গণপরিষদ নির্বাচন চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি
Published: 23rd, March 2025 GMT
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা বলেছে, যে সুপারিশগুলো সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর সংবিধান–সম্পর্কিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দরকার।
রোববার দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার নিয়ে নিজেদের লিখিত মতামত জমা দেয় এনসিপি। পরে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের এ কথাগুলো জানান।
এর আগে ঐকমত্য কমিশনের কাছে মতামত দেওয়ার পর বিএনপি বলেছে, গণপরিষদ গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই। নতুন রাষ্ট্র হলে তখন গণপরিষদ গঠন করা হয় নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের বলেন, নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ প্রয়োজন—এ ধারণা সঠিক নয়। অনেক দেশে সংবিধানের বড় পরির্তনের জন্য এ রকম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি থাইল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের উদাহরণ দেন।
এনসিপি বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ৩০০ আসনে গণপরিষদ নির্বাচন চায় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সারোয়ার তুষার বলেন, জুলাই সনদ হবে। এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। সংবিধানের বড় পরিবর্তন বা সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান যেটাই হোক, এটা লিখিত হবে। তখন এ সংবিধানের প্রশ্নে নতুন সিদ্ধান্ত হতে পারে। বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করা দরকার, এটা তাঁরা আগেই বলেছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সারোয়ার তুষার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র ছিল প্রথম সংবিধান। কিন্তু ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মূলনীতি সংবিধানে নিয়ে আসা হয়। তাই বাহাত্তরের সংবিধান দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধে। বাহাত্তরের সংবিধান হচ্ছে ‘সাংবিধানিক ক্যু’।
তিন বিষয়ে উদ্বেগসারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা তিনটি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের কাছে উদ্বেগ বা প্রশ্ন রেখেছেন। প্রথমটি হলো, ছয়টি সংস্কার কমিশন অনেকগুলো সুপারিশ করেছিল। কিন্তু স্প্রেডশিটে কনসাইজ (সংক্ষিপ্ত) করে ১৬৬টি সুপারিশ রাখা হয়েছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন, এই ১৬৬ সুপারিশের সব কটি জুলাই সনদে থাকবে না, আরও সংক্ষিপ্ত হবে। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো কেন অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না, এ বিষয়ে কমিশন কী ভাবছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, ১১১টি সুপারিশ আলোচনা ছাড়াই বাস্তবায়নের কথা ভাবছে সরকার। এসব কোন প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ করা হলো, তা কমিশনের কাছে তাদের জিজ্ঞাসা ছিল। তৃতীয়ত, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রতিবেদন না পাঠানোর বিষয়টিও ঐকমত্য কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছে এনসিপি।
উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবঐকমত্য কমিশনের কাছে মতামত জমা দেওয়ার পর এনসিপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ১১৩টি সুপারিশের সঙ্গে একমত ও ২৯টির সঙ্গে আংশিকভাবে একমত হয়েছে। ২২টি সুপারিশের বিষয়ে তারা একমত হতে পারেনি।
এনসিপি বলেছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিষয়ে তাদের আপত্তি নেই, তবে এটা দাপ্তরিক ভাষা হওয়া উচিত। বাংলাদেশের নাগরিক ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবেন, এর সঙ্গে বিভিন্ন জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। মৌলিক অধিকারের মধ্যে প্রাণ, প্রকৃতির সুরক্ষা থাকা উচিত। দলের প্রার্থী মনোনয়নে ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণীকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে তারা একমত। এ ক্ষেত্রে তরুণ–তরুণীর সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর পর্যন্ত ধরা যেতে পারে। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ন্যূনতম ২৩ বছর হওয়া উচিত। ডেপুটি স্পিকার একজন হওয়া উচিত, তা বিরোধী দল থেকে।
এনসিপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার মধ্যে প্রথমজন হলে এ ক্ষেত্রে বাধা থাকবে না। তারা প্রস্তাব করেছে, অর্থ বিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে এনসিপি একমত। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের প্রার্থী কারা, তা আগেই ঘোষণা দিতে হবে।
সারোয়ার তুষার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার হবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের মেয়াদ ৭০ থেকে ৭৫ দিন হতে পারে। একটা পর্যায়ে গিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন নেই। তখন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) এ দায়িত্ব নিতে পারে। এনসিসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তা তদন্ত করতে পারে। তারা বলেছে, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জরুরি অবস্থা জারির পরিস্থিতি এলে সংসদের উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তা করতে হবে। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না।
এনসিপির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, সাধারণ নির্বাচনে কোনো দল অন্তত ১ শতাংশ ভোট পেলে তারা সংসদের উচ্চকক্ষে আসন পাবে। সংসদের উচ্চকক্ষে দলের প্রাপ্ত আসনে ৩৩ শতাংশ নির্দলীয় ব্যক্তি ও ২৫ শতাংশ নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা, উচ্চকক্ষের জন্য সর্বনিম্ন বয়স ৩৩ বছর রাখা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত না রাখার প্রস্তাব করেছে এনসিপি।
দলের মতামত জমা দেওয়ার সময় সারোয়ার তুষারের সঙ্গে এনসিপির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সদস্য মুনিরা শারমিন, জাবেদ রাশিম, আরমান হোসাইন ও সালেউদ্দিন সিফাত উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও ইফতেখারুজ্জামান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র জন য এনস প র নত ন স র বল ন মত মত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ফের এক মাস বাড়ল
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরো এক মাস বাড়িয়ে ১৫ অক্টোবর করেছে অন্তর্বর্তী সরকার ।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
আরো পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরো গভীর বাণিজ্য সম্পর্ক চায় বাংলাদেশ
সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ: আলী রীয়াজ
ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছিল ১২ ফেব্রুয়ারি, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। শুরুতে ছয় মাস মেয়াদে গঠিত সাত সদস্যের এই কমিশনের মেয়াদ ১৫ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা ছিল। তখন প্রথম ধাপে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এবার দ্বিতীয় ধাপে বাড়ানো হলো ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত।
কমিশনের কাজ হলো ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা।
নির্বাচন পদ্ধতি, সংবিধান, সরকার ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জুলাই সনদ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন। বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হলেও তা চূড়ান্ত করে সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
তবে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জরুরি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।
পূর্বাপর
রাষ্ট্র সংস্কার উদ্যোগ এগিয়ে নিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়।
এরপর ৫ মার্চ পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়।
এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার বিষয়ক ৭০টি, নির্বাচন সংস্কার বিষয়ক ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ক ২৭টি সুপারিশ ছিল।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরাসরি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ায় সেগুলো স্প্রেডশিটে রাখা হয়নি।
সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্য পাঁচটি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মোট ৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে পাঠায়, অনেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও দেয়।
মতামত গ্রহণের পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মোট ৪৪টি বৈঠক হয়। কিছু দলের সঙ্গে হয় একাধিক বৈঠক।
প্রথম পর্বের আলোচনায় ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়।
কোরবানির ঈদের আগে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা সংসদ ভবনের এলডি হলে শেষ হয়। এরপর ২ জুন দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা উদ্বোধন করে কমিশন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করে কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হয়।
আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে। ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩ দিন চলে এ আলোচনা।
সবশেষ জুলাই সনদের চূড়ান্ত সমন্বিত খসড়া মতামতের জন্য ২২ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।
পরে দল গুলোর সাথে আরেক দফা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত সনদের কপি রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হয়।
কিছুক্ষেত্রে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্টসহ) মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য হওয়ার কথা বলা হয়েছে এই চূড়ান্ত খসড়ায়। কিন্তু সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো রূপরেখা সেখানে দেওয়া হয়নি।
এখন বাস্তবায়নের পথ খুঁজতেই দলগুলোর সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করছে ঐকমত্য কমিশন।
ঢাকা/এএএম/রাসেল