জুলাই–আগস্টের গণ–আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ সরকারের দমন–পীড়ন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদন ভয়ংকর বীভৎসতার তথ্যসংবলিত। প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ উত্থাপন করেছে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘ কাউকে নিষিদ্ধ করা বা মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। তাই তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কথা বলেছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে সহায়তার কথাও বলেছে। প্রশ্নটা তাই জোরালোভাবে উঠেছে, আওয়ামী লীগে কি শেষের শুরু হয়ে গেল?

আওয়ামী লীগের ওপর এই প্রতিবেদন কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে? জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ হত্যাযজ্ঞ পরিচালনাকারী দল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এর আগে মূলত দেশের ভেতরেই আওয়ামী লীগের অপরাধের আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। এতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগে আওয়ামী লীগ বাধার সম্মুখীন হবে। লবিং করা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, গণহত্যাকারী কোনো দলের পক্ষে সহজে কেউ কাজ করতে চাইবে না। রাজনৈতিক দল হিসেবে সারা বিশ্বেই গ্রহণযোগ্যতা হারাবে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অভিযোগ তদন্ত করতে সরকার জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ বেশ দ্রুত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগ দিল্লি থেকে প্রচার করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু জাতিসংঘের তৈরি এই প্রতিবেদন নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। এই সুযোগ বন্ধ করার জন্যই সরকার জাতিসংঘের সহায়তা নিয়েছে।

জাতিসংঘকে সরকার দায়িত্ব দিয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাযজ্ঞের আদ্যোপান্ত তুলে আনতে। আওয়ামী লীগ পরিষ্কারভাবে সরকার, বিশেষ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে। দেশের ভেতরে নিজস্ব জনবল দিয়ে তদন্ত করলে আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কুতর্ক সৃষ্টি করার সুযোগ পেত। সরকার এই সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।  

সরকার এই প্রতিবেদনকেই আদালতে উপস্থাপন করে আওয়ামী লীগের বিচার শুরু করতে পারে। এটা আওয়ামী লীগের নৃশংসতার আন্তর্জাতিক প্রমাণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকার্যে এই প্রতিবেদন রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এই প্রতিবেদন মানতে কেউ আইনগতভাবে বাধ্য নয়, কিন্তু তা সারা বিশ্বে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কোনো ধরনের উসকানিতে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের আর পা না দেওয়াই মঙ্গলজনক হবে। যদিও তাঁদের মধ্যে অনুশোচনা বা অনুতাপের লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা বরং দাবি করছেন যে জুলাই–আগস্টের হত্যাযজ্ঞ ছাত্র ও বিএনপি–জামায়াত পরিচালনা করেছে। তাঁরা আয়নাঘরকেও স্বীকার করতে চান না।

মনে রাখতে হবে, প্রতিবেদনটি ঢাকায় প্রকাশ করা হয়নি বা সরকারের কাছে আগে হস্তান্তর করা হয়নি। ঢাকা থেকে আমাদের সরকার প্রকাশ করলে এর গ্রহণযোগ্যতা কম হতে পারত। কিন্তু জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার ভলকার টুর্ক নিজে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।

আওয়ামী লীগ ছাড়াও শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে ভারতও সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। এতে মানবাধিকার সূচকে ভারতের পয়েন্ট কমে যেতে পারে। কারণ, ভারত জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীকে আশ্রয় দিয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফিরত দেওয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ করেছে। এখন বাংলাদেশ যদি জাতিসংঘকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে তবে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।

তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। প্রবাসী শিখকে কানাডায় হত্যা করার শক্ত অভিযোগ নিয়ে এমনিতেই ভারত বিপাকে আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর অবৈধ ভারতীয়দের ফেরত পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে ভারত ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদে জড়ালে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এই প্রতিবেদনের কারণে শুধু আওয়ামী লীগই না, ভারতেরও বিপাকে পড়ার শঙ্কা আছে।  

সব মিলিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন আওয়ামী লীগের জন্য বড় ধরনের হতাশার সংবাদ। এর ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরা আরও কঠিন হতে পারে। ভারতে অবস্থান করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা শান্তি এড়াতে পারবেন; কিন্তু বিচার এড়াতে পারবেন না। সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা ড.

আসিফ নজরুল বলেছেন, অক্টোবর–নভেম্বর নাগাদ কয়েকজনের বিচারের রায় ঘোষণা হতে পারে। এখন বিচারপ্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের প্রতিবেদন থেকে সহায়তা নিতে পারবে সরকার। যা বিচারকে তরান্বিত করতে সহায়তা করবে এবং গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের স্বীকৃতি নিশ্চিত করবে। এমনিতেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনের কারণে এই দাবি আরও জোরালো হবে।

জাতিসংঘের হিসাবে জুলাই–আগস্টের অভ্যুত্থানে ১৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। শেখ হাসিনার নির্দেশেই নির্বিচারে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি গুলি করে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছে। এসব হামলা করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে নিরস্ত্র মানুষের ওপর।

এর আগে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনেও একই ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, টার্গেট কিলিং করেছে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি। হামলার সাক্ষী না রাখতে রাস্তার পাশে বিভিন্ন বাসাবাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করেছে র‌্যাব–পুলিশ। এমনকি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের হত্যা করে গুম করে দিতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা।

এই মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে আর বের হয়ে আসা সম্ভব না। এটা হয়তো আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা বুঝতে পারছেন না। তাঁরা এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন, সম্ভবত শেখ হাসিনা আবারও ফিরে আসবেন! শেখ হাসিনাও ভারতে বসে বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে নেতা–কর্মীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।

কোনো ধরনের উসকানিতে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের আর পা না দেওয়াই মঙ্গলজনক হবে। যদিও তাঁদের মধ্যে অনুশোচনা বা অনুতাপের লেশমাত্র দেখা যাচ্ছে না। তাঁরা বরং দাবি করছেন যে জুলাই–আগস্টের হত্যাযজ্ঞ ছাত্র ও বিএনপি–জামায়াত পরিচালনা করেছে। তাঁরা আয়নাঘরকেও স্বীকার করতে চান না। তাঁরা সত্যকে আড়াল করার পাশাপাশি মিথ্যা তথ্য প্রচার করছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁরা নিজেদের মিলাতে পারছেন না। তাঁদের সামনে আরও কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ল ই আগস ট র ম নবত ব র ধ র জন য ধরন র করছ ন অপর ধ আওয় ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে গুরুত্ব আরোপ

কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কার্যত সামরিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। এ পরস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ফোন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। বুধবার দুজনকে করা এ ফোন কলে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনা কমানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এছাড়া দুই 

ফোনালাপের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে দেওয়া পৃথক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় মার্কো রুবিও বলেন, তিনি পেহেলগাম হামলায় নিহতদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

তবে তিনি আরও বলেন, ভারত যেন পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করার আগে সতর্ক থাকে, কারণ এখনও পর্যন্ত ভারত এই হামলায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার কোনও প্রমাণ প্রকাশ করেনি।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক বিবৃতিতে বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণহানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা কমাতে এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করার জন্য বলেছেন।

পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে ফোনালাপে রুবিও- ২২ এপ্রিল ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পর্যটন কেন্দ্র পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রুবিও এই অযৌক্তিক হামলার তদন্তে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ বলেন, ভারতের উস্কানিমূলক আচরণ শুধু উত্তেজনাই বাড়াচ্ছে এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টাকে বিভ্রান্ত করছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ভারতের ওপর দায়িত্বশীল আচরণ ও ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাপ প্রয়োগ করে।

এর আগে গত ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেলে কাশ্মীরের পেহেলগাম জেলার বৈসরণ তৃণভূমিতে বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন, যাদের প্রায় সবাই পর্যটক। হামলার দায় স্বীকার করে রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট নামে একটি সংগঠন। এটিকে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়্যেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করা হয়।

এ ঘটনায় আরও বেশ কয়েকজনকে আহত হন। যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তারা সবাই পুরুষ। বস্তুত, ২২ এপ্রিলের হামলা ছিল ২০১৯ সালের পুলোয়ামা হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী হামলা। বর্তমানে এ ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।

পেহেলগামের ভয়াবহ ওই হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। জবাবে সিমলা চুক্তি স্থগিত ও ভারতীয় বিমানের জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধের ঘোষণা দেয় পাকিস্তান।

তাছাড়া, হামলার পরে দুই দেশই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। সূত্র-এএফপি 

সম্পর্কিত নিবন্ধ