ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যান্য বিতর্কিত নীতির মতো শুল্কনীতিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে নতুনভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ। ট্রাম্প ইতিমধ্যে কানাডার ওপর চীনের চেয়েও বেশি শুল্ক আরোপ করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ইউরোপ, চীনসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করবেন, যাতে মার্কিন শিল্পকারখানা আবারও চাঙা হয় এবং ‘আমেরিকাকে আবার মহান’ করে তোলা যায়।

কিন্তু বাস্তবে এই শুল্কনীতি ট্রাম্পের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে এর প্রভাব মার্কিন ডলারের ওপর পড়বে বলে মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন খরচ ইউরোপের তুলনায় অনেক বেশি। আর এশিয়ার তুলনায় তো তা আরও অনেক গুণ বেশি। ফলে ট্রাম্পের শুল্ক ও শুল্ক আরোপের হুমকি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে তুলবে। এর পাশাপাশি এটি নতুন করে মার্কিন ডলারের মূল্য বাড়ানোর (ডলার স্ট্রেনদেনিং) চক্র শুরু করতে পারে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থায় মার্কিন ডলারই প্রধান মুদ্রা হিসেবে আধিপত্য ধরে রেখেছে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ওপর সুদ প্রত্যাশা আরও বাড়ে, তাহলে ডলারের মূল্য আরও বেড়ে যাবে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি বিশ্বব্যাপী ডলারের প্রভাব ও স্থিতিশীলতাকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

ট্রাম্প এখন ক্রমেই বুঝতে পারছেন এই আর্থিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা তাঁর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিচ্ছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন, যারা ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রা গ্রহণের চেষ্টা করছে। বিশেষত, যারা রাশিয়া ও চীন-সমর্থিত ব্রিকস জোটকে গ্রহণ করতে চায়, তাদের জন্য তিনি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

ট্রাম্প কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন করতে চান না, বরং তিনি ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাব্যবস্থার নতুন নিয়ম’ প্রণয়ন করতেও সচেষ্ট।

সহজভাবে বললে, তিনি এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করতে চান, যেখানে মার্কিন ডলার অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় কিছুটা দুর্বল অবস্থানে থাকবে; তবে তা আন্তর্জাতিক লেনদেনে ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সিকিউরিটিজের ক্ষেত্রে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা হারাবে না।

এই লক্ষ্য পূরণে ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে নতুন মুদ্রা স্থিতিশীলতা চুক্তি (ডলার স্ট্যাবিলাইজেশন ডিলস) করার কথা ভাবছে। ১৯৮০-এর দশকে রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসন একই ধরনের দুটি চুক্তি করেছিল। তার একটি হলো ‘প্লাজা অ্যাকর্ড’; আরেকটি হলো ‘ল্যুভর অ্যাকর্ড’।

এখন অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একটি আলোচনার বিষয় হলো, ট্রাম্প প্রশাসন কি ‘মার-আ-লাগো অ্যাকর্ড’ নামে নতুন কোনো সমঝোতা করার চেষ্টা করছে? তবে এই ধরনের সমঝোতা করা এখন আগের চেয়ে অনেক কঠিন হবে। রিগ্যান আমলের চুক্তিগুলোতে মূল লক্ষ্য ছিল জাপান। কিন্তু এখন ট্রাম্পের লক্ষ্য হবে চীন। ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল, জাপানি ইয়েনের দুর্বলতা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য হুমকি, তাই তারা ইয়েনের মূল্য বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু সেই সময় জাপান যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, ফলে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়নি।

কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। চীন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র নয় এবং এই ধরনের আলোচনায় আগ্রহীও নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ১৯৮০-এর দশকের ওই চুক্তিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে চীনের গভীর শঙ্কা রয়েছে।

বাণিজ্যসংক্রান্ত চুক্তি হোক বা না হোক, ট্রাম্প এই আর্থিক ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চান, যাতে তিনি বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ছাড় আদায় করতে পারেন এবং তাঁর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণ করতে পারেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এখন তাঁর হুমকির মুখে রয়েছে। এটি শুল্ক বৃদ্ধির চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে।

এর একটি উদাহরণ পাওয়া গেছে গত জানুয়ারির শেষ দিকে। ওই সময় ট্রাম্প কলম্বিয়াকে হুমকি দেন, যদি তারা সামরিক বিমানে করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত অভিবাসীদের গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের ওপর ‘ট্রেজারি, ব্যাংকিং ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা’ দেওয়া হবে।

এ ধরনের হুমকি কেবল শুল্ক বৃদ্ধির চেয়েও বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। কারণ, মার্কিন ডলার, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড এবং বৃহত্তর আর্থিক ব্যবস্থার ওপর বিশ্ব অর্থনীতির নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। যদি ট্রাম্প এই অস্ত্র ব্যবহার করতে থাকেন, তাহলে এটি বহু দেশের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নিজের মিত্রদের বিরুদ্ধেই এই ধরনের কৌশল প্রয়োগ করার মানে হলো, তারা চীনের বিরুদ্ধে কোনো আলোচনায় গেলে নিজেদের অর্থনৈতিক সমর্থন হারাবে। বেইজিং ও ডলার-নির্ভরতা কমানোর সমর্থকেরা এই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ ও মিত্রদের বিরুদ্ধে ভূখণ্ড দখলের হুমকি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কই দুর্বল করছে না, বরং ডলারভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে।

ট্রাম্প আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের যে চেষ্টা করছেন, তা মূলত বেইজিংকে লক্ষ্য করেই করা হলেও তাঁর এই কৌশল যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের মধ্যকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংযোগ ধ্বংস করতে পারে।

যদি ট্রাম্প তাঁর এই নীতিতে সফল হন, তাহলে এতে কিছু সুবিধা মিলতে পারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতের জন্য। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ দশমিক ২ দশমিক আসে উৎপাদন খাত থেকে, যা বাড়লে তার সমর্থকগোষ্ঠী তা ভালোভাবেই গ্রহণ করবে। কিন্তু এর বিপরীতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো এই কৌশল ডলার ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। যদি তা ঘটে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য এটি বিপর্যয়কর হবে। এতে শুধু ব্যাপক মূল্যস্ফীতি হবে না, বরং ভয়াবহ মন্দাও দেখা দিতে পারে।

ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক এবং ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আর থ ক ব যবস থ শ ল ক আর প র জন য দ র বল র ওপর ধরন র সমর থ গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

জরুরি বৈঠকে বসছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় ইসরায়েলি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি বৈঠকে বসছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) বোর্ড অব গভর্নরস। আজ সোমবার আইএইএর সদর দপ্তরে এ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। খবর বিবিসির

রাশিয়া, চীন ও ভেনেজুয়েলের সহায়তায় এবং ইরানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি বৈঠকে বসছে আইএইএ।

ইরান শুরুতে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করতে চেয়েছিল। তবে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ওই প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ফলে, ইরান এখন সাধারণ বিবৃতি দেওয়ার দিকে নজর দিয়েছে। ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে এই বিবৃতি দেওয়া হবে।

ইরান বলেছে, আইএইএ–র বোর্ড অফ গভর্নরদের অবশ্যই ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানাতে হবে। তবে এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের নিন্দা জানানোর সম্ভাবনা কম।

তবে এই বৈঠকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির পথ সুগম হবে কী না তার কোনো স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়নি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ