুরি। তবে সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান ও. রশিদ বলেন, ব্যাংকের শেয়ারধারণে ২ শতাংশ কোনো ইস্যু নয়। সমস্যা হলো সুশাসন ছিল না। একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে একজনের বেশি পরিচালক না দিলেই হয়। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি কাঠামো শক্তিশালী করা দরকার। ব্যাংকের মূলধন বাড়াতে আর বন্ড নয়, শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে হবে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে এক টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।

আল–আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর মধ্যে যে শীতল যুদ্ধ চলে, তার অবসান হওয়া দরকার। এনআই অ্যাক্টে মামলা হলে শুনানির তারিখ পেতে এক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ আদায়ে সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকের মূলধনে বাড়াতে দেশের পাশাপাশি বিদেশি তহবিলের দিকেও নজর দিতে হবে। বিদেশ থেকে এখনো কম খরচে তহবিল পাওয়া সম্ভব। এ জন্য সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে।

সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আগে অনেক ভালো নিয়মকানুন ছিল। আমরা ধীরে ধীরে তা থেকে সরে এসেছি। সুদের হারে ৬/৯–এর মতো তত্ত্ব চালু করে আমরা সারা বিশ্বকে শিখিয়েছি। এর প্রতিদান এখন আমরা পাচ্ছি। এ জন্য আন্তর্জাতিক চর্চা মেনে চলতে হবে। যেসব ব্যাংকে মূলধন জোগান দিয়েও ঠিক করা যাবে না, সেগুলোতে টাকা ঢালা ঠিক হবে না। যেসব ব্যাংক ঠিক হওয়া সম্ভব সেগুলোর এবং ভালো ব্যাংকগুলোর মূলধন বাড়াতে হবে।’ নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধার কারণ দেশে নতুন আর্থিক পণ্য চালু করা যায় না বলে জানান তিনি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, মূলধন বাড়াতে সরকারের গ্যারান্টি–নির্ভর বন্ড চালু করতে হবে। তবে দেশের মানুষের বন্ডে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা ভালো না। ১৯৯৫ সালে চালু হওয়া বন্ডের টাকা এখনো ফেরত পাওয়া যায়নি। ব্যাংকগুলোর বন্ড এখন ক্লাব নির্ভর হয়ে গেছে। এক ব্যাংকের বন্ড অন্য ব্যাংক কিনছে। বন্ডে বিনিয়োগে ৩০ শতাংশ উদ্যোক্তাদের কিনতে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

হোদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার এ এফ নেছারউদ্দিন বলেন, ব্যাংক খাতে এই দুরবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক একীভূতকরণই যথেষ্ট নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হওয়াটা নিশ্চিত করতে সময়োপযোগী সংস্কার, স্বচ্ছ প্রতিবেদন প্রকাশ, স্বতন্ত্র মূল্যায়ন এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য মূলধন পুনর্গঠন কাঠামো দরকার।

সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা অংশীদার সৈয়দ আফজাল হাসান উদ্দিন বলেন, ধীর আইনি প্রক্রিয়া বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে। খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার এবং বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় বিনিয়োগকারীদের শক্তিশালী আস্থা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরী বাণিজ্যিক আদালত দরকার। যারা অর্থ তছরুপ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও খেলাপির মামলা দিয়ে শেয়ার বাজেয়াপ্ত করলে কিছুটা ফলাফল পাওয়া যেত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ