কাশ্মীরে সাম্প্রতিক হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নতুন করে বাড়ছে। ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির জন্যও বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই দুই দেশ যখন আরও বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় দাঁড়িয়ে, তখন যুক্তরাষ্ট্রকে সামলাতে হচ্ছে অত্যন্ত জটিল এক কূটনৈতিক সমীকরণ।

যুক্তরাষ্ট্রকে এখন এই অঞ্চলে কয়েকটা জটিল বিষয় সামলাতে হবে। এদিকে আছে ভারতকে সমর্থন দেওয়া, ভারতের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অংশীদারত্ব বজায় রাখা। সঙ্গে আছে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষার কৌশল তৈরি করা।

এগুলোর কোনোটাতেই কোনো রকম শিথিলতা দেখানোর সুযোগ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন হিসেবে এই ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলেই দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং একটি বড় সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবে।

ভারত-পাকিস্তান সংঘাত আর কেবল আঞ্চলিক কোনো বিষয় নয়। এই সংঘাতের প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ, দুই দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। ফলে সামান্য সামরিক উত্তেজনাও ভয়াবহ পরিণতির দিকে গড়াতে পারে।

আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান নতুন সংঘাতে জড়াচ্ছে?২৪ এপ্রিল ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। এই অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি—দুটিই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।

কাশ্মীর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যদি সামান্যতম ভুল কূটনৈতিক পদক্ষেপও নেয়, তাহলে তা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার জন্য নয়; বরং বৈশ্বিক পরিসরেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।

সাম্প্রতিক হামলার পর ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি এ সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে ও ভারতের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।

গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও স্পষ্ট করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে রয়েছে। আমরা সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা জানাই।’

ব্রুস আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাপ্রবাহ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তানের সীমান্ত-বিতর্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষ নিচ্ছে না। কারণ, এই জটিল সংকট সামাল দিতে সংবেদনশীল ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি বলে তাঁরা মনে করেন।

কাশ্মীরে হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ভারত সফরে ছিলেন। তবে এ সফর ছিল পূর্বনির্ধারিত কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ। সফরের মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা।

হামলার পর ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি হামলার নিন্দা জানান এবং যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অংশীদারত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তাঁর এই সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

পেহেলগাম হত্যাকাণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা যখন বাড়ছিল, তখন ভ্যান্সের ভারতে উপস্থিত থাকার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও কৌশলগত আলোচনা সম্ভব করে তোলে। এতে বোঝা যায়, ওয়াশিংটন দিল্লিকে শুধু কৌশলগত নয়, বরং সামরিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।

দুই দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। সামান্য ভুল পদক্ষেপ থেকেও পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ওয়াশিংটন সম্ভবত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে এই সংকট নিরসনের চেষ্টা করবে, যাতে সহিংসতা আর না বাড়ে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়।

ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে, বিশেষ করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘যুক্তরাষ্ট্র-ভারত কমপ্যাক্ট’ উদ্যোগ চালুর মাধ্যমে। এই অংশীদারত্বের মূল লক্ষ্য হলো সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা আরও জোরদার করা।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় একটি বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাও এগোচ্ছে। ২০২৫ সালের শরতেই তা চূড়ান্ত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে ভারতের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বাড়ছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।

সব মিলিয়ে ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র হিসেবে যে প্রতিষ্ঠিত হবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ট্রাম্প প্রশাসন খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছে যে সন্ত্রাসবাদ ও আঞ্চলিক হুমকির মুখে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে থাকবে এবং এ সমর্থন অব্যাহত রাখবে।

আরও পড়ুনকাশ্মীর: ভারত সরকার ও মিডিয়া দায় এড়াতে পারে কি২৫ এপ্রিল ২০২৫

এর বিপরীতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সক্রিয় হয়েছে পাকিস্তানও। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলী জারদারি চীন সফর করেন। সফরের মূল লক্ষ্য ছিল প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়া—বিশেষত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিশ্চিত করা।

এই অংশীদারত্বকে দুই দেশই ‘সর্বকালীন মৈত্রী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাইরের চাপ মোকাবিলায় একে অপরকে সব সময় সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও তারা পুনর্ব্যক্ত করেছে। যদিও পাকিস্তানে চীনের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু উদ্বেগ রয়েছে, তবু সামগ্রিকভাবে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক এখনো শক্ত ও টেকসইভাবে এগোচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে আছে এবং সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা জানায়। আমরা নিহত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি কামনা করি, আহত ব্যক্তিদের দ্রুত আরোগ্য লাভের প্রার্থনা করি এবং এ নৃশংস ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানাই।’

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বলেন, ‘গত এক দশকে আমাদের দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কই যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতকে মেজর ডিফেন্স পার্টনার হিসেবে ঘোষণা দিতে উৎসাহিত করেছে—এই শ্রেণিতে ভারতই প্রথম।’
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। চীন সন্ত্রাসবাদের সব রূপের বিরোধিতা করে। আমরা নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শোক প্রকাশ করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’

উত্তেজনা ক্রমে বাড়ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ—একদিকে ভারতকে সমর্থন জানানো, অন্যদিকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আসা সংযমের আহ্বানকেও গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, দুই দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। সামান্য ভুল পদক্ষেপ থেকেও পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ওয়াশিংটন সম্ভবত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে এই সংকট নিরসনের চেষ্টা করবে, যাতে সহিংসতা আর না বাড়ে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যায়।

এই পরিস্থিতির পরিণতি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতের জন্যই নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তো তা খুবই স্পর্শকাতর, কারণ, চীনের আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে।

আমির দফতরি নিউজ উইকের প্রতিবেদক

নিউজ উইক থেকে থেকে, ইংরেজি থেকে অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পরর ষ ট র ক টন ত ক র জন য ত কর ছ

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা কীভাবে নির্ধারণ করব

২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জন্য জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তানীতিতে একটি স্থায়ী ঐকমত্য গড়ে তোলার ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে হাজির হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, রাষ্ট্রের এই মৌলিক ইস্যু আমাদের আলোচনায় আজও প্রান্তে পড়ে আছে। বিশ্ব ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় এ বিষয়ে ঐকমত্য খুবই জরুরি। বিশ্বের সব সফল রাষ্ট্রই তার টেকসই উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কৌশলগত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতির অভাব আমাদের উন্নয়ন পথপরিক্রমায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  

স্বাধীনতার পর থেকে কমপক্ষে দুবার এ সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। প্রথমবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের সময়। তখন আমরা সার্বভৌমত্ব, সমতা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু সংহত জাতীয় নিরাপত্তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কোনো স্থায়ী রূপ পায়নি। দ্বিতীয়বার ১৯৯১ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর। তখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সময়েও আমরা এই অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে পারিনি। 

সৌভাগ্যবশত এই ঐতিহাসিক ঘাটতি শুধরে নেওয়ার তৃতীয় একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনরাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার জন্য দুটি ব্যাপার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা (স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি), আরেকটি উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা (ডেভেলপমেন্টাল ডেটারেন্স)। এগুলোকে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে ধারণ করে সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জরুরি।

এ কারণেই জুলাই সনদে জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ এবং জাতীয় নিরাপত্তানীতি, কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ঐকমত্যবিষয়ক একটি প্রস্তাবনা আবশ্যক। রাজনৈতিক দলগুলোর এই অঙ্গীকার রূপান্তরের সূচনাবিন্দু হতে পারে। নির্বাচিত সংসদ এই এজেন্ডার বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় স্বার্থের ওপর ঐকমত্য কেবল একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবে থাকলে চলবে না; গড়ে তুলতে হবে কৌশলগত সংস্কৃতির (স্ট্র্যাটেজিক কালচার) মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো।  

আরও পড়ুনজাতীয় ঐকমত্য সমঝোতা স্মারকে যা থাকতে পারে ১১ মার্চ ২০২৫কৌশলগত সংস্কৃতি

কৌশলগত সংস্কৃতি ও সংহতি আপনা-আপনি গড়ে ওঠে না। প্রায়ই তা তৈরি হয় সংঘাত বা রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পর ভারত তার প্রতিরক্ষাকাঠামোয় মৌলিক সংস্কার আনে। গান্ধীবাদী কূটনীতির পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক সক্ষমতা ও আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে কৌশলগত সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। চীনও পদ্ধতিগতভাবে দলীয় নিয়ন্ত্রণ, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে ‘মৌলিক স্বার্থ’ সংজ্ঞায়িত করেছে।

মনরো (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস মনরো) থেকে ট্রুমান (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুমান) ডকট্রিনসহ একাধিক কৌশলগত নীতিমালার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কৌশলগত প্রাধান্যের সঙ্গে যুক্ত করে সময়ের প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন এনেছে তারা। 

১৯৪০ সালের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর চার্লস ডি গল কৌশলগত স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে ফরাসি জাতীয় স্বার্থ পুনর্গঠন করেন। ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে প্রত্যাহার ও পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে এটি বাস্তবায়িত হয়।

মেইজি (জাপানের সম্রাট) পুনরুদ্ধারের পর জাপান একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করে। শিল্পায়ন, ভূখণ্ড সংহতকরণ এবং পরবর্তীকালে সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল তাদের জাতীয় স্বার্থের ভিত্তি। দীর্ঘ উপনিবেশ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম পুনরেকত্রীকরণ, সার্বভৌমত্ব ও সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। একইভাবে ইন্দোনেশিয়ার ‘পঞ্চশীল’ দার্শনিক ভিত্তি তার জাতীয় নিরাপত্তার মূল নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। বর্ণবাদের পতনের পর দক্ষিণ আফ্রিকা গণতান্ত্রিক বৈধতার ভিত্তিতে পুনর্মিলন, মর্যাদা ও মহাদেশীয় নেতৃত্বের ওপর জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করেছে। 

এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, পরিবর্তনের সময়গুলোয় জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়। আর কৌশলগত সংস্কৃতি শুধু সামরিক নীতিতেই নয়, শিক্ষানীতি, কূটনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনাতেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা 

বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকাঠামো নির্মাণে কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা (অর্থাৎ স্বাধীন ও দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা) এবং উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থার (যথা শান্তি ও অধিকার নিশ্চিত করা) মাধ্যমে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি—এ দুই ধারণাই একটি সুসংহত নিরাপত্তাকাঠামোর ভিত্তি হতে পারে।

উন্নয়নধর্মী নিবারণব্যবস্থা প্রথাগত নিবারণব্যবস্থার চেয়ে ভিন্ন। এটি শুধু সামরিক নয়, বরং কৌশলগত। এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার উন্নয়নকাঠামোকে নির্বিঘ্ন রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সিঙ্গাপুর দ্রুত সামরিক আধুনিকীকরণ করেছে আগ্রাসনের জন্য নয়, বরং উন্নয়ন–নিরাপত্তার জন্য। বাংলাদেশকেও একইভাবে তার জনমিতিক সম্পদ ও বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে থাকবে। প্রতিরক্ষানীতিতে থাকতে হবে দৃঢ় নিবারণ সক্ষমতা। 

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে চলছে জাতিগত সংঘাত। এসবের প্রেক্ষাপটে কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভিত্তিতে যদি আমরা জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণ করতে পারি, তাহলে তা বাংলাদেশকে ভূকৌশলগত সক্ষমতা ও ভূরাজনৈতিক প্রাধান্য প্রদান করতে পারে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যমের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।

সম্পর্কের চারটি দৃশ্যপট 

সম্পর্কের চারটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট কল্পনা করা যেতে পারে। প্রতিবেশীর দিকে ঝুঁকে পড়া, কোনো এক পরাশক্তির দিকে ঝোঁক, ভারসাম্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা এবং স্বাধীন, পারস্পরিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কূটনীতি। এর মধ্যে চতুর্থ সম্ভাব্য দৃশ্যপট তথা স্বাধীন ও পারস্পরিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশলই কেবল দীর্ঘস্থায়ী টেকসই অগ্রসর হওয়ার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। এই পথে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া যাত্রা সম্ভব নয়। জাতীয় অগ্রাধিকার, নৈতিক বৈধতা এবং কৌশলগত স্বচ্ছতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তানীতি শুধু সামরিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সমন্বিত কাঠামো। সেখানে অর্থনীতি, কূটনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। একটি কার্যকর জাতীয় নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে তুলতে হলে এ সব দিকই বিবেচনায় নিতে হবে। 

নিরাপত্তানীতি উদ্ভূত হতে হবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা থেকে। বিশেষ করে নিরাপত্তানীতিতে বহুপক্ষীয়তায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, উন্নয়ন অর্থায়ন, বাণিজ্য ও জলবায়ু–কূটনীতিবিষয়ক দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলেই বিশ্বকে জানান দেওয়া যাবে যে বাংলাদেশ কেবল প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বৈধ, সার্বভৌম কৌশলগত পরিচয় ঘোষণা করছে। নিরাপত্তানীতি সশস্ত্র বাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নানা সংস্থার কাজ সম্পর্কে জনগণের কাছে স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাস প্রদান করবে। জনগণের কাছ থেকে নৈতিক বৈধতা অর্জনের মাধ্যমে কৌশলগত সংস্কৃতি জাতীয় সংহতি গড়বে। জাতীয় সংহতিই প্রধানতম কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও নিবারণব্যবস্থা। 

কৌশলগত ভবিষ্যৎ

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান জাতির ক্ষমতায়নের প্রতীক। জনগণ তার সক্ষমতার কথা জানান দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানকে ধারণ করতে হলে সব রাজনৈতিক দলকে জুলাই চার্টারে একটি অঙ্গীকার নিশ্চিত করতে হবে। এই অঙ্গীকার হবে একটি সর্বব্যাপী জাতীয় নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সংজ্ঞায়িত করা ও জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অঙ্গীকার। জাতীয় স্বার্থবিষয়ক ঐকমত্য গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই ব্যাপারে পথনকশা জরুরি ও অপরিহার্য। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অতীতকে সমন্বিত করতে, বর্তমানকে স্থিতিশীল করতে এবং ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করতে পারবে।

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে রাষ্ট্র কাজ করে নির্ধারিত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে, তারা টিকে থাকে। যারা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে, তারা বিকশিত হয়। গণ–অভ্যুত্থান শুধু কণ্ঠের পুনরুদ্ধার নয়, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল বদলের ভিত্তিতে সুসংহত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের অঙ্গীকারও। 

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দ্বিপাক্ষিক কাজ করবে বেসিস-কোরিয়া
  • বৈদেশিক ব্যবসায় কাজ করবে বেসিস-কোরিয়া
  • বৈদেশিক ব্যবসায় বেসিস-কোরিয়া ডেস্ক
  • দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ডেস্ক চালু করল বেসিস
  • বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার আহ্বান 
  • জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা কীভাবে নির্ধারণ করব