নতুন দলের সাফল্য নির্ভর করবে নতুন রাজনীতিতে
Published: 1st, March 2025 GMT
অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে জন্ম নিল নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। নেতৃত্বে রয়েছে তরুণ বয়সীরা। আমরা যারা স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে-পরে জন্ম নিয়েছি, তাদের সন্তানরাই আছে এই দলে। যে কাজগুলো দেশের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা আমাদের প্রজন্ম করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই কাজগুলো করার ভার তাদের ওপর। ইতোমধ্যে তারা তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি দেখাতে পেরেছে। তাদের বয়সী দেশের সব শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও আমজনতাকে রাজপথের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে তারা ১৬ বছর ধরে জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারকে সফলভাবে হটিয়েছে। এখন রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিতে তারা এনসিপি গঠন করেছে।
বাংলাদেশে শুধু রাজনীতিতেই পরিবারতন্ত্র আছে, তা নয়। দুর্নীতিতেও যে পরিবারতন্ত্র প্রকটভাবে বিরাজমান, সেটা ১/১১-তে প্রথমবারের মতো সুস্পষ্ট হয়েছিল। পরে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে পরিবারতন্ত্রের ব্যাপকতা সবার নজরে আসে।
এনসিপি নেতৃত্বে যারা আছেন, যারা এতে ইতোমধ্যে যোগ দিয়েছে এবং আগামীতে যোগ দেবে, তাদের প্রথম লড়াইটা করতে হবে নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। আমি আগেই বলেছি তরুণদের এই রাজনৈতিক দলে যারা থাকবে, তাদের পিতামাতারা আমাদের প্রজন্মের। আমাদের প্রজন্মের মানুষ ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের সব সরকারি দপ্তরের শীর্ষ কিংবা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে বসে গেছে। এমনকি অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বেও পারিবারিক সূত্রে আমাদের বয়সীরা ইতোমধ্যে চলে এসেছে।
আমরা অতীতে আরও লক্ষ্য করেছি দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের ব্যানারে বিভিন্ন পেশাজীবী ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংগঠন তৈরি হয়। সেই সংগঠনের নেতৃত্বে থাকে রাজনৈতিক দলের নেতাদের আত্মীয়স্বজন ও আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিরা। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে ভোটাভুটি হয় ঠিকই কিন্তু ক্ষমতায় থাকে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্টরা। নতুন দলকে এই জায়গাতেও লড়াইটা করতে হবে। তাদের পরিবারে যে মেধাবী ও সুযোগসন্ধানী আত্মীয়স্বজন রয়েছে, তারা তাদেরকে ব্যবহার করে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের’ দিকে যেতে চাইবে। কারণ এটিই আমরা, আমাদের সংস্কৃতি।
ব্যক্তিগত লোভ মোকাবিলা করার পাশাপাশি নতুন দলকে দলীয়ভাবে লুটপাটে লিপ্ত হওয়ার প্রবণতাও ঠেকাতে পারতে হবে। দলীয়ভাবে লুটপাট অন্য অনেক কিছুর আড়ালে করা হয়। তার একটি হলো, দেশের জনগণকে বিভক্ত করা। এ প্রেক্ষাপটে নতুন দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি হলো, বাংলাদেশপন্থি হতে চাওয়া।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতির বড় বড় শক্তি তাদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে বিভক্তির রাজনীতি করে আসছে। সেখানে ভারত ও পাকিস্তান ইস্যু ছিল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল মাত্র। তবে ২০১৪ সালের বিতর্কিত দশম জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো ভারতকে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে জনগণ ভোট দিতে পারেনি, নতুন দলের নেতাকর্মীও রয়েছেন এ ভোটাধিকারবঞ্চিতদের মধ্যে। ফলে এটি প্রত্যাশিত ছিল যে তারা এমন কিছু ঘোষণা করবেন, যা ‘শেখ হাসিনা’ তৈরির পথ বন্ধ করবে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব আশঙ্কার অবসান ঘটানোর কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তারা এটিও বলেছেন, বাংলাদেশকে বিভাজিত করা যাবে না।এটি আশাজাগানিয়া। এর মধ্য দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির সূচনার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
নতুন দলের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো, তাদের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে তারা কী করবেন এবং কীভাবে করবেন, তা সুস্পষ্ট করা। আমরা জানি, বাংলাদেশের মাটিতে ইচ্ছা ও স্বপ্ন এবং তার বাস্তবায়নের মধ্যে বিরাট পার্থক্য থাকে। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে। কিছু চ্যালেঞ্জের কথা আমি ওপরে বলেছি। আরও চারটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমটি হলো, শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে চুরমার হওয়া প্রাতিষ্ঠানিকতা ও তার বিপরীতে গড়ে ওঠা ব্যক্তিকেন্দ্রিক সিস্টেমকে কীভাবে ভেঙে দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ফিরিয়ে আনা হবে– সেই বিষয়টি নতুন দল এনসিপিকে সুস্পষ্ট করতে হবে। দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জটি হলো, ৫৪ বছর ধরে ইটপাথরের উন্নয়নের যে ভুল ধারণা গণমানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, সেই ভুল বয়ান পরিবর্তন করা এবং প্রকৃত উন্নয়ন যে ‘সুশাসন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জীবনমানের উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিকতা’, এর প্রতি তাদের সমর্থন আদায় করা। তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো, দেশের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগকে যার যার কর্মক্ষেত্রের পরিধির মধ্যে ফেরত পাঠানো। চতুর্থ ও শেষ বড় চ্যালেঞ্জটি হলো, স্থানীয় সরকারের সব কার্যক্রম থেকে সংসদ সদস্যদের বিচ্ছিন্ন করা এবং সংসদ সদস্য পদে আইন প্রণয়নে নিবেদিত হবে, কোনো ধরনের ক্ষমতা ও অর্থের লোভে আক্রান্ত হবে না– এমন ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া নিশ্চিত করার দাবি তোলা ও আদায় করা।
যারা নতুন দলের নেতাদের বয়স নিয়ে কথা বলছেন, তাদের ১৯৫২ থেকে বাংলাদেশিদের স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাজনীতি এবং তৎপরবর্তী ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের বয়স জানার জন্য বলব। যারা এনসিপি-কে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বি টিম বা সি টিম হিসেবে আখ্যায়িত করছেন, তাদেরকে এই নতুন দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা থেকে বিরত থাকার কথা বলব।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দলের সাফল্য কামনা করি দু’ভাবে। এক.
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ব রতন ত র দ র বয়স দল র স আম দ র ন র জন পর ব র এনস প সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।