দীর্ঘ সতেরো বছর পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হতে হলো রেমান মাহিরকে। বিতাড়িত অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে রেমানও একজন। বেশ থিতু হয়ে গিয়েছিল ও। ভিজিট ভিসায় এসে আর ফেরেনি দেশে। ইংরেজি সাহিত্যে পড়া বাংলাদেশের একসময়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও কবি। ডাকসু ইলেকশনে বিপুল ভোটে জয়ী সাংস্কৃতিক সম্পাদক। মেয়েদের ভোটই বেশি পড়ত। বিরোধী দলের মেয়েরাও রেমানকে প্রকাশ্যে সমর্থন করত। সবার তালে তালে স্লোগান দিত:
‘দিকে দিকে একি শুনি
রেমান ভায়ের জয়ধ্বনি।’
দুষ্টু মেয়েরা যারা রেমানের প্রেমে পাগল তারা রুমের ভেতর হাত ধরাধরি করে স্লোগান তুলত:
‘হুহুম হুহুম হুম্মা
রেমানকে দিই চুম্মা’—এই বলে হেসে গড়িয়ে পড়ত একে অন্যের গায়ে। ওদের কেউ বলত ‘চল, মেইন বিল্ডিংয়ের ৫০৮ নম্বরের ডোরা আপাকে চুল ধরে টেনে নিয়ে পাঁচতলা থেকে নিচে ফেলে দিইগে।’ বলা বাহুল্য রেমান আর ডোরা তখন খুব জনপ্রিয় জুটি। রেমানকে লাইব্রেরিতে বেশির ভাগ সময় পাওয়া যেত। ছাত্ররাজনীতি আর বই পড়া ছিল তার নেশা।
সেসব অনেক দিন আগের কথা। রাজনীতি করার জন্য রেমানের সঙ্গে ডোরার বিয়েতে রাজি হয়নি তার পরিবার। রেমান তখন চব্বিশ ঘণ্টা রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই করত না। অন্যদিকে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ অর্থাৎ এক তরুণ উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ডোরার বিয়ে হয়ে যায়। রেমান বেপরোয়াভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে, রেমান আর বিয়েই করেনি; কেউ বলে, আরে না, করেছিল কিন্তু টেকেনি। বেশ পরে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলে বিরোধী দলের প্রভাবশালী প্রার্থীর জীবননাশের হুমকি মাথায় নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যায় রেমান। প্রথম দিকে ট্যাক্সি চালাত আর একটা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিল। দুটো সম্পর্কে জড়িয়েছিল। একটা ৯ মাসের মাথায় শেষ হয়, আরেকটা ছিল বছর পাঁচেক। পাঁচ বছর যার সঙ্গে ছিল, সে মেয়েটি একসময় লাইব্রেরিতে পার্টটাইম কাজ করত। আলবেনিয়ান আমেরিকান। মেয়েটি কবিতা লিখত। সে রেমানকে বিয়ে করার অনুরোধ করেছিল, কিন্তু রেমান রাজি হয়নি। রাজি হলে উদ্বাস্তুর মতো অবৈধভাবে আর আমেরিকায় থাকা লাগত না, এবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ঘাড়ধাক্কায় নিজের দেশে ফিরেও আসতে হতো না। অবশ্য চিরদিনের উড়নচণ্ডী রেমান মাহিরের বুকের মধ্যে নিজের দেশ, নিজের জনপদ, মানুষ কোনো দিন ম্লান হয়নি। তাই না খেদালেও দেশের রাজনীতির অনুকূল পরিবেশে রেমান এমনিতেই ফিরে আসত। ও কি আসলে ডোরাকে ভুলতে পেরেছিল? কিংবা ডোরা টোরা ওর অন্য আরও অনেক প্রেমিকার মতোই কিছুদিনের মোহ ছিল, কে জানে!
জনা পাঁচেক বন্ধু দুজন ছাত্ররাজনীতিক নিয়ে একগোছা রজনীগন্ধা হাতে বিমানবন্দরে এসেছিল। রেমান অনেক দিন পর বন্ধুদের পেয়ে খুব আবেগবিহ্বল হয়ে উঠল। কচিকাঁচা দুটো পাকা বুড়োদের মতো শুরু করল, ‘রেমান ভাই, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপনার মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ আশু প্রয়োজন। প্রতিবাদ–প্রতিশোধের আগুন আপনার চেতনায় নিশ্চয়ই আজও প্রজ্বলিত। আমাদের দেশ, আমাদের নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আপনার আগমনকে দুহাত প্রসারিত করে স্বাগত জানায়।’
তরুণদের কথায় মুগ্ধ হয় রেমান। তাদের সময়ে এত চমৎকার করে কথা বলতে পারা ছেলেমেয়ে ছিল বিরল।
‘আমি কিছুদিন বিশ্রাম নিতে চাই। পরে তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। আগে একটু থিতু হয়ে নিই। সবকিছু বুঝে উঠতে আমার সময় লাগবে’, বলে ওদের দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করল রেমান।
‘আপনি চাইলে ঢাকা শহরে সম্মানের সঙ্গে আপনার থাকার বন্দোবস্ত আমরা করতে পারি’, বিনয়ের সঙ্গে বলল ছেলেগুলো।
‘না তার দরকার হবে না। প্রথম কয়েক দিন হোটেলে থেকে একটা বাসা খুঁজে নেব। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখন আমার। কিন্তু বন্ধুরা তো আছে’, বলে বন্ধুদের ঘাড়ে হাত রাখল রেমান।
বন্ধুদের নিয়ে রেমান একটা ভালো এলাকায় মানসম্পন্ন বাসা খুঁজতে শুরু করল। পুরোনোগুলো একটু কমে পাওয়া যায়, কিন্তু অপেক্ষাকৃত নতুনগুলো ৫০ হাজারের নিচে ভাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পেপারে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে বের হয়। ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের বর্ণনা ও ভিডিওতে যেমন দেখায়, সরেজমিনে দেখার সময় মোটেও তেমন লাগে না। তবু শেষ পর্যন্ত বন্ধু জাহিদের পরামর্শে বনানীতে একটা বাসা মোটামুটি পছন্দ হলো রেমানের। পরদিন সকালে চা খেতে খেতে অভ্যাসবশত পেপারে চোখ বোলাচ্ছিল সে। ইদানীং ‘স্বল্পমূল্যে ফ্ল্যাট বিক্রয় হইবে’ খুব চোখে পড়ে। রেমানকে ওর রাজনীতির একই ঘরানার বন্ধু সোহেল বলছিল, ‘দোস্ত, কিয়ের ভাড়াভুড়া? দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ন্যাতাগো বাড়ি ফার্নিচারসহ কম দামে বিক্রি হইতেছে। তর কাছে ট্যাকা–টুকা থাকলে চল ওগলাই দেহি গিয়া।’ রেমান ভাবল, সোহেল মন্দ বলেনি। দেখা যেতেই পারে।
রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা মিটিংও সেরে ফেলেছে রেমান। নেতাদের সঙ্গে দেখা করলে তারা জাতীয় নির্বাচনে তাকে প্রার্থী করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা সব কোত্থেকে যেন উদয় হলো। উদীয়মান তরুণ রাজনীতিকেরা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণে তাকে নতুন দেশ গড়ার অঙ্গীকারে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে লাগল। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দীর্ঘদিন বাস করার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করতে লাগল। রেমানের যে এসব খুব ভালো লাগছিল, তা-ও নয়। সে তার প্রিয় ক্যাম্পাসে, অনেক স্মৃতির হলের মাঠে, লাইব্রেরির সামনে, টিএসসিতে ঘুরে বেড়াল। ছাত্রী হলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যেখানকার উঁচু ফুটপাতে পা নামিয়ে বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে ডোরার পাশে বসে থাকত। খসে পড়া ছাতিমের পাতা স্যান্ডেলের নিচে ঘষত ডোরা। কী এক অনিশ্চয়তা ছিল যেন ওর কম্পিত পায়ে! কখনো ডুরে তাঁতের শাড়ির পা জড়িয়ে থাকা পাড় সরে গেলে রেমান বলে উঠত:
‘এইখানে বসা যাক তবে, এইখানে
এসো সরে এসো বাবলার নিরেট নির্জনে
সম্রাজ্ঞী, শাসন করো দেশ, এই বুক তোমারি স্বদেশ’।
ফেলে আসা শীতের শুকনো বনাঞ্চলে বর্ষার পর যেমন পত্রপল্লবে চারপাশ ঘন হয়ে আসে, রেমানের কাছে ওর প্রিয় ক্যাম্পাসকে তেমন বুজে আসা বনভূমি মনে হচ্ছিল। কেমন আলোহীন, দুঃখিত, আটপৌরে। যেন এখনকার অবগুণ্ঠিত তরুণীদের মতোই।
তবে রেমানের সবচেয়ে ভালো লাগল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সুপরিসর অঙ্গন, প্রথমা, বাতিঘর, পাঠক সমাবেশসহ ছোট–বড় লাইব্রেরি আর কবিদের আড্ডা। বইও কিনে ফেলেছে বেশ কিছু। নিজের একটা থাকার জায়গা হলে ও আবার লেখালেখিতে ফিরতে চায়।
সোহেলকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ল রেমান বাসা দেখার উদ্দেশ্যে। ‘স্বল্পমূল্যে ফ্ল্যাট বিক্রয় হইবে’–এর বিজ্ঞাপন অনুযায়ী প্রথমে গেল বনানীতে। বেশ কয়েকটা দেখল। দাম শুনে রেমানের ফ্ল্যাট কেনার আগ্রহ ক্রমশ অপস্রিয়মাণ হতে থাকল। তা ছাড়া অত বিশাল আয়তনের ফ্ল্যাট দিয়ে রেমান করবেটা কী? সোহেলের কি ধারণা আমেরিকা থেকে ও লাখ লাখ ডলার নিয়ে এসেছে? একটা বিল্ডিংয়ের দারোয়ান তো বলেই দিল, ‘স্যার, এহনই এই কাম কইরেন না। দালালরা নতুন ব্যবসা ফাইন্দা বইছে। রাজনীতির শ্যাষ কতা বইলা কিছু নাই। মালিক আইয়া পড়লে তহন আম–ছালা দুইই যাইবোগা।’
শেষ পর্যন্ত বসুন্ধরার একটা মাঝারি মাপের ফ্ল্যাট দেখার জন্য যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ছয়তলা বিল্ডিংয়ের চারতলায় এক ইউনিটের একটা বাসা। অনেকক্ষণ ধরে মাগরিবের নামাজ পড়ে কমলা রঙের দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে দারোয়ান বলল, ‘ফেলাট দেইখা যাইতে পারেন। পছন্দ হইলে মালিকের ভাইগ্নার সাতে কথা বইলেন।’
‘মালিক কোথায়?’
‘স্যারে পরিবার লইয়া বিদ্যাশ চইলা গেছে।’
‘যদি চলে আসেন?’
‘হের কি একটা ফেলাট?
লিফটে উঠতে উঠতে আরও জানতে পারল, ফ্ল্যাটটা পুরো আসবাবে সাজানো ছিল। মালিকের ভাগনে প্রায় সবই নিয়ে গেছে। তাই দামও একটু কম। দারোয়ান দরজা খুলে দুটো কম পাওয়ারের আলো জ্বেলে দিল। বাসাটা মুহূর্তে কেমন ভৌতিক হয়ে উঠল। বদ্ধ ঘরের ঠিক ভ্যাপসা গন্ধ নয়, কেমন যেন একটা সাজানো সংসারের মাদকতাপূর্ণ আবহ। তিন কক্ষের সঙ্গে তিনটি বারান্দা। প্রশস্ত লিভিং সঙ্গে ডাইনিং। কম দামে খোলামেলা বাসাটা দেখে সোহেল দারোয়ানের সঙ্গেই দর–কষাকষি শুরু করে দিল। রেমান দেখল, বাসার ভেতর থাকার মধ্যে দুই দেয়ালে দুটো জলরঙের ছবি। কোনো ভালো শিল্পীর আঁকা বলে ওর মনে হলো না। আর একটা শোবার ঘরে ছোট একটা খোলা বুকশেলফ। ধূলিধূসর। বেশ কিছু বই অগোছালো, স্তূপীকৃত। একমাত্র বইগুলোই এ বাসার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় বলে ফেলে রেখে গেছে মালিকের ভাগনে।
ফুঁ দিয়ে দিয়ে ধুলো সরাল রেমান। একটা মলাটওয়ালা বই তুলে নিয়ে ঝাপসা আলোর নিচে গিয়ে দাঁড়াল। মলাট ওল্টাতেই দেখল, ওটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। উপহার হিসেবে যাকে বইটা দেওয়া হয়েছিল, তার উদ্দেশ্যে ওই পাতার নিচের দিকে দুটো লাইন:
‘একজনমের শত্রু তুমি বৈঁচি বালিকা
খুঁজছি তোমাকেই বন থেকে বনান্তে…’
রেমান প্রায়ান্ধকারে বই হাতে একাকী ঝুলবারান্দায় দিয়ে দাঁড়াল। রেলিংয়ে এমন আলতো করে হাত রাখল যেন ওর হাতের নিচে রাখা কোনো হাত সরে না যায়। হাত ওভাবেই স্থির রেখে ‘একজনমের শত্রু’ কবিতাটা সে পুরো ত্রিশ লাইন মুখস্থ পড়ে গেল। ধীরে, নিমোচ্চারণে। ওর নিজের লেখা প্রিয় কবিতার মধ্যে ওটা ওর প্রিয়তর।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন ধ দ র র জন ত ক র র জন আম র ক র একট আপন র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।