যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিনের বহুপক্ষীয় বাণিজ্যনীতি থেকে সরে গিয়ে সম্প্রতি ‘পারস্পরিক শুল্কনীতি’ ঘোষণা করেছেন। তিনি এটিকে ‘আমেরিকান বাণিজ্যের মুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই নীতির আওতায় প্রায় সব বাণিজ্য অংশীদার দেশের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ বেজলাইন শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব দেশ, অঞ্চল ও বাণিজ্য জোটকে অন্যায্য বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আরোপকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, তাদের ৫৭টির ওপর ভিন্ন হারে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। যদিও চীন বাদে বাকিদের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ৯০ দিনের ওপর স্থগিত করা হয়েছে। তবে ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক সবার জন্য বহাল রয়েছে।
চীনের জন্য শুল্কহার বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্কহার বাড়িয়ে ১২৫ শতাংশ করেছে। বাংলাদেশের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্কহার ৩৭ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছিল। অন্যান্য প্রধান রপ্তানিকারক দেশ– ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার ওপর শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৬ থেকে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত। এসব দেশ ৯০ দিন সময় পেয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতির ওপর ভিত্তি করে সরলীকৃত সূত্র ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র শুল্কহার নির্ধারণ করেছে, যেখানে কাঠামোগত উপাদান ও প্রকৃত শুল্কহারকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয়, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতার ওপর গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে থাকা বাংলাদেশের জন্য বাড়তি শুল্ক আমদানিকারক ও ভোক্তাদের জন্য পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেবে, যা চাহিদা কমিয়ে সরাসরি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়কে হুমকির মুখে ফেলবে। এদিকে চীনের রপ্তানি অন্য বাজারে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীন ও ভিয়েতনামের অংশীদারিত্ব কমে তাদের অতিরিক্ত উৎপাদন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে– যেখানে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২১ শতাংশ বাজার দখল করে আছে। এর ফলে বিশ্ববাজারে পোশাক খাতে তীব্র মূল্য প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে পারে, যা পোশাকের দাম কমিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এর অর্থ হলো, রপ্তানির পরিমাণ স্থির থাকলেও মুনাফার মার্জিন সংকুচিত হবে, যা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের মুনাফা অর্জনের সক্ষমতা ও কর্মসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা, বাণিজ্যনীতি সংস্কার ও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের একটি সুসামঞ্জস্য কৌশল অনুসরণ করতে হবে। যদিও দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে, তবু একটি যৌথ সমঝোতার পথ খোঁজার লক্ষ্যে বাংলাদেশের উচিত অবস্থান ও প্রত্যাশা বুঝে দ্রুত সংশ্লিষ্ট মার্কিন সংস্থাগুলোর সঙ্গে কার্যকর আলোচনা শুরু করা।
সর্বজনীন ছাড় দেওয়া থেকে বিরত থেকে কৌশলগতভাবে কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো যেতে পারে, যেগুলো উৎপাদন উপযোগী যন্ত্রপাতি ও নতুন প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য হিসেবে বাংলাদেশের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে। বাংলাদেশ নিজের শুল্ক কাঠামোর সংস্কার বিবেচনায় নিতে পারে, যার অংশ হিসেবে সম্পূরক শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ধাপে ধাপে বিলুপ্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যাতে সদিচ্ছার বার্তা দেওয়া যায় এবং নীতির বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানো সম্ভব হয়।
আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আলোচনা ছাড়াও বাজারভিত্তিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন ও মধ্যম মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে, যা প্রধানত নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতারা সাধারণত এ ধরনের পণ্যের মূল্য বাড়াতে অনাগ্রহী এবং যুক্তরাষ্ট্রে এসব পণ্যের উৎপাদন স্থানান্তরের সম্ভাবনাও কম। সে জন্য ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করা এবং তাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আলোচনায় সম্পৃক্ত করাও অপরিহার্য।
বাংলাদেশকে বাজার বৈচিত্র্যকরণের পাশাপাশি তৃতীয় বাজারে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষার প্রস্তুতিও নিতে হবে। এর জন্য নজরদারি ব্যবস্থাকে জোরদার করা, ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা এবং ন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলনের পক্ষে বহুপক্ষীয় সমর্থন জোগাড় করার উদ্যোগ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা বাড়ছে। বাংলাদেশের উচিত বিকল্প বাজারমুখী পণ্যের গতি পর্যালোচনা করা ও বিশেষ করে চীনের দিক থেকে রপ্তানি পরিবর্তন চিহ্নিত করার জন্য প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ ছাড়া ব্যবসা পরিচালনার সামগ্রিক ব্যয় কমানো গেলে বাংলাদেশ পণ্যের মূল্যেও ছাড় দিতে পারবে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, গুণগত মানের বিনিয়োগ, পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ানো এবং উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে লক্ষ্যভিত্তিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি প্রয়োজন। এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যতে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চাপ মোকাবিলার প্রস্তুতির অংশ হিসেবেও কাজ করবে।
প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে নতুন শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করার অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছিলেন। অন্য অনেক দেশও স্থগিতের অনুরোধ করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন শেষ পর্যন্ত তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে। মেয়াদ আরও বাড়ানোর কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং একটি কৌশলগত এবং সুসংগত দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে শুল্কের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি দেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সক্রিয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, লক্ষ্যভিত্তিক সংস্কার এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক পরিচিতি : ড.
হাসনাত আলম, অর্থনীতিবিদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পদক ষ প ন র জন য ব যবস র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার আহ্বান
চীনের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে এ আহ্বান জানান তিনি। বিএসইসি ভবনে এ বৈঠকে বিএসইসির কমিশনার মো. আলী আকবর ও ফারজানা লালারুখ, ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ও ডিএসইর পরিচালক ওয়াং হাইয়ের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের আইটি বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার লিন লিন ঝেং চাও, লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জিয়ান ই এবং ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হাও লিংইউ।
বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেছেন, শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও চীনের প্রতিনিধিদের শুধু ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার বা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে নয়, আমরা বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করি। এই সম্পর্ককে আমরা বিশেষ গুরুত্বের সাথে মূল্যায়ন করি। বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সহযোগিতায় অনেক কিছু অর্জন সম্ভব।
তিনি ডিএসই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রতিনিধিদলের পারস্পরিক বোঝাপড়ার প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে ডিএসই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে কম্প্রিহেনসিভ গ্যাপ অ্যানালাইসিসের পরামর্শ দেন।
বিএসইসি চেয়ারম্যান আইটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, অংশীজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সমন্বয় রক্ষা এবং প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানান। চীনের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি ডিএসই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জকে অনুরোধ জানান।
চীনের শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ, সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও চীনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের অনেক কিছু শেখার আছে বলে উল্লেখ করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের সহযোগিতা করতে বিএসইসি প্রস্তুত আছে বলেও জানান তিনি।
শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ও ডিএসইর পরিচালক ওয়াং হাই বলেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে পাঁচ বছর পর আমরা বাংলাদেশে এসেছি এবং এর মাধ্যমে বিগত কিছু সময়ের যোগাযোগের গ্যাপ পূরণ হবে বলে আশা করছি। বাংলাদেশে চীনের জন্য ভালো পরিবেশ রয়েছে এবং পুঁজিবাজার ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দুই দেশের টিম ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে।
তিনি বিএসইসির পথনির্দেশনা ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলোতে যথাসম্ভব সহযোগিতার আশ্বাস দেন শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল। ক্রস বর্ডার রোড শো’র বিষয়ে ডিএসই উদ্যোগ গ্রহণ করলে শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে বলে জানান তিনি।
ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বৈঠকে পুঁজিবাজার ও ডিএসইর উন্নয়নের ক্ষেত্রে শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও রোডম্যাপের বিষয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকে ডিএসইর পক্ষ থেকে ভি-নেক্সট প্ল্যাটফর্ম ও চীনের বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ক্রস বর্ডার রোড শোসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ ও সহায়তার অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়াও বৈঠকে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন দিক এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।
ঢাকা/এনটি/রফিক