বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিনির্ধারক নিয়োগে যুগোপযোগী নীতিমালা
Published: 30th, January 2025 GMT
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন এখন জাতীয় দাবি। তা না হলে আমরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারেকাছেও যেতে পারব না। আমরা মনে করি, এ জন্য সবার আগে পরিবর্তন করতে হবে নীতি বা পলিসি। নীতি তৈরিতে যারা থাকবেন তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা দরকার। কাজটি শুরু করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়োগবিধিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনে।
আমরা বারবার বলে এসেছি, উচ্চশিক্ষা তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউজিসি কোনোভাবেই সাফল্য দেখাতে পারছে না। বরং এটি একটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউজিসির কাজ মিটিং, স্বাক্ষর এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা। স্বাভাবিক কারণেই এ প্রতিষ্ঠানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। ইউজিসিকে ইতিবাচকভাবে ক্ষমতায়িত করার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ দিতে হবে। এখানে সব সদস্যের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী, যোগ্য, নীতিবান ও দক্ষ ব্যক্তিদের (একাডেমিক) ইউজিসির চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
সেই লক্ষ্যে প্রথমেই ইউজিসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি স্বচ্ছ ও আধুনিক নীতি কার্যকর করতে হবে। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করতে হবে, যাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণায় গ্রহণযোগ্যতা আছে; রয়েছে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা। শিক্ষা ও গবেষণা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতাও বিশেষভাবে দরকার।
আমরা মনে করি, নিয়োগগুলো হতে হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (যারা শিক্ষা ও গবেষণায় অনেক উন্নত) মডেল অনুসরণ করে এসব পদে নিয়োগ দিতে হবে; কোনোভাবেই (এক, দুই, তিন নামের তালিকা বানিয়ে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে নিয়োগ দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি অবশ্যই একাডেমিকভাবে সাহসী ও ন্যায়নিষ্ঠ হবেন। তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। এ জন্য প্রথমেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করতে হবে। এ কমিটি উন্মুক্ত সার্কুলারের মাধ্যমে প্রার্থীদের আবেদনের জন্য অনুরোধ করবে। এতে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে যে কোনো বাংলাদেশি আবেদন করতে পারবেন।
প্রার্থীদের আবেদন থেকে সব ক্রাইটেরিয়া বিশেষ করে শিক্ষাগত যোগ্যতা, আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা, প্রশাসনিক দক্ষতা, আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পলিসি লেভেলে কাজ করার অভিজ্ঞতা, প্রার্থীর ভিশন ও মিশন-সংক্রান্ত বক্তব্য, যোগাযোগ দক্ষতা এবং আগামী চার বছর প্রতিষ্ঠানকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, সে বিষয়ে বক্তব্য সংগ্রহ করতে হবে। এসব ক্রাইটেরিয়া যাচাই-বাছাই করে বিশেষজ্ঞ কমিটি একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করবে। বিশেষজ্ঞ কমিটি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে নির্দিষ্টসংখ্যক ব্যক্তি বা প্রার্থীর একটি চূড়ান্ত তালিকা করে নিয়োগ বোর্ডের প্রধান অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবে। নিয়োগ বোর্ডের প্রধান কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই তালিকা থেকে যে কোনো একজনকে (পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জনকে) নিয়োগ দেওয়ার জন্য নিয়োগপত্র তৈরি করবেন; তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন এবং তাঁর হাতে নিয়োগপত্র দেবেন।
একই প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি অবশ্যই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন। এ ধরনের ব্যক্তি যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবেন এবং দলীয় আনুগত্যের রাজনীতি ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন বলে আমরা মনে করি। আমরা এও বিশ্বাস করি, এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর পেশাগত কোনো দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলে বা নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠলে তদন্তের স্বার্থে স্বেচ্ছায় পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে ভারত কিংবা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে। এর থেকে আরও ভালো অভিজ্ঞতা নিতে চাইলে এশিয়ার দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরকে বেছে নেওয়া যায়। উন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপ বা আমেরিকার উদাহরণ নাই-বা দিলাম। এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দিতে হলে প্রচলিত পে প্যাকেজের বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনীয় প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধায় অনেকের পক্ষেই কাজ করা সম্ভব হবে না। এতে পেশাগতভাবে সুযোগ্য, দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি (হাই-প্রোফাইল) এত অপ্রতুল এবং অনাকর্ষণীয় আর্থিক প্যাকেজে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে চাইবেন না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, উচ্চশিক্ষা কখনও ব্যয় সংকোচন নীতিতে চলতে পারে না। উচ্চশিক্ষায় বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করতে পারলে ভবিষ্যতে কয়েক গুণ ফল পাওয়া যাবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করবে। গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে খুব একটা পরিবর্তন হবে না; বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমস্যা বেড়ে যাবে। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে (যেমন সরকারি কর্ম কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) চেয়ারম্যান নিয়োগের জন্য ব্যাপক সংস্কার করতে হবে এবং একটি উচ্চমানসম্পন্ন নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা একটি উন্নত বাংলাদেশ পেতে পারি; অন্যথায় শিক্ষাক্ষেত্রে টেকসই উন্নতি হবে না।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ পদে (উপাচার্য, উপ-উপাচার্য) নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি একটি স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক, যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে না পারি তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও পেশাদার নীতিনির্ধারক বসাতে পারব না। আর তা করা সম্ভব না হলে এসব প্রতিষ্ঠান (পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়) আরও দুর্বল এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমে আরও নাজুক হয়ে পড়বে। এসব কাঠামোগত পরিবর্তন আনার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই অতি দ্রুত ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।
ড.
masud@nstu.edu.bd
শেখ নাহিদ নিয়াজী: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক জ কর র জন য ইউজ স সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কুষ্টিয়ায় বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত নেতার অনুসারীদের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে বিএনপির স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিন দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা। আজ সোমবার রাত ৯টার দিকে শহরের মজমপুর রেলগেটে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে এ বিক্ষোভ করেন তাঁরা।
সেখানে বিক্ষোভকারীরা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভের পাশাপাশি প্রতিবাদ মিছিলও করেন। এ ছাড়া সদর উপজেলার মধুপুর-লক্ষীপুর এলাকাতেও সোহরাব উদ্দিনের সমর্থকেরা সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন।
বিক্ষোভকারী নেতা-কর্মীদের দাবি, সোহরাব উদ্দিন কুষ্টিয়া-৩ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। তিনি দীর্ঘদিন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বদলে এখানে অন্য কাউকে প্রার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া হবে না। তাই অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সোহরাব উদ্দিনকে পুনরায় মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।
এর আগে সোমবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা বিএনপির সদস্যসচিব জাকির হোসেন সরকার।
এ বিষয়ে মনোনয়নবঞ্চিত সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘শুনেছি আমার সমর্থকেরা বিক্ষোভ করছেন। আমি শহরের বাইরে আছি।’ এর বেশি কথা বলেননি তিনি।
জানতে চাইলে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জাকির হোসেন সরকার বলেন, কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যিনি মনোনয়ন পাবেন, তাঁর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তবে এ নির্দেশনা যদি কেউ না মানেন, তাহলে কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে।
কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হাসেন বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণ করেছি।’
কুষ্টিয়ার অন্য তিনটি সংসদীয় আসনে বিএনপির প্রার্থীরা হলেন কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি রেজা আহম্মেদ বাচ্চু মোল্লা, কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভোড়ামারা) আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাগীব রউফ চৌধুরী, কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমি।