বাংলাদেশে ৪০টিরও বেশি ভাষার অস্তিত্ব থাকলেও অনেক নৃগোষ্ঠী ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বায়ন, নগরায়ণ ও মাতৃভাষায় শিক্ষার অভাবের কারণে ভাষাগত বৈচিত্র্য সংকটের মুখে পড়ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভাষা সংরক্ষণে গুরুত্ব দিচ্ছে, তবে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি।

শনিবার রাজধানীর মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘বহুভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তারা এ সব কথা বলেন। ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আসাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন, বিশেষ অতিথি হিসেবে ইউনেস্কো ঢাকা অফিসের প্রধান সুসান ভাইস বক্তব্য রাখেন। সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইনস্টিটিউটের অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম।

পররাষ্ট্রসচিব জসীম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ শুধু একটি ভাষার আবাসস্থল নয়, বরং এখানে ৩৫টিরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা রয়েছে। প্রতিটি ভাষাই জাতির সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে অবদান রাখে। বহুভাষা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বহুত্ববাদী সমাজের ভিত্তি তৈরি করে। যখন একাধিক ভাষা সহাবস্থান করে, প্রতিটি ভাষা তার সাথে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্পরচনা, লোককাহিনী বহন করে যা অন্যদের সমৃদ্ধ করে।

তিনি বলেন, তবে বিশ্বায়ন, নগরায়ণ এবং মাতৃভাষায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব বিশ্বব্যাপী অনেক ভাষার পতনের দিকে পরিচালিত করেছে। আমাদের এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে যা বহুভাষা এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা করে।  

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের বিভিন্ন ভাষার স্বীকৃতি এবং সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যাতে তাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বহুভাষিকতা প্রচার, বিপন্ন ভাষা সংরক্ষণ এবং এমন একটি পরিবেশ তৈরির উপর জোর দিচ্ছে যেখানে ভাষাগত বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা হয়।  

পররাষ্ট্রসচিব বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান সব সাংস্কৃতিক পরিচয়কে সম্মান করে এমন ধারণাকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।  

সুসান ভাইস বলেন, ভাষা সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখার এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষায় পাঠদান করা হলে এটি শেখার ফলাফলকে শক্তিশালী করে। পাশাপাশি বহু ভাষা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া এবং সামাজিক সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও সহায়তা করে।

তিনি বলেন, নৃতাত্ত্বিক ভাষাগুলো সে জাতিগোষ্ঠীর প্রকৃতি, চিকিৎসা, ঐতিহ্য এবং অন্যান্য জিনিস সম্পর্কে অনন্য জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করে। এগুলো ছাড়া তারা ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের কিছু অংশ হারাবে। তাই ভাষাতাত্ত্বিক ভাষাগত বৈচিত্র্য রক্ষা করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রত্যেকের জন্য তাদের মাতৃভাষা ব্যবহার করা এবং সেই ভাষাতেই কথা বলা সঠিক। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সরকার নৃগোষ্ঠীদের ভাষায় পাঠদান চালু করেছে। তবে দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে এখানে।  

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে ৫০ টিরও বেশি জাতিগত গোষ্ঠী এবং ৪০ টিরও বেশি ভাষা রয়েছে। এই দেশের অনেক মানুষ বহুভাষিক। একটি বহুভাষিক সমাজ বা বিশ্বের অন্ধকার দিক হলো এতে একটি ভাষার প্রাধান্য বা আধিপত্য থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং নৃগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষই এই বাস্তবতার মধ্যে বাস করে।

তিনি বলেন, এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে তাদের নিজস্ব ভাষা বাংলা ভাষা তৈরি করতে বাধ্য, এবং এটি ভাষাগত বিপন্নতার দিকে অবদান রাখছে। এখানকার কিছু ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছু বিভিন্ন মাত্রায় বিপন্ন, আমাদের এই পরিস্থিতির বিপরীতে যেতে হবে এবং ভাষাগত ও সামাজিক বৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার করতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকে আমরা সব ভাষাকে নথিভুক্ত করা, পুনরুজ্জীবিত করা এবং প্রচার করার কাজটি করছি।

দিনব্যাপী সেমিনারটিতে চারটি অংশে চারটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এতে ‘বহুভাষা ও আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ’ নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন ডেভিড এ পিটারসন, ‘ভাষাগত বৈচিত্র্যের দেশে বহুভাষা’ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড.

এ এম সাজ্জাদুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ইবরাহিম হোসেন ‘বহুভাষা ও আন্তঃসাংস্কৃতিক শ্রেণিকক্ষে ইংরেজি পাঠদান’ বিষয়ে এবং একই ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. ফারজানা ইয়াসমিন চৌধুরী ‘সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রসারে বহুভাষার ভূমিকা’ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ ষ গত ব চ ত র য প রবন ধ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ