ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যান্য বিতর্কিত নীতির মতো শুল্কনীতিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে নতুনভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ। ট্রাম্প ইতিমধ্যে কানাডার ওপর চীনের চেয়েও বেশি শুল্ক আরোপ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ইউরোপ, চীনসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করবেন, যাতে মার্কিন শিল্পকারখানা আবারও চাঙা হয় এবং ‘আমেরিকাকে আবার মহান’ করে তোলা যায়।

কিন্তু বাস্তবে এই শুল্কনীতি ট্রাম্পের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে এর প্রভাব মার্কিন ডলারের ওপর পড়বে বলে মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন খরচ ইউরোপের তুলনায় অনেক বেশি। আর এশিয়ার তুলনায় তো তা আরও অনেক গুণ বেশি। ফলে ট্রাম্পের শুল্ক ও শুল্ক আরোপের হুমকি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে তুলবে। এর পাশাপাশি এটি নতুন করে মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়ানোর (ডলার স্ট্রেনদেনিং) চক্র শুরু করতে পারে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থায় মার্কিন ডলারই প্রধান মুদ্রা হিসেবে আধিপত্য ধরে রেখেছে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ওপর সুদ প্রত্যাশা আরও বাড়ে, তাহলে ডলারের মূল্য আরও বেড়ে যাবে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি বিশ্বব্যাপী ডলারের প্রভাব ও স্থিতিশীলতাকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

ট্রাম্প এখন ক্রমেই বুঝতে পারছেন এই আর্থিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা তাঁর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন, যারা ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রা গ্রহণের চেষ্টা করছে। বিশেষত, যারা রাশিয়া ও চীন-সমর্থিত ব্রিকস জোটকে গ্রহণ করতে চায়, তাদের জন্য তিনি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

ট্রাম্প কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন করতে চান না, বরং তিনি ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থার নতুন নিয়ম’ প্রণয়ন করতেও সচেষ্ট।

সহজভাবে বললে, তিনি এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করতে চান, যেখানে মার্কিন ডলার অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কিছুটা দুর্বল অবস্থানে থাকবে; তবে তা আন্তর্জাতিক লেনদেনে ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সিকিউরিটিজের ক্ষেত্রে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা হারাবে না।

এই লক্ষ্য পূরণে ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে নতুন মুদ্রা স্থিতিশীলতা চুক্তি (ডলার স্ট্যাবিলাইজেশন ডিলস) করার কথা ভাবছে। ১৯৮০-এর দশকে রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসন একই ধরনের দুটি চুক্তি করেছিল। তার একটি হলো ‘প্লাজা অ্যাকর্ড’; আরেকটি হলো ‘ল্যুভর অ্যাকর্ড’।

এখন অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একটি আলোচনার বিষয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসন কি ‘মার-আ-লাগো অ্যাকর্ড’ নামে নতুন কোনো সমঝোতা করার চেষ্টা করছে? তবে এই ধরনের সমঝোতা করা এখন আগের চেয়ে অনেক কঠিন হবে। রিগ্যান আমলের চুক্তিগুলোতে মূল লক্ষ্য ছিল জাপান। কিন্তু এখন ট্রাম্পের লক্ষ্য হবে চীন। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল, জাপানি ইয়েনের দুর্বলতা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য হুমকি, তাই তারা ইয়েনের মূল্য বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু সেই সময় জাপান যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, ফলে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়নি।

কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। চীন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র নয় এবং এই ধরনের আলোচনায় আগ্রহীও নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯৮০-এর দশকের ওই চুক্তিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে চীনের গভীর শঙ্কা রয়েছে।

বাণিজ্যসংক্রান্ত চুক্তি হোক বা না হোক, ট্রাম্প এই আর্থিক ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চান, যাতে তিনি বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ছাড় আদায় করতে পারেন এবং তাঁর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এখন তাঁর হুমকির মুখে রয়েছে। এটি শুল্ক বৃদ্ধির চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে।

এর একটি উদাহরণ পাওয়া গেছে গত জানুয়ারির শেষ দিকে। ওই সময় ট্রাম্প কলম্বিয়াকে হুমকি দেন, যদি তারা সামরিক বিমানে করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত অভিবাসীদের গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের ওপর ‘ট্রেজারি, ব্যাংকিং ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়া হবে।

এ ধরনের হুমকি কেবল শুল্ক বৃদ্ধির চেয়েও বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। কারণ, মার্কিন ডলার, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড এবং বৃহত্তর আর্থিক ব্যবস্থার ওপর বিশ্ব অর্থনীতির নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। যদি ট্রাম্প এই অস্ত্র ব্যবহার করতে থাকেন, তাহলে এটি বহু দেশের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নিজের মিত্রদের বিরুদ্ধেই এই ধরনের কৌশল প্রয়োগ করার মানে হলো, তারা চীনের বিরুদ্ধে কোনো আলোচনায় গেলে নিজেদের অর্থনৈতিক সমর্থন হারাবে। বেইজিং ও ডলার-নির্ভরতা কমানোর সমর্থকেরা এই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ ও মিত্রদের বিরুদ্ধে ভূখণ্ড দখলের হুমকি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কই দুর্বল করছে না, বরং ডলারভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে।

ট্রাম্প আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের যে চেষ্টা করছেন, তা মূলত বেইজিংকে লক্ষ্য করেই করা হলেও তাঁর এই কৌশল যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংযোগ ধ্বংস করতে পারে।

যদি ট্রাম্প তাঁর এই নীতিতে সফল হন, তাহলে এতে কিছু সুবিধা মিলতে পারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতের জন্য। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ দশমিক ২ দশমিক আসে উৎপাদন খাত থেকে, যা বাড়লে তার সমর্থকগোষ্ঠী তা ভালোভাবেই গ্রহণ করবে। কিন্তু এর বিপরীতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো এই কৌশল ডলার ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। যদি তা ঘটে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য এটি বিপর্যয়কর হবে। এতে শুধু ব্যাপক মূল্যস্ফীতি হবে না, বরং ভয়াবহ মন্দাও দেখা দিতে পারে।

ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক এবং ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর থ ক ব যবস থ শ ল ক আর প র জন য দ র বল র ওপর ধরন র সমর থ গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ