শুক্রবার থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার বৈঠকের অর্জন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। আমরা মনে করি, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়ন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনার বিকল্প নেই।

বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন, তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ এসেছে। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ হয়েছে।’

অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দুই সরকারপ্রধানের বৈঠক হয়েছে বিশেষ পরিস্থিতিতে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে একধরনের টানাপোড়েন চলছিল। বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদল সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও দিল্লির নীতিনির্ধারকেরা তা মানতে পারেননি। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ও যাতায়াত জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারত পর্যটন ভিসা বন্ধ রেখেছে; মেডিকেল ভিসার ওপরও আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি।

বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার স্থলসীমান্ত ছাড়াও আছে ৫৪টি অভিন্ন নদী। মোদি সরকারের আমলে স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান হলেও অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠককে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এ কথাও মনে করি যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, তা নিরসনে একটি বা দুটি বৈঠকই যথেষ্ট নয়। সর্বস্তরে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুই সরকারপ্রধানের বৈঠকের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল আগে থেকেই। বিশেষ করে গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ঢাকা এই বৈঠকের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষ তাঁর কথার বাস্তবায়ন দেখতে চাইবে। ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা খোলাখুলি সেখানকার সাংবাদিকদের সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দিল্লির পক্ষ থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ ব্যাপারে ভারতেরও যথেষ্ট সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া ভারতে বসে শেখ হাসিনা যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, তা যে এখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে, সেটাও ভারতের নীতিনির্ধারকদের আমলে নিতে হবে।

এখানে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, মোদি বাংলাদেশে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের কথা বলেছেন। কিন্তু এর আগে বাংলাদেশে তিনটি নির্বাচনের দুটি পুরোপুরি একতরফাভাবে হলেও ভারতকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি। ভারতের এ ধরনের দ্বিমুখী অবস্থান বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।

দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল ইউনূস-মোদি বৈঠককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের মধ্যে আশার আলো দেখার কথা বলেছেন। ভারতের কূটনৈতিক মহল মনে করে, বাংলাদেশ যাতে চীন ও পাকিস্তানের প্রতি আরও ঝুঁকে না যায়, সে জন্য দিল্লির কর্তব্য হবে ঢাকাকে আস্থায় নেওয়া।

আমরা মনে করি সমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হবে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কোনোভাবেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে টেনে আনা সমীচীন নয়। দেরিতে হলেও দুই দেশের সরকারপ্রধান মুখোমুখি বসে কথা বলেছেন। নিজেদের উদ্বেগ ও প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। আশা করি, এখন বাকি কাজ উচ্চ কূটনৈতিক পর্যায়ে এগিয়ে নেওয়া হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক বল ছ ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে: হামাস

স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ার প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে হামাস। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া এক ঘোষণাপত্রের অস্ত্র ত্যাগের আহ্বানের জবাবে সংগঠনটি এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার হামাসের সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দখলদারির অবসান এবং জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ও সম্পূর্ণ সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ থামবে না তারা।

মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধে হামাসকে (এই উপত্যকায়) তার শাসনের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ ও সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। সার্বভৌম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে এটি সংগতিপূর্ণ।’

সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও মিসরসহ ১৭টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব লিগ ঘোষণাপত্রটি সমর্থন করেছে। এটি ‘দ্য নিউইয়র্ক’ ঘোষণাপত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বৃহস্পতিবার আলাদা এক বিবৃতিতে প্রতি শুক্রবার, শনিবার ও রোববার বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের মিত্র দেশগুলোর দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা।

অনাহারে মৃত্যু ১৫৪

গাজায় কর্মরত চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, উপত্যকাটিতে অনাহারে আরও দুই শিশু এবং এক তরুণ মারা গেছে। এ নিয়ে সেখানে অনাহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫৪ জনে। তাদের মধ্যে শিশু ৮৯টি।

গাজায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। উপত্যকাটিতে গত মার্চ থেকে নতুন করে অবরোধ শুরু করে ইসরায়েল। ফলে সেখানে ত্রাণবাহী কোনো ট্রাক প্রবেশ করতে পারছিল না। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি কিছুদিন ধরে গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য।

ত্রাণ নিতে প্রাণহানি ১৩৭৩

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গাজায় গত মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত ত্রাণ আনতে গিয়ে মোট ১ হাজার ৩৭৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫৯ জন মারা গেছেন বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গত মে মাসের শেষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাদের সহায়তায় গাজার কয়েকটি স্থানে ত্রাণ দিচ্ছে।

বাকি ৫১৪ জন মারা গেছেন ত্রাণবাহী ট্রাকের আশপাশে। তাঁরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অধিকাংশই ইসরায়েলের সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার সকালে গাজায় অন্তত আরও ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ত্রাণ আনতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন। এই নিয়ে প্রায় ২২ মাসের সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের হামলা নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার ৩৩২ জন।

গাজায় স্টিভ উইটকফ

শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ গাজা সফর করেছেন। তিনি উপত্যকাটির রাফা এলাকায় জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রও ঘুরে দেখেন। এ সময় ইসরায়েলে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হুকাবি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাজায় ছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে উইটকফ নিজেই এই কথা জানিয়েছেন। আগের দিন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উইটকফ বলেছেন, ‘মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে ও তথ্য সংগ্রহ করতে আমরা গাজায় গিয়েছিলাম। গাজার মানবিক পরিস্থিতির একটি স্পষ্ট ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য, যাতে করে গাজাবাসীর জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছাতে পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করা যায়।’

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ দূত ও আবাসন খাতের সাবেক আইনজীবী উইটকফের আন্তর্জাতিক নীতি ও মানবিক সহায়তা-সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তা সত্ত্বেও তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধেও কূটনীতি চালাচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ