বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন এখন জাতীয় দাবি। তা না হলে আমরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারেকাছেও যেতে পারব না। আমরা মনে করি, এ জন্য সবার আগে পরিবর্তন করতে হবে নীতি বা পলিসি। নীতি তৈরিতে যারা থাকবেন তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা দরকার। কাজটি শুরু করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিয়োগবিধিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক পরিবর্তন এনে।

আমরা বারবার বলে এসেছি, উচ্চশিক্ষা তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউজিসি কোনোভাবেই সাফল্য দেখাতে পারছে না। বরং এটি একটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউজিসির কাজ মিটিং, স্বাক্ষর এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা। স্বাভাবিক কারণেই এ প্রতিষ্ঠানে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। ইউজিসিকে ইতিবাচকভাবে ক্ষমতায়িত করার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ দিতে হবে। এখানে সব সদস্যের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সবচেয়ে মেধাবী, যোগ্য, নীতিবান ও দক্ষ ব্যক্তিদের (একাডেমিক) ইউজিসির চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। 
সেই লক্ষ্যে প্রথমেই ইউজিসির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি স্বচ্ছ ও আধুনিক নীতি কার্যকর করতে হবে। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করতে হবে, যাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণায় গ্রহণযোগ্যতা আছে; রয়েছে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা। শিক্ষা ও গবেষণা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতাও বিশেষভাবে দরকার। 

আমরা মনে করি, নিয়োগগুলো হতে হবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (যারা শিক্ষা ও গবেষণায় অনেক উন্নত) মডেল অনুসরণ করে এসব পদে নিয়োগ দিতে হবে; কোনোভাবেই (এক, দুই, তিন নামের তালিকা বানিয়ে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এখানে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে নিয়োগ দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি অবশ্যই একাডেমিকভাবে সাহসী ও ন্যায়নিষ্ঠ হবেন। তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। এ জন্য প্রথমেই একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করতে হবে। এ কমিটি উন্মুক্ত সার্কুলারের মাধ্যমে প্রার্থীদের আবেদনের জন্য অনুরোধ করবে। এতে দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে যে কোনো বাংলাদেশি আবেদন করতে পারবেন।

প্রার্থীদের আবেদন থেকে সব ক্রাইটেরিয়া বিশেষ করে শিক্ষাগত যোগ্যতা, আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা, প্রশাসনিক দক্ষতা, আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পলিসি লেভেলে কাজ করার অভিজ্ঞতা, প্রার্থীর ভিশন ও মিশন-সংক্রান্ত বক্তব্য, যোগাযোগ দক্ষতা এবং আগামী চার বছর প্রতিষ্ঠানকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, সে বিষয়ে বক্তব্য সংগ্রহ করতে হবে। এসব ক্রাইটেরিয়া যাচাই-বাছাই করে বিশেষজ্ঞ কমিটি একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করবে। বিশেষজ্ঞ কমিটি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে নির্দিষ্টসংখ্যক ব্যক্তি বা প্রার্থীর একটি চূড়ান্ত তালিকা করে নিয়োগ বোর্ডের প্রধান অথবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেবে। নিয়োগ বোর্ডের প্রধান কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই তালিকা থেকে যে কোনো একজনকে (পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জনকে) নিয়োগ দেওয়ার জন্য নিয়োগপত্র তৈরি করবেন; তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন এবং তাঁর হাতে নিয়োগপত্র দেবেন। 

একই প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি অবশ্যই স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন। এ ধরনের ব্যক্তি যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবেন এবং দলীয় আনুগত্যের রাজনীতি ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থাকবেন বলে আমরা মনে করি। আমরা এও বিশ্বাস করি, এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর পেশাগত কোনো দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলে বা নৈতিক স্খলনের অভিযোগ উঠলে তদন্তের স্বার্থে স্বেচ্ছায় পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে ভারত কিংবা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতাকে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে। এর থেকে আরও ভালো অভিজ্ঞতা নিতে চাইলে এশিয়ার দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরকে বেছে নেওয়া যায়। উন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপ বা আমেরিকার উদাহরণ নাই-বা দিলাম। এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দিতে হলে প্রচলিত পে প্যাকেজের বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তুলনীয় প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধায় অনেকের পক্ষেই কাজ করা সম্ভব হবে না। এতে পেশাগতভাবে সুযোগ্য, দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি (হাই-প্রোফাইল) এত অপ্রতুল এবং অনাকর্ষণীয় আর্থিক প্যাকেজে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসতে চাইবেন না। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, উচ্চশিক্ষা কখনও ব্যয় সংকোচন নীতিতে চলতে পারে না। উচ্চশিক্ষায় বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করতে পারলে ভবিষ্যতে কয়েক গুণ ফল পাওয়া যাবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করবে। গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে খুব একটা পরিবর্তন হবে না; বরং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমস্যা বেড়ে যাবে। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে (যেমন সরকারি কর্ম কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) চেয়ারম্যান নিয়োগের জন্য ব্যাপক সংস্কার করতে হবে এবং একটি উচ্চমানসম্পন্ন নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগ দিতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা একটি উন্নত বাংলাদেশ পেতে পারি; অন্যথায় শিক্ষাক্ষেত্রে টেকসই উন্নতি হবে না। 

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বোচ্চ পদে (উপাচার্য, উপ-উপাচার্য) নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি একটি স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক, যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে না পারি তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও পেশাদার নীতিনির্ধারক বসাতে পারব না। আর তা করা সম্ভব না হলে এসব প্রতিষ্ঠান (পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়) আরও দুর্বল এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ক্রমে আরও নাজুক হয়ে পড়বে। এসব কাঠামোগত পরিবর্তন আনার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই অতি দ্রুত ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। 

ড.

আবদুল কাইয়ুম মাসুদ: অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় 
masud@nstu.edu.bd 
শেখ নাহিদ নিয়াজী: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ 
nahidneazy@yahoo.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক জ কর র জন য ইউজ স সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ম্যাচ রেফারি পাইক্রফ্ট ক্ষমা চাওয়ার পরই খেলতে রাজি হয়েছিল পাকিস্তান

সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে টসের আগ পর্যন্ত দারুণ নাটকীয়তায় ঘেরা ছিল পাকিস্তানের ড্রেসিং রুম। ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফ্টকে দায়িত্ব থেকে সরানোর দাবি তোলে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। তবে আইসিসি সে দাবি আমলে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজের ভুল স্বীকার করে পাকিস্তান অধিনায়ক সালমান আলী আগা ও দলের ম্যানেজারের কাছে ক্ষমা চান পাইক্রফ্ট। এরপরই মাঠে নামতে রাজি হয় পাকিস্তান দল।

ঘটনার সূত্রপাত ১৪ সেপ্টেম্বরের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ থেকে। টসের সময় দুই অধিনায়কের করমর্দন হয়নি। আরও বড় বিতর্ক তৈরি হয় ম্যাচ শেষে। জয়ী ভারতের ক্রিকেটাররা করমর্দন এড়িয়ে দ্রুত ড্রেসিং রুমে ফিরে যান। সালমান আলী আগার নেতৃত্বে পাকিস্তানের খেলোয়াড়রা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলেও সূর্যকুমার যাদব, শিভাম দুবেসহ পুরো ভারতীয় দল সেই শিষ্টাচার মানেনি।

আরো পড়ুন:

আজ মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তান, যে ম্যাচে ঝুলছে বাংলাদেশের ভাগ্য

আমিরাতকে হারিয়ে সুপার ফোরে পাকিস্তান

এমন ঘটনার প্রতিবাদে পাকিস্তান অধিনায়ক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান বর্জন করেন। পরে আইসিসির কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানায় পিসিবি। তাদের দাবি ছিল, ম্যাচ রেফারি পাইক্রফ্ট ইচ্ছাকৃতভাবেই দুই অধিনায়কের হাত মেলানো আটকান, যা আইসিসির আচরণবিধি ও ক্রিকেটের স্পিরিটের পরিপন্থী।

যদিও আইসিসির ব্যাখ্যা ছিল ভিন্ন। তারা জানায়, এসিসির কর্মকর্তাদের নির্দেশেই কাজ করেছেন পাইক্রফ্ট। কিন্তু পাকিস্তান নড়েচড়ে বসে। এমনকি জানিয়ে দেয়, পাইক্রফ্ট দায়িত্বে থাকলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে মাঠে নামবে না তারা। এই হুমকির কারণে ম্যাচের শুরুর সময় এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয় আয়োজকরা।

লাহোরে রমিজ রাজা, নাজাম শেঠিসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন পিসিবি চেয়ারম্যান মহসিন নাকভি। পরে সমঝোতার পথ খোঁজা হয়। অবশেষে পাইক্রফ্ট স্বীকার করেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণেই পরিস্থিতি এতদূর গড়ায়, এবং তিনি পাকিস্তান অধিনায়ক ও ম্যানেজারের কাছে ক্ষমা চান। তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান দল।

বুধবার রাতে ‘এ’ গ্রুপে নিজেদের সেই শেষ ম্যাচে আরব আমিরাতকে ৪১ রানের ব্যবধানে হারিয়ে সুপার ফোরে ভারতের সঙ্গী হয় সালমান-শাহীনরা। দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে পাকিস্তান সংগ্রহ করে ৯ উইকেটে ১৪৯ রান। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ১৭.৪ ওভারে ১০৫ রানেই গুটিয়ে যায় আরব আমিরাত।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ